সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটুনি: কী ঘটেছিল সেই রাতে?
বুধবার রাত সাড়ে ১২টায় নিজ সংগঠনের কনিষ্ঠ নেতাকর্মীদের হাতে বেধড়ক পিটুনির শিকার হন ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এ এফ রহমান হলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) নতুন ভবনের লিফটে ওঠাকে কেন্দ্র করে তাকে মারধর করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাসের অনুসারীরা।
আহত রুহুল বর্তমানে ঢাকার রিলাইন্স হসপিটালে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তার বড় ভাই এস এম আবদুর রহিম। যিনি নিজেও এই ঘটনায় আহত হয়েছেন।
কী ঘটেছিল সেই রাতে, কেন ঘটেছিল, কারই বা দোষ কতটুকু? এসব বিষয় জানতে ঢাকাটাইমসের সঙ্গে কথা হয় পাঁচ নেতাকর্মীর যারা সবাই মারামারিতে অংশ নিয়েছিলেন। তবে কেউই নাম প্রকাশে রাজি হননি।
তারা ঢাকাটাইমসকে চার ছাত্রলীগ নেতার নাম বলেছেন, যারা রুহুল আমিন ও তার ভাই আবদুর রহিমকে আট তলা থেকে টেনে-হেঁচড়ে পিটুনি দিয়ে নিচ তলায় নিয়ে আসেন। তারা হলেন, সাজেন্ট জহুরুল হল ছাত্রলীগের স্কুল ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শহীদুল শান, বঙ্গবন্ধু হলের সহ-সভাপতি মেহেদি হাসান শান্ত, মহসীন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী হদয় হোসেন সোহাগ ও সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নাহিদ হাসান।
ঘটনার সূত্রপাত
রাত আনুমানিক ১২টা ২০। ছাত্রলীগ নেতা রুহুল আমিন ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছিলেন তার ভাইয়ের শাশুড়ির লাশ আনতে। সঙ্গে ছিলেন তার বড়ভাই এস এম আবদুর রহিম ও কয়েকজন আত্মীয়। একই সময়ে অন্তঃসত্ত্বা অসুস্থ স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মেডিকেলে যান বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্রের বড় ভাই, সঙ্গে ছিলেন সনজিতের কয়েকজন বিশ্বস্ত রাজনৈতিক কর্মী।
রুহুল ও তার সঙ্গীরা মেডিকেলের আট তলায় যাওয়ার জন্য লিফটে উঠেন। অন্যদিকে সনজিতের ভাই-ভাবির গন্তব্য ছিল দশতলা। কিন্তু ধারণক্ষমতার চেয়ে লোকসংখ্যা বেশি হওয়ায় লিফট নিচ তলায় থেমে থাকে। তখন রুহুল ও সনজিতের বড় ভাই একে অপরকে লিফট থেকে নেমে যেতে বলেন এবং সেখান থেকেই কথা কাটাকাটি ও ধাক্কাধাকির শুরু। এক পর্যায়ে সনজিতের বড় ভাই রাজনৈতিক পরিচয় দিলে তাকে ‘মালুর বাচ্চা মালু’ বলে গালি দেন রুহুল আমিন।
প্রথম ধাপ: লিফট থেকে নেমেই কথা কাটাকাটির বিষয়টি সনজিতকে জানান তার কর্মীরা। খবর পেয়ে মোটর-বাইক নিয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি দ্রুত ছুটে যান মেডিকেলের গেইটে। সনজিতের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি হল থেকে ছুটে আসেন তার অনুসারীরা এবং অবস্থান নেন মেডিকেলের সামনে। পরে সনজিত আট তলায় রুহুল আমিনের কাছে গিয়ে ঘটনার ব্যাখ্যা জানতে চাইলে আবারও শুরু হয় কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি। এক পর্যায়ে সনজিত নিচে নেমে আসেন আর রুহুলকে বলেন ‘তোরা নিচে আয়, আমি আছি’। তার হুমকির পাল্টা জবাবে আবদুর রহিম বলেন, ‘মেডিকেল থেকে বের হ, তোকে আমি দেখে নেব।’
দ্বিতীয় ধাপ: দ্বিতীয় ধাপে সনজিত ঢাকা মেডিকেল শাখা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফোরকান মোল্লাকে রুহুলের কাছে পাঠান যাতে তিনি সনজিতের ভাই-ভাবির কাছে ক্ষমা চান। কিন্তু তাতে রুহুল ও তার ভাই কর্ণপাত করেননি। বরং তারা ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ইউনিটে থাকা তাদের অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।পরবর্তী সময়ে ঢাকা কলেজ ও আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আসা ছাত্রলীগ কর্মীদের দুটি গ্রুপ মেডিকেলের আশেপাশে জড়ো হতে থাকে। বিষয়টি লক্ষ্য করে সনজিতের অনুসারীরা এবং তৎক্ষণাৎ ধাওয়া দিয়ে কয়েকজনকে ধরে বেধড়ক পিটুনি দেয়, আর বাকিরা পালিয়ে যায়। এই ধাওয়ার পরপরই সনজিত চন্দ্র তার অনুসারীদের নিয়ে হলে ফিরে আসেন।
তৃতীয় ধাপ: সনজিত হলে ফিরে গেলেও তার অনুসারীদের একটি অংশ থেকে যায় মেডিকেলে। যারা পরবর্তী সময়ে রুহুল আমিন ও তার ভাইকে মারতে মারতে আট তলা থেকে নিচ তলায় নিয়ে আসেন।
সেই অংশটির মধ্যে ছিলেন, সার্জেন্ট জহুরুল হল ছাত্রলীগের স্কুল ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শহীদুল শান, বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ও আইনের ছাত্র মেহেদি হাসান শান্ত, মহসীন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী হদয় হোসেন সোহাগ ও সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নাহিদ হাসান। তারাই রুহুল ও তার ভাইকে টেনে-হেঁচড়ে আট-তলা থেকে পিটুনি দিয়ে নিচে নিয়ে আসেন। পরে নিচ তলায় জহুরুল হক হলের উপ-অর্থ সম্পাদক মাসুদ বিল্লাহ, বঙ্গবন্ধু হলের রাফি, জগন্নাথ হলের পিনাক, কাজল, শুভ ও সূর্যের নেতৃত্বে মারামারিতে যোগ দেন শতাধিক নেতাকর্মী। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও শহিদুল্লাহ হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই বেশি ছিল।
এই বিষয়ে সনজিত ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মা-বোনের সাথে খারাপ-আচরণ করলে যে কারো খারাপ লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে আমি তার গায়ে কোনো হাত তুলিনি কারণ তিনি আমার ছাত্রলীগের বড় ভাই। বিশ্বাস না হলে আপনারা মেডিকেলের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে পারেন।’
তবে তিনি মারামারির বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, ‘এইভাবে আঘাত করা আমিও সর্মথন করি না। আমি সেখানে থাকলে এই মারামারি হতো না। আমার অনুপস্থিতিতে তারা (অনুসারীরা) এই কাজ করেছে, পরবর্তী সময়ে. আমিই গিয়ে তাদের ফিরিয়ে এনেছি।’
দোষীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর সাথে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তা সম্ভব হয়নি।
অসুস্থতার কারণে প্রতিবেদকের সাথে কথা বলতে পারেননি রুহুল আমিন। তবে কথা হয়েছে তার বড় ভাই আবদুর রহিমের সাথে। তিনি বলেন, ‘বড় ভাইয়ের সামনে ছোট ভাইকে মারধর কতটা হৃদয় বিদারক, সেটা বলে বোঝাতে পারব না। আমার সামনে আমার ভাইকে মারতে মারতে ১০ তলা থেকে দুই তলায় নিয়ে আসছে। আমার খালার লাশ দুই ঘণ্টা যাবৎ আটকে রেখেছে, যেটা কখনো মেনে নেওয়া যায় না। সে হল থেকে ছাত্রলীগ করে এসেছে, হলের সাধারণ সম্পাদক ছিল, কেন্দ্রীয় কমিটিতেও দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু এত বড় অপমান জীবনে কখনেও হয়নি।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে রহিম বলেন, ‘এত কিছুর পরও দোষীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
এদিকে ঘটনার দিন রাতে রুহুল আমিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত এর বিচার না হবে ততক্ষণ আমি খাবো না, কেউ যদি আমাকে জোর করে তবে আমি আত্মহত্যা করবো। এই কমিটির দ্বারা আমি যে অপমানের শিকার হয়েছি তা হাজার বার জন্ম নিলেও ভুলবো না।’
(ঢাকাটাইমস/২৮সেপ্টেম্বর/এএইচএস/জেবি)