মডেল হাসপাতালের আদর্শ ডাক্তার

ইকরামুল আলম, ভোলা
  প্রকাশিত : ২৬ আগস্ট ২০১৯, ০৮:১৩| আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০১৯, ১১:০৫
অ- অ+

প্রথমে দেখলে মনে হতে পারে স্কুল। পতাকা উত্তোলনের পাশাপাশি গাওয়া হচ্ছে জাতীয় সঙ্গীত, চলছে শপথ পাঠ। কুশীলবরা সবাই প্রাপ্তবয়স্ক। ভালো করে সেটি লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় এটি অন্য প্রতিষ্ঠান। আসলে সেটি হাসপাতাল।

ভোলার মনপুরা উপজেলা হাসপাতালের সব চিকিৎসক, নার্স এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের দিনের কার্যক্রম শুরু করেন এভাবেই। আর নিত্যদিন শপথ পড়ে কাজ করেন বলেই কি না, এখানে সেবার মান ও পরিবেশ সবই অন্য উপজেলা হাসপাতালের তুলনায় বেশ ভালো। আর রোগীদের মধ্যেও আন্তরিকতা নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকে না।

হাসপাতালের চিত্র পাল্টে দেয়ার পেছনের এই কারিগর মাহামুদুর রশিদ। তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা।

কেন স্কুলের ধাঁচে হাসপাতাল চালান? জনাব রশিদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এভাবে শপথের মাধ্যমে চিকিৎসক ও নার্সরা রোগীদের সেবা প্রদানে উদ্বুদ্ধ হন। আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকলে সমস্যাগ্রস্ত দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষকেও সহজেই কাক্সিক্ষত সেবা দেয়া সম্ভব।’

সকালে শপথ পড়ানোর পাশাপাশি রোগীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে চিকিৎসকদের ও হাসপাতাল কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেন এই চিকিৎসক। নিজে থেকেই যেন রোগীদের সালাম দিতে হবে, এই বিষয়টিও শিখিয়েছেন কর্মীদের।

ডাক্তারদের কেমন ব্যবহারে রোগীরা ব্যবহারে সন্তুষ্ট হন সেই বিষয়টিও হাতে কলমে শেখান উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। রোগীদের সেবাকে নিত্যনূতন কায়দায় কীভাবে আকর্ষণীয় করে তোলা যায় সে বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। ঢাকা টাইমসকে বলেছেন, ডাক্তাররা উচ্চশিক্ষিত হলেও অনেক মানুষ তাদের প্রতি ঘৃণার চোখে দেখে। আর এটা তিনি দূর করতে চান।

এসব উদ্যোগের স্বীকৃতিও মিলেছে। মনপুরা হাসপাতালটি ২০১৭ সালে ‘বেস্ট কমিউনিটি হেলথ অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছে। তার উদ্ভাবিত জনগণের অংশগ্রহণে দুর্গম অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে, আগামী বছর থেকে দেশের অন্যান্য দুর্গম এলাকায় বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে তারা।

আর মনপুরায় চিকিৎসাসেবায় বিপ্লব আসার পর গোটা উপজেলায় শিশু ও মাতৃমুত্যুর হার অনেক কমে গেছে বলে জানাচ্ছে ভোলার সিভিল সার্জন কার্যালয়। তারা গোটা জেলাতেই এটি ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে।

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের অবহেলা, অব্যবস্থাপনা আর রোগীদের ভোগান্তির ভুরি ভুরি যেসব অভিযোগ পাওয়া যায়, সেগুলোর ছিটেফোটাও দেখা যায় না মনপুরায়। এখানে আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি হাসপাতালে যেন আরো রোগী আসে, সে জন্য দুর্গম চরাঞ্চলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আহ্বান জানান চিকিৎসক মাহামুদুর রশিদ।

স্থানীয়রা এই চিকিৎসালয়টিকে বলেন ‘মডেল হাসপাতাল’। আর চিকিৎসক মাহামুদুর রশিদকে আদর্শ হিসেবে দেখেন তার সঙ্গে কাজ করা কর্মীরা। আর স্থানীয়রা যে তাদের কতটা শ্রদ্ধা আর সম্মানের সঙ্গে দেখেন, সেটি এলাকায় না গেলে বোঝা সম্ভব নয়।

অথচ এই চিকিৎসক দায়িত্ব নেওয়ার আগের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। উপজেলা হাসপাতালে এসে এসে সেবা না পেয়ে রোগীদের চলে যেতে হতো চরফ্যাশন বা ভোলা সদর হাসপাতালে। তাই ধীরে ধীরে এই হাসপাতালটি নিয়ে মানুষের আগ্রহও কমছিল।

২০১৬ সালের শেষে এই হাসপাতালে যোগ দেন মাহামুদুর রশিদ। রোগী আসে না কেন, সেটি বুঝে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। বলে এসেছেন, তারা যেন হাসপতালে আসে, সেখানেও সেবা মিলবে। শুরুতে কেউ কেউ ‘লোক দেখানো কাজ’ বলে বাঁকা কথা বলত। কিন্তু ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে যায়, এগুলো আন্তরিকভাবেই করেছেন মাহামুদুর রশিদ।

চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি নিজের গলায় কবি গান বা পথ নাটকের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষদেরকে স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলছেন এই চিকিৎসক।

গর্ভবতীরা যেন সঠিকভাবে চিকিৎসাসেবা পায় এবং মনপুরার বাইরে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা সেবা নিতে পারে সে জন্য গঠন করেছেন কমিউনিটি সাপোর্ট কমিটি। এ কমিটি স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে একটি তহবিল গঠন করে। সে তহবিল থেকে রোগীদের আর্থিক সহযোগিতা করা হয়। উপজেলা চেয়ারম্যান পদাধিকার বলে কমিটির সভাপতি এবং স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সদস্য সচিব এর দায়িত্বপালন করেন।

ব্যতিক্রমী এই চিকিৎসকের এসব বিষয়গুলোকে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছেন মনপুরার অন্যান্য চিকিৎসক, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে রোগীরা।

মাহামুদুর রশিদ ঢাকা টাইমসকে জানান, মনপুরায় গাইনি চিকিৎসক ও এনেসথেসিস্ট না থাকায় মাতৃ মৃত্যুর হার বেশি ছিল। নারীরা গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন সেবা থেকে বঞ্চিত। তাই তিনি কবি গানের মাধ্যমে চরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজেই গান গেয়ে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, রোগীরা যেন বাড়িতে ধাত্রীদের ভুল চিকিৎসার শিকার না হয়ে হাসপাতালে এসে নিরাপদে প্রসব করান।

মনপুরা থেকে নৌপথ ছাড়া অন্য কোথাও রোগী নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, এ কারণে মনপুরা হাসপাতালে নৌ অ্যাম্বুলেন্সেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।

মাহামুদুর রশিদ এর আগে ছিলেন ভোলার লালমোহন হাসপাতালে। সেখানেও তিনি পাল্টে দিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানটির পুরো পরিবেশ। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ দেখে কারো অপেক্ষায় না থেকে নিজেই পরিষ্কার করেন টয়লেটসহ গোটা হাসপাতাল চত্বর।

‘ডাক্তারদের প্রতি ঘৃণা’ দূর করার আকাক্সক্ষা

চিকিৎসকরা সচরাচর যা করেন না, সেটি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে করে যাচ্ছেন মাহামুদুর রশিদ। কী তাড়না থেকে?- এমন প্রশ্নে ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘একটা সময় আমি দেখতাম রাস্তা-ঘাটে বা হোটেল-রেস্টুরেন্টে মানুষ ডাক্তার দেখলে একটু বিরক্তির চোখে তাকাত। এটি দেখে মনে হলো যে, একজন ডাক্তার এত শিক্ষিত হওয়ার পরও কেন মানুষ আমাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখে। আর সেই থেকেই রোগীদের কাছে আপন হওয়ার জন্য আমি এ সকল ব্যাতিক্রমী কার্যক্রম শুরু করি।’

‘আমি আশা করি যদি সকল ডাক্তার এভাবে মানুষকে সেবা দেয় তাহলে মানুষ আর ডাক্তারদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করবে না। বরং উল্টো প্রশংসা করবে। যার প্রমাণ আমি নিজেই।’

‘সকলের মাঝে দেশত্ববোধ জাগ্রত করতেই আমি সকাল বেলা জাতীয় সংগীত গেয়ে পতাকা উত্তোলন করি। পরে শপথের মাধ্যমে দিনের কার্যক্রম শুরু করি। সারাদিন কাজ করতে করতে যখন একটা সময় নিজের মধ্যে বিরক্তিভাব চলে আসে, তখন এই শপথের কথাগুলো মনে পড়লে সেই বিরক্তি আর থাকে না। এর কারণে রোগীরাও চিকিৎসকদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে।’

‘আমি মনে করি আমি রাষ্ট্রের একজন কর্মচারী। আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে। তাই আমি এই চরাঞ্চলের অবহেলিত মানুষের কাছে কাছে গিয়ে তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করি।

মুগ্ধ এলাকাবাসী

চিকিৎসকরা এভাবে সেবা দেবেন সেটি কল্পনাও ছিল না মনপুরাবাসীর। বলতে গেলে তিনি একাই গোটা উপজেলার স্বাস্থ্যসেবা পাল্টে দিয়েছেন। উদাহরণ হতে যাচ্ছেন গোটা দেশের। তার মডেল সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে সরকারি হাসপাতাল নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টে যেতে বাধ্য বলেও মনে করে মনপুরাবাসী।

উপজেলা চেয়ারম্যান শেলিনা আক্তার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মনপুরা হাসপতালটি এক সময় ছিল অবহেলিত। ডাক্তার মাহামুদুর রশিদ আসার পর থেকে এর চিত্র পুরোপুরি পাল্টে গেছে। তার বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ডে রোগীরা এখন হাসপাতালে ভিড় জমাচ্ছে। তার প্রচেষ্টায় হাসপাতালের পরিবেশও অত্যন্ত সুন্দর হয়েছে। আমি মনে করি, তার এ সকল কাজ সাড়া দেশের জন্য একটি মডেল।’

ভোলার সিভিল সার্জন রথীন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, ‘রোগীদের মঝে একটি ভুল ধারণা ছিল যে, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা ভালো হয় না। সেটি দূর হয়ে গেছে। তার এসব কাজের ফলে ওই উপজেলায় শিশু ও মাতৃমুত্যুর হার অনেক কমেছে। আমরা তাকে নিয়ে গর্ব করি। আমি চাই, ভোলার প্রতিটি হাসপালাতের চিকিৎসক ও নার্সরা তার মতো দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক। তাহলে ডাক্তারদের প্রতি মানুষের যে ভুল ধারণা আছে সেটা পাল্টে যাবে।’

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
হাতিরপুলে গণসংহতি আন্দোলনের কার্যালয়ের সামনে দুই ককটেল বিস্ফোরণ
৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ১৬৯০ জন
এনসিপির ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি শুরু
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও যোদ্ধাদের স্মরণে ‘বিআরপি’র মশাল মিছিল
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা