সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে পরের তরে

করোনাভাইরাস (COVD-19) নামক মহামারী সংক্রামক ব্যাধির কারণে সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশও চলতি বছরের মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে।
যা অঘোষিত লকডাউনে পরিণত হয় পুরো দেশে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন এলাকায় করোনা রোগীর শনাক্ত হতে শুরু করে তা সংক্রামিত কমানোর জন্য ছুটিও বাড়তে থাকে।
করোনাভাইরাসের কোনো প্রতিশেধক আবিষ্কৃত হয়নি বিধায় তা প্রতিরোধই একমাত্র উপায়। তাই এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করা, বাড়িতে থাকা এবং নিজের আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, মুখে মাস্ক ব্যবহার করা।
আমার নিজের মধ্যে সবসময় একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা কাজ করছে এই পরিস্থিতিতে কি করা যায়। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এলাকায় নিজে কি করতে পারি এই চিন্তা করে আমি চলে গেলাম কাওরানবাজারে এবং জীবাণুনাশক ছিটানোর জন্য একটা মেশিন কিনলাম। অন্ততপক্ষে নিজে যে এলাকায় থাকি ওখানে জীবাণুমুক্ত করার জন্য জীবাণনাশক ছিটানো শুরু করব এই জন্য। অনলাইনে পিপিই অর্ডার করলাম কিন্তু পিপিই আসতে সময় লাগবে কমপক্ষে ৩ দিন তাই আপাতত রেভনকোর্ট পড়ে রাস্তায় জীবাণুনাশক ছিটানো শুরু করলাম।
একদিন পর পিপিই হাতে পেলাম, পিপিই পাওয়ার পর পরই আমিসহ আরো দুজন লোক ঠিক করলাম প্রতিদিন অন্তত দুবার ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় জীবানুনাশক ছিটানো শুরু করলাম যা এখনো অব্যাহত আছে।
আমাদের মানবাধিকার সংগঠন লিগ্যাল সাপোর্ট এন্ড পিপলস রাইটস, যার প্রধান কাজ হচ্ছে অসহায় গরিব মানুষকে বিনা পারিশ্রমিকে আইনি সহায়তা দেওয়া। আমরা এই সেবাটি প্রতিনিয়ত দিয়ে আসছি। এছাড়া পবিত্র ঈদের সময়ে এবং দেশের বিভিন্ন দুর্যোগমুহূর্তে আমাদের সংগঠন অসহায় নিম্ন আয়ের মানুষদেরকে খাদ্য সামগ্রী ও নতুন কাপড় দিয়ে সহযোগিতা করে থাকি। লিগ্যাল সাপোর্ট এন্ড পিপলস রাইটস এর চেয়ারম্যান হিসেবে সংগঠনের সবার সাথে আলাপ আলোচনা করে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশও দীর্ঘদিন লকডাউন থাকায় অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাদেরকে আমাদের সংগঠন থেকে কিভাবে সহায়তা করা যায় এ বিষয়ে একটি কর্ম পরিকল্পনা করা হয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি এবং এলএসপি আর এর সহ-সভাপতি ড. মাহবুব রাব্বানী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট লোকমান হোসেন, ট্রেজারার অ্যাডভোকেট হাসনাইন এবং সংগঠনের অন্যান্য সদস্যবৃন্দসহ আমাদের প্রত্যেকের বন্ধু বান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের আর্থিক সহযোগিতায় গত ১৫ এপ্রিল "মানবতাই প্রথম" এই স্লোগানকে সামনে রেখে দরিদ্র ও অসহায়দের মাঝে প্রাথমিকভাবে ১০০টি পরিবারের মধ্যে এক সপ্তাহের খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়।
এর মাঝে একদিন সকাল বেলা আমার মোবাইলে একটি কল আসে, রিসিভ করার সাথেই বলল স্যার একটা কথা বলবো। পরিচয় দিয়ে বলল, আমার স্ত্রী প্রেগনেন্ট, আমার এখন কোনো কাজ নাই, আমাকে একটু সাহায্য করা যাবে।
আমি বললাম নাম্বার পাইছো কোথায়। বলল, স্যার! সুন্দরবন কোরিয়ার সার্ভিসের এক লোক দিছে।
আমি যাচাই করার জন্য স্কুটিটা টান দিলাম সুন্দরবন অফিসে, ছেলেটা সত্যই বলেছে। ডেকে পাঠালাম এবং আমি তার হাতে চাল, ডাল, আটা, তেল ও আলুসহ একটা প্যাকেট দিলাম, যাতে সে এক সপ্তাহ খেতে পারে। বললাম সমস্যা হলে আমাকে ফোন করবে।
সিলেট থেকে একজন ফোন করে বলে, ভাই আমি আমার মা বাবাসহ পরিবারে আছি কিন্তু বর্তমান করোনাভাইরাসের কারণে আমার বাবা কোনো কাজ করতে পারছে না। কষ্টের কথা কারো কাছে শেয়ার করতে পারছি না। বিষয়টি সংগঠনের সহ-সভাপতি ড. মাহবুব রাব্বানীকে জানালে সে খোঁজ খবর নিয়ে সত্যতা যাচাই করে। পরে তার কাছে খাদ্য সামগ্রী কেনার জন্য কিছু টাকা পাঠিয়ে দেই।
একই ধারাবাহিকতায় লিগ্যাল সাপোর্ট পিপলস রাইটস অসহায় খেটে-খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য সামগ্রী দিয়ে সহায়তা করার জন্য ঢাকার বাহিরে বিভিন্ন জেলায় সম্প্রসারিত করি এবং পর্যায়ক্রমে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙলে, হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল ও নবীনগর এবং সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৪০০ পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়।
করোনাভাইরাস সংক্রামক হতে ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কিছু ডাক্তার ও সাংবাদিক বন্ধুদের পিপিই সরবরাহ করেছি।
গত ৯মে পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে এলএস পি আর ফার্মগেট, গ্রিনরোড ও পান্থপথ এলাকায় ১২০ জন খেটে খাওয়া মানুষ ও পথচারীদের মাঝে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ইফতার বিতরণ করে।
করোনা মহামারীতে পুরো বিশ্ব এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। বিশ্বের প্রভাশালী ও ক্ষমতাধর দেশ আমেরিকা, লন্ডন ইতালি, স্পেন, ফ্রান্সের মতো দেশগুলোতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে এবং দীর্ঘদিন লকডাউন থাকার কারণে বেশিরভাগ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে বলে জাতিসংঘ আশংকা প্রকাশ করছে। আমাদের বাংলাদেশ নিয়েও বিভিন্ন রাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করেছেন। মনে রাখতে হবে করোনা পরিস্থিতিতে যে সমস্যা এটা শুধু বাংলাদেশের না পুরো বিশ্বের সমস্যা।
বর্তমান এই করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রত্যেকটি সেক্টরে প্রণোদনা ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ দেয়ার ঘোষণা করেছেন। বিভিন্ন জেলায় দশ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন জেলায় জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। যা অত্যন্ত প্রসংশনীয় উদ্যোগ। এলএসপিআর এর পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীক আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জ্ঞাপন করছি।
বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিতে মানবতাকে সামনে রেখে লিগ্যাল সাপোর্ট এন্ড পিপলস রাইটস সবসময়ই অসহায় মানুষকে সহায়তা দিয়ে যাবে।
পরিশেষে বলতে চাই "সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।" প্রত্যাশা করি বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে একটা সুন্দর সকালের সূর্য্য উদিত হবে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

মন্তব্য করুন