সদিচ্ছা থাকলে বেসরকারি হাসপাতালের জবাবদিহিতা নিশ্চিত সম্ভব

ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার
 | প্রকাশিত : ০২ জুন ২০২০, ১৪:২৭

আমরা জানি, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় বাংলাদেশের অর্জন উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখেও আমাদের দেশটি মধ্যম আয়ের অর্থনীতির দিকে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া স্বাস্থ্যখাত সহ অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের দেশের দক্ষ মানব-সম্পদ পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সুনামের সাথে বিশ্বমানের বড়বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে, এবং সেখানে উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু নিজ দেশের স্বাস্থ্যখাত, উল্লেখিত ইতিবাচক অর্জন সত্ত্বেও আজ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা সবাই কখনো না কখনো সরকারি বা বেসরকারি চিকিৎসা সেবার দ্বারস্থ হয়েছি।

আমাদের সেইসব অভিজ্ঞতা সবসময় খুব সুখকর নয়। কম-বেশি ভোগান্তি সবাইকে পোহাতে হয়েছে, এবং হচ্ছে। এই ভোগান্তির অসহনীয় মানসিক চাপ যে কী, তা ভুক্তভোগীরা সবাই জানেন। তবে, স্বাস্থ্য সেবাখাতে এতো অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনায় শুধু রোগীরাই ভুক্তভোগী নয়, বরং সাধারণ চিকিৎসক ও নার্সরাও একই ভাবে ভুক্তভোগী। বেসরকারি হাসপাতাল গুলোতে মানসম্মত চিকিৎসা না পেয়েও রোগীকে যেমন গুনতে হয় চড়া মূল্য, তেমনি চাকরি করলেও চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য নেই কোন চাকরি বিধিমালা- অনেকেই পাচ্ছেনা নিয়মমাফিক বেতন-ভাতা। যাদের জন্য এই অব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যখাতের সেই গুটিকয়েক অসৎ ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ আমলা ও অল্প কিছু বিকারগ্রস্থ-লোভী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হাতে আমরা গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে জিম্মি হতে দিতে পারি না। দেশের যাবতীয় অর্জন ও সম্মানকে বিশ্বদরবারে ভূলুণ্ঠিত হতে দিতে পারি না। যারা টাকার লোভে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে, সাধারণ চিকিৎসক ও নার্সদের সর্বদা বঞ্চিত করে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শত পরিশ্রমের ফসলকে ভূলুণ্ঠিত করে- তাদের চরম অনৈতিক এবং অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, সরকার সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্যই আমরা 'স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম' গঠন করেছি।

স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের ৫ বছর মেয়াদী চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা, এবং পুষ্টি খাত কর্মসূচী (HPNSP) রয়েছে, যা ২০১৭ সাল থেকে শুরু করে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবে। এই কর্মসূচীর জন্য এক লক্ষ চব্বিশ হাজার আট শত তিন কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এই কর্মসূচীর সার্বিক লক্ষ্য হচ্ছে- 'গুনগত, মানসম্পন্ন, এবং সুষম স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিত করা।' এই কর্মসূচীর প্রধান তিনটি উপাদান হলো:

(১) বাস্তবায়ন সুশাসন ব্যবস্থা ও সার্বিক তত্ত্বাবধান,

(২) স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং জনসংখ্যা খাতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা জোরদারকরণ,

(৩) মানসম্পন্ন সেবাদান।

আমরা এই HPNSP এর সঠিক বাস্তবায়ন চাই, সরকারের পাশে দাঁড়াতে চাই। আমরা চাই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জনগণের জন্য নিবেদিত হোক, মানবিক হোক। রোগীদের, চিকিৎসকদের ও নার্সদের অধিকার আদায় নিশ্চিত হোক। আমাদের এই ফোরামের মাধ্যমে, আমরা স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জসমূহ তুলে ধরতে চাই, নিয়মিত ভাবে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জানাতে চাই, বঞ্চনার অভিজ্ঞতাগুলো সংগ্রহ করে এর প্রতিকারকল্পে কাজ করতে চাই। পর্যাপ্ত সমর্থন ও অকুণ্ঠ সহযোগিতা পেলে আমরা রাষ্ট্র এবং আইনি কাঠামোর মাধ্যমে, জনগণের চিকিৎসা প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করে যেতে চাই।

বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালসমূহ, ১৯৮২ সালে প্রণীত একটি অধ্যাদেশ অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হয়। ‘The Medical Practice and Private Clinics and Laboratories (Regulation) Ordinance, 1982’ নামের অধ্যাদেশটি সেই সময়ে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে হয়তো সময়োপযোগী ছিল। কিন্তু, বর্তমান সময়ের প্রয়োজন ও জনহিতকর প্রেক্ষিত বিবেচনায় এই অধ্যাদেশটি বহুলাংশেই দুর্বল, অপ্রচলিত ও অপ্রাসঙ্গিক। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, আজ স্বাস্থ্য খাতে দেশের মোট ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশই আসে জনগণের পকেট থেকে। এই বিশাল অংকের টাকা খরচ হয় ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনতে, ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে, আর বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে। দেশের মাটিতে বেশী টাকার বিনিময়ে কিছুটা ভালো চিকিৎসাসেবা পাওয়ার আশায়, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভিড় করে থাকেন ধনী জনগোষ্ঠী ছাড়াও মধ্যবিত্ত থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর অনেকেই যারা দেশের বাইরে যাওয়ার আর্থিক সঙ্গতি রাখেন না, বা অন্য কোনো কারণে যেতে পারেন না। তাই সঙ্গত কারণেই বেসরকারি হাসপাতালের মালিকপক্ষ অধ্যাদেশটি সংশোধন নিয়ে কথা বলবেন না। কারন সেটি সংশোধন হলে, রোগী বা চিকিৎসক সহ সকল স্বাস্থ্য কর্মীদের সুবিধা হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ব্যবসায় একটু হলেও সমস্যা হবে। যেমন, অধ্যাদেশ সংশোধনের কারনে জবাবদিহিতা বাড়লে নরমাল ডেলিভেরি না করিয়ে সিজারিয়ান সেকশন করা যাবে না, মৃত্যু পথযাত্রী রোগীদের জিম্মি করে হাসপাতালের বিল দ্বিগুন-তিনগুন করা যাবে না, চাপের মুখে ডাক্তারদের দিয়ে অনৈতিক কাজ করানো যাবে না, স্বাস্থ্য কর্মীদের চাকরি তোপের মুখে ফেলা যাবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। পরিতাপের বিষয় এই যে, ১৯৯১ সালের পর থেকে দেশে তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও স্বাস্থ্যখাতের মতো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং জনহিতকর খাতকে চরম অবহেলার শিকার হতে হয়েছে। একে সময় উপযোগী করে গড়ে না তোলার জবাবদিহিতার জায়গাটি হতাশাব্যঞ্জক। তবে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতালগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় এনে কার্যকরি চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা অবশ্যই সম্ভব।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে নতুন কোনো খবর নয়। এখানে চিকিৎসক-নার্সদের বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনগুলোর ভূমিকা সকল সময়েই প্রশ্নবিদ্ধ। তাছাড়া, আধুনিক টেকসই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ার ক্ষেত্রে সকল সংশোধনমূলক পদক্ষেপকে কোনো এক অদৃশ্য হাত সবসময়ই পিছনে টেনে ধরেছে। যার জন্য আজ এই দৈন্যদশা। কিন্তু, করোনা পরিস্থিতি আমাদের সবার মতো রাষ্ট্রেরও চোখ-কান খুলে দিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করছে। কাজেই এখনই সময় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে সম্পূর্ণরূপে ঢেলে সাজানোর। আমাদের দেশেরই অনেক মেধাবী ও দক্ষ বিশেষজ্ঞ আছেন, যারা অন্য দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আধুনিকীকরন করতে অনেক অবদান রেখে চলেছেন। সেইসব বিশেষজ্ঞদের একমঞ্চে দাঁড় করানো আজ সময়ের দাবি। দলীয় বিবেচনা নয়- বরং প্রমাণিত যোগ্যতা, দক্ষতা আর মেধা-ই হতে পারে বিশেষজ্ঞদের খুঁজে বের করা, আর দেশের সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর 'সক্ষমতার পরিমাপক'। আমাদের বিশ্বাস, সবাই এক সাথে মিলেমিশে দেশের জন্য তথা দেশের মানুষের স্বার্থে কাজ করলে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও সেবার মান যেকোনো মধ্যম আয়ের দেশের সমপর্যায়ে নেওয়া দু-এক বছরেই সম্ভব। শুধু দরকার সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি আর দুর্নীতির প্রতি বাস্তবিক অর্থে জিরো টলারেন্স।

এই ফোরামটি স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠিত, যা কোনভাবেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়। এখানে কোন রাজনৈতিক বক্তব্যও গ্রহণযোগ্য নয়। এর মূল লক্ষ্য হলো- "একটি জনমুখী, মানবিক, ও জবাবদিহিতামূলক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহযোগিতা করা, যেখানে মুনাফা নয় বরং প্রতিটি রোগী-চিকিৎসক-নার্সের অধিকার সংরক্ষিত থাকে সর্বজ্ঞে"। এখানে সদস্যদের শেয়ারকৃত একেকটি লেখা, ছবি, ভিডিও, বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় লাইভ ওয়েবিনার হবে অসাধু স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনার হাতিয়ার। দূর্নীতিবাজদের অপশক্তি আমাদের সম্মিলিত শক্তির কাছে কিছুই না। আমাদের মনে রাখতে হবে, নিরাপদ এবং মানসম্পন্ন চিকিৎসা পাওয়া কোন অনুগ্রহ নয় - এটা আমাদের অধিকার।

আমাদের এই ফোরামের বিশেষ উদ্দেশ্যসমূহ:

•বাংলাদেশের সকল নাগরিকের নিরাপদ ও মান সম্পন্ন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

•চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের সেবার মান উন্নয়নে অনুপ্রাণিত করা।

•স্বাস্থ্য অব্যবস্থাপনায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের আইনি সহায়তায় প্রদান করা।

•চিকিৎসা খাতে জাতীয় বাজেট বাড়িয়ে আধুনিক ও গবেষণামুখি চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

লেখক: ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার, কম্বোডিয়ায় দায়িত্বরত বিশ্ব ব্যাংকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মকর্তা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :