বৈশ্বিক মহামারিতে প্রবীণদের অবস্থা

সুব্রত বিশ্বাস (শুভ্র)
 | প্রকাশিত : ০১ অক্টোবর ২০২০, ০৮:৫১

বার্ধক্য প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। মানুষের জীবনে বার্ধক্যের বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু এই স্বাভাবিক নিয়ম কখনো কখনো মানুষের জীবনে বয়ে আনে অনেক দুঃখ-কষ্ট। সময় ও শারীরিক অবস্থার পাশাপাশি প্রবীণদের মানসিক পরিবর্তন স্বাভাবিক। এ সময় তাদের একাকিত্ব বেড়ে যায়। তাই এ সময়ে তাদের আশপাশের মানুষের উচিত পাশে থাকা, সাহায্যের হাত বাড়ানো। কিন্তু বর্তমানে বাস্তবতা হচ্ছে, অধিকাংশ প্রবীণ ব্যক্তিই অবহেলিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত এবং বৈষম্যের শিকার।

জাতিসংঘ বার্ধক্যকে মানবজীবনের প্রধানতম চ্যালেজ্ঞ হিসেবে উল্লেখ করে এ সমস্যা সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর ১ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালন করে আসছে। এ বছর প্রবীণ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- “চধহফবসরপং: উড় ঞযবু ঈযধহমব ঐড়ি ডব অফফৎবংং অমব ধহফ অমবরহম?’’ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাংলা প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘বৈশ্বিক মহামারির বার্তা, প্রবীণদের সেবায় নতুন মাত্রা।’

স্বাভাবিকভাবে ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষকে আমাদের দেশে প্রবীণ বলা হয়। বাংলাদেশে সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়স ৫৯ বছর। তবে বিচারপতিদের জন্য ৬৭ বছর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অন্য কোনো পেশাজীবীদের জন্য ৬৫ বছর। কারণ, এ বয়সের পর মানুষ দৈনন্দিন জীবিকা উপার্জনের কাজ থেকে অবসর নেয়। বিশ্বে উন্নত দেশগুলোতেও ৬০ বা ৬৫ বয়সের পর একজন মানুষকে প্রবীণ বা ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ প্রবীণ হবে। ২০৪৪ সালে যা কমবয়সী জনগোষ্ঠীকে ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে বর্তমানে বাস করছে প্রায় ১ কোটি ৪৫ লাখ প্রবীণ। ২০২৫ সালে এর সংখ্যা হবে প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ, ২০৫০ সালে প্রায় ৪ কোটি ৫০ লাখ এবং ২০৬১ সাল নাগাদ হবে প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা-প্রযুক্তি, জীবন-সচেতনতা এবং যাতায়াত-যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নয়নের ফলে মানুষের গড় আয়ুষ্কাল অনেক বেড়েছে এবং বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক প্রবীণ সেবার পরিধি অত্যন্ত সীমিত, বেসরকারি প্রবীণ নিবাসগুলোর অধিকাংশের অবস্থা শোচনীয়। বৈশ্বিক মহামারি দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রবীণদের জন্য প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য সেবা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারির সময় তাদের যথাযথ সুরক্ষা এবং সহায়তা প্রদান করা রাষ্ট্রীয় কর্তব্য।

বাংলাদেশের অনেক প্রবীণ নিজেদের সন্তান-সন্ততি কর্তৃক প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পিতামাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে জোর করে বৃদ্ধাশ্রমে বা অন্য কোথাও পাঠানো যাবে না মর্মে আইনের বিধানটিও লঙ্ঘিত হচ্ছে। জীবিকা নির্বাহের জন্য এখনো অনেক প্রবীণকে কোনো না কোনো ধরনের কায়িক পরিশ্রম করতে হয় এবং অনেক প্রবীণকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় নিদ্রায় যেতে হয়। তাদের প্রায় অর্ধেকেই কোনো না কোনো প্রকারের পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি এবং মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তির মধ্যে বিশাল সংখ্যক প্রবীণ এ ধরনের অবজ্ঞা, অবহেলা ও চিকিৎসার অভাবে প্রাণ হারিয়েছেন।

বাংলাদেশ সরকার, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফসহ বিভিন্ন সংগঠন করোনা দুর্যোগকালীন সময়ে প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত বিভিন্ন নিয়ম-নির্দেশনা জারি করেছেন যা অবশ্যই পালনীয়। মহামারি আক্রান্ত প্রায় ৮০ শতাংশ প্রবীণের বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবার প্রয়োজন হয়। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যাজমা ও ক্যানসার আক্রান্ত প্রবীণদের অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। করোনা আক্রান্ত অনেক প্রবীণ ব্যক্তিকে চিকিৎসার অভাবে অবহেলিত ও পরিত্যক্ত অবস্থায় দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। করোনা আক্রান্তদেরকে অবহেলা ও অবজ্ঞা করা মানবতার অবমাননার শামিল।

সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে প্রবীণরা আজ নিজ পরিবারেই তাদের সম্মান ও ক্ষমতা হারাচ্ছেন। বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে অসচ্ছল ও রোগাক্রান্ত প্রবীণরা মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন। তাদের মর্যাদাপূর্ণ, দারিদ্র্যমুক্ত, কর্মময় সুস্বাস্থ্য ও নিরাপদ সামাজিক জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং ভৌত-অবকাঠামোর প্রবীণবান্ধবকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আজকের নবীন আগামী দিনের প্রবীণ। বার্ধক্যের হাত থেকে বাঁচার কোনো সাধ্য না থাকার পরও নিজের বার্ধক্য সম্পর্কে কেউ জানতে চান না, মানতে চান না, ভাবতে চান না। পাশাপাশি প্রবীণদের কেউ দেখতে চান না, বুঝতে চান না, কাছে যেতে চান না, তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে চান না। প্রবীণদের কল্যাণে কাজ করতে বা অর্থ ব্যয় করতে কেউ আগ্রহী হন না। উন্নয়ন পরিকল্পনায় সরকারি কর্তৃপক্ষ অনেক সময় তাদের অধিকার সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকেন।

বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সবাই প্রবীণ। প্রবীণদের স্বস্তি, স্বাচ্ছন্দ্য, স্বাধীনতা, আত্মতৃপ্তি, সেবা, যতœ ও দেখাশোনার বিষয়টি আজ খুবই ঝুঁকির সম্মুখীন। তবে বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট প্রবীণবান্ধব। প্রবীণ নর-নারী জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের কিছু কার্যক্রম রয়েছে। সবচেয়ে বড় কার্যক্রমটি হচ্ছে বয়স্ক-ভাতা কার্যক্রম। যার আওতায় লক্ষ লক্ষ প্রবীণ নর-নারীকে মাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা দেয়া হচ্ছে।

সামাজিক সম্মানবোধ ও মানসিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে করুণা করে নয় বরং শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালোবাসা আর সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই সকল সন্তান তথা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রবীণদের সেবায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে হবে। অধিকারের প্রশ্নে নয়, বরং তাদের জীবনের শেষ ভাগ যেন সফল, সার্থক, স্বাচ্ছন্দ্যময় ও আপনজনের সান্নিধ্যে কাটে তা নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হতে হবে। কারও জীবনের শেষ সময়টা যেন পরিবারহীন বৃদ্ধাশ্রমে না কাটে। বৃদ্ধাশ্রম যেন কোনো বাবা-মায়ের শেষ বয়সের ঠিকানা না হয় এই হোক আগামীর অঙ্গীকার।

লেখক: কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :