বঙ্গবন্ধুর ভাবাদর্শে রবীন্দ্রনাথ ও জাতীয় সংগীত ইতিবৃত্ত

জাহাঙ্গীর আলম সরকার, পিপিএম
| আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২০, ১৩:৫৪ | প্রকাশিত : ২৮ ডিসেম্বর ২০২০, ১৫:০০

যেকোনো দেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিচয়বাহক জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত যতটা না ধর্মের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক সংস্কৃতির সঙ্গে। কেননা, একটি দেশের জাতিসত্তার সঙ্গে তার সংস্কৃতি যত বেশি সম্পৃক্ত, পৃথকভাবে ধর্মীয় অনুভূতির সম্পৃক্ততা এত বেশি পরিলক্ষিত হয় না। অন্তর্নিহিত বড় একটি কারণও রয়েছে। তা হলো, একটি দেশের সংস্কৃতি একাধিক ধর্মকে আশ্রয় দিতে পারে। ফলে সব ধর্মই সংস্কৃতিতে আশ্রিত হয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা রূপ লাভ করে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ফলে একটি দেশে একাধিক ধর্মের মানুষ একই রকম অধিকার নিয়ে, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে, নাগরিকত্ব নিয়ে স্বচ্ছন্দে বাস করতে পারে।

বিশ্বে এমন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব¡ কল্পনা করা সত্যিই কঠিন, যেখানে শুধু একটি ধর্মের মানুষ বাস করে। সংস্কৃতির এত বড় ক্যানভাসের মতো অন্তর্নিহিত মূল্যে ধর্মের ক্যানভাস বড় থাকলেও, দৃশ্যমান বাস্তবতায় একটি ধর্ম তার নিজস্ব অস্তিত্বের আমিত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে অন্য ধর্মকে আশ্রয় দেওয়ার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সেটি নিজের পরিপূরক হিসেবে কখনো দিতে সক্ষম হয় না। একই ধর্মের মানুষ বিশ্বের নানা রাষ্ট্রে বসবাস করে থাকে। ধর্মে যদি জাতীয় সঙ্গীতের বিষয়টি উল্লেখ থাকত, তাহলে এই বিষয়কে কেন্দ্র করে নানা রকম দ্বন্দ্ব-বিশৃঙ্খলাও দেখা দেওয়ার অবকাশ থাকত। কাজেই ধরে নেওয়া যায় জাতীয় সঙ্গীত বিষয়টি মূলত ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ নয়। একটি দেশের জাতীয় মূল্যবোধ তথা জাতিসত্তা এবং সে দেশের অভ্যন্তরে বিদ্যমান সামগ্রিক সংস্কৃতির চেতনা থেকে উৎসারিত হয় সে দেশের জাতীয় সঙ্গীত।

দেশপ্রেমের নিবিড় সম্পর্ক থাকায় একটি দেশে একাধিক জাতিসত্তার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হলেও সবাই মিলে জাতীয় সঙ্গীতকে সমভাবে সম্মান করতে শেখে। সংস্কৃতির ধর্মীয় অংশে দেশপ্রেমের প্রতি সব ধর্মই অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। যেমন ইসলাম ধর্মমতে দেশপ্রেমের মধ্যে ঈমানকে অঙ্গীভূত করা হয়েছে। আর ঈমান হলো এই ধর্মমতের মানুষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি আবশ্যকতা, যা না থাকলে এ ধর্মমতের মানুষ হিসেবে সে পরিপূর্ণ নয়।

বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের উপজীব্য উপকরণগুলো বিশ্লেষণ করলে তাতে নিখাদ দেশপ্রেম, মা-মাটি-মানুষ, ঋতুবৈচিত্র্য, প্রকৃতি, আকাশ-বাতাস থেকে শুরু করে নানারকম সুন্দরের সমাবেশ সন্নিবেশিত হয়ে বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যের মহিমা প্রকাশ পেয়েছে। এর সৃষ্টিকাল ১৯০৫ সালে। শব্দচয়ন ও ভাষাশৈলীর কোথাও বিন্দুমাত্র সাম্প্রদায়িকতার কোনো গন্ধ নেই। প্রকৃতির এমন শোভা ও সৌন্দর্য প্রকাশ এবং বাংলা সংস্কৃতির অনন্য উপস্থাপনে আর কোনো বাংলা গান খুব একটা পাওয়া যায় না। কাছাকাছি অনুভূতিকে নাড়া দিয়ে যায় আরেকটি গান যেমন রয়েছে তা হল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের- 'ধনধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা'।

আমরা অনেকেই জানি না, আমাদের জাতির পিতার অন্তরে এ দুটি গান কত বেশি সমাদৃত ছিল। তিনি নিজে যেমন গুন গুন করে গাইতেন, তেমনি সুযোগ পেলেই চেতনা নির্মাণের মন্ত্র হিসেবে শিল্পীদের এই গানটি পরিবেশনে অনুপ্রাণিত করতেন। তাঁর এই চেতনার প্রকাশ মেলে বাংলাদেশ জন্মেরও বহু আগে।মূলত তাঁর চিন্তা, চেতনা ও দর্শনের সাথে একাকার হয়ে যে সময়কাল বা দিনক্ষণটিতে 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটি মিশে একাত্ম হয়ে গিয়েছে, ঠিক সেই দিনেই আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের উন্মেষ ঘটেছে। যদিও তা বাংলাদেশ-উত্তর আনুষ্ঠানিক জাতীয় সঙ্গীত ঘোষণার অনেক আগের ঘটনা। এ প্রসঙ্গে জাতির পিতার স্বরাজ উচ্চারণ ছিল- 'এই সঞ্চয়িতা সঙ্গে থাকলে আমি আর কিছুই চাই না। নাটক নয়, উপন্যাস নয়, কবিগুরুর গান ও কবিতাই আমার বেশি প্রিয়। সব মিলিয়ে এগারো বছর কাটিয়েছি জেলে। আমার সব সময়ের সঙ্গী ছিল এই সঞ্চয়িতা। কবিতার পর কবিতা পড়তাম আর মুখস্থ করতাম। এখনও ভুলে যাইনি। এই প্রথম মিয়ানওয়ালি জেলের ন’মাস সঞ্চয়িতা সঙ্গে ছিল না। বড় কষ্ট পেয়েছি। আমার একটি প্রিয় গানকেই “আমার সোনার বাংলা” আমি স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত করেছি। আর হ্যাঁ, আমার আর একটি প্রিয় গান ডি এল রায়ের “ধন ধান্য পুষ্প ভরা”। দুটি গানই আমি কাজের ফাঁকে গুনগুন করে গেয়ে থাকি।’

স্মরণ রাখা দরকার, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন বাস্তবতায় এই গানটি নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে প্রতিভাত হয়েছিল সব যোদ্ধার প্রাণে প্রাণে। সাহসী ও অনুপ্রাণিত করেছিল যুদ্ধের ময়দানে অংশগ্রহণকারী, আত্মদানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের। শক্তি, চেতনা ও অনুপ্রেরণার ক্ষেত্রে লোকজ বাঊল সুরের এই গানটি বাংলার সব বর্তমানে সমসাময়িক হয়ে একই রকম আবেদন নিয়ে প্রাণ সঞ্চার করেছে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের অতীত প্রেক্ষাপটে। তেমনি করে ভবিষ্যতের যেকোনো বর্তমানের প্রয়োজনে অসীম শক্তিমত্তা প্রদর্শন করবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধেও। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মূল বিশেষত্ব ঠিক এখানেই। বাঙালির প্রাণের কবি হিসাবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিশেষত্বে তিনি অবিকল্প, সফল ও সার্থক কবি। এখানেই তাঁর বাংলা জয়।

‘আমার সোনার বাংলা’ রচনাকালের বেশ আগে কবিগুরু বাংলার বাঊল সুরের সঙ্গে বেশ পরিচিত করেছেন নিজেকে। জাতীয় সংগীতকে অমরত্ব দিয়েছে নিখাদ বাংলা মাটির বাঊল সুর। গগন হরকরা, লালন সাঁইজিসহ অনেকের বাঊলগানই কবিগুরুকে বিমোহিত করেছে যার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় কিছু কিছু রবীন্দ্রসংগীতের সুরের মাঝে। লোকজ বাঊল সুরের মার্গীয় প্রভাব রয়েছে আমাদের জাতীয় সংগীতে।

যুগে যুগে রবীন্দ্রবিদ্বেষী ছিল, আছে, থাকবে। তাদের কাছে এখন শুনতে হয় কেন রবীন্দ্রসঙ্গীত এ দেশের জাতীয় সঙ্গীত হবে? জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে নানারকম বিদ্রƒপাত্মক কথাবার্তা, অসংলগ্ন সাম্প্রদায়িক বক্তব্য তারা দীর্ঘকাল দিয়ে আসছে। একটু পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এই শ্রেণির মানুষের এমন মানসিকতা সেই পাকিস্তানি মনস্তত্ত্ব থেকে উৎসারিত ও উচ্চারিত হয়েছে। শুধু জাতীয় সঙ্গীত নয়, তাদের মনস্তত্ত্বে বাংলার যেকোনো সঙ্গীত তথা বাঙালির চেতনা উৎসারিত মূল সংস্কৃতির সবটুকুই অপছন্দের। বলে রাখা দরকার, বাংলা সংস্কৃতি এতটাই ঋদ্ধ যে কারো অপছন্দতে এ সংস্কৃতির কিছু যায় আসে না।

উৎসমূলে আলোচনায় গেলে বাঙালি এবং বাংলা ভাষার শক্তিমত্তার যে রক্তঝরা ইতিহাস ১৯৫২ সালে পাকিস্তানিরা প্রত্যক্ষ করেছিল, সেখানটাতে উচিত শিক্ষা পেয়ে চলমান কৌশলের সাথে বুদ্ধিদীপ্ত কূটকৌশল সংযোজন করার প্রয়াস চালিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদীয়মান তেজোদীপ্ত রাজনীতিকে তথা বাংলাদেশের জন্মস্বপ্নকে ধূলিসাৎ করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসাহিত্য নিষিদ্ধ করার বিষয়কে কূটকৌশল হিসেবে গ্রহণ করে। তারা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন শুধু জেলে পুরে বঙ্গবন্ধুকে দাবিয়ে রাখা সম্ভব নয়। জেল-জুলুমের সঙ্গে চেতনার মৃত্যু ঘটানো সম্ভব হলে শেখ মুজিবকে রুখে দেয়া সম্ভব হবে। কেবল তখনই বাংলাদেশ জন্মের স্বপ্নভঙ্গ সম্ভব। অর্থাৎ রবীন্দ্রসাহিত্য ও সঙ্গীতকে বঙ্গবন্ধু থেকে আলাদা করতে হবে। জাতির পিতা বিষয়টি অনুধাবন করে ১ জানুয়ারি ১৯৭১ তারিখে আরেকটি ভাষণে বলেন,

“বাংলা ভাষা ও বঙ্গ সংহতিকে ধ্বংস করার জন্যে জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরো স্থাপন করা হয়েছে। পাকিস্তান বেতার এবং টেলিভিশনও এই ষড়যন্ত্রের দোসর। তারা রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিল এবং আজও এ ব্যাপারে উঁচু মহলে জোর আপত্তি রয়েছে। জনগণ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এই চক্রান্ত সহ্য করবে না। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যেসব বাঙালি সরকারি সমর্থন পেয়েছেন, তাঁদের দিন আজ শেষ।” শুধু তাই নয় সাম্প্রদায়িক এ মন্ত্রে বাংলার মানুষ যারা দীক্ষিত হবে তারা বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে দূরে সরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধেই অবস্থান নেবে এটাই তাদের কূটকৌশলের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ছিল। যার বাস্তব উদাহরণ আমরা দেখতে পাই পাকিস্তানি কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে রবীন্দ্রনাথের 'সঞ্চয়িতা' বইটি সঙ্গী হিসেবে অনুমোদন না দিয়ে তা রেখে দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে এক ভাষণে বলেন,

“জ্ঞান আহরণের পথে এই সরকার যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিয়াছেন যার নজির বিশ্বে বিরল। আমরা মীর্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপিয়ার, এরিস্টটল, ডান্তে, লেনিন, মাও সে তুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য, আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করিয়া দিয়াছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙ্গালী কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখিয়া যিনি বিশ্বকবি হইয়াছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি না। আমরা রবীন্দ্রনাথ পড়িবই, আমরা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাহিবই এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত এই দেশে গাওয়া হইবেই। আমি রেডিও এবং টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপর হইতে সবপ্রকার বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করিয়া অবিলম্বে পর্যাপ্ত পরিমাণে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারের দাবী জানাই।” (স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, মুনতাসীর মামুন, মো. মাহবুবুর রহমান)

বাংলা ভাষার জাদুকরী শক্তি এবং মার্গীয় উচ্চতা বিশ্বব্যাপী সেদিনই অনুভব করে, যখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে ভাষা সাহিত্যে নোবেল পেলেন। সম্ভবত পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীরা এবং পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি তখন থেকেই বাংলা ভাষার গলা টিপে ধরার সংকল্প শুরু করে, যার চূড়ান্ত রূপ প্রদর্শিত হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে। তদানীন্তন অবিভক্ত পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ছাত্র সমাবেশে ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হঠাৎ এমন একটি ঘোষণা করলে বাংলার ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং সেখানেই তার প্রতিবাদ জানানো হয়। ভাষা রক্ষার আন্দোলন বেগবান হতে থাকলে পাকিস্তানি শাসকরা বুলেট ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের বাঙালি ছাত্র-জনতার প্রাণের দাবি বাংলা ভাষা আন্দোলনের মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ইতিহাসের জঘন্যতম অধ্যায়টির জন্ম দেয় পাকিস্তান। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ বেশ কয়েকজন ভাষাসৈনিককে প্রাণ দিতে হয়েছে বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য। তাদের এই আত্মত্যাগ যেমন বাংলা ভাষাকে রক্ষা করেছে তেমনি বাংলাদেশ জন্মের স্বপ্নকে বাস্তবসম্মত করেছে। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো।

বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে জেল-জুলুম, অত্যাচার অব্যাহত রেখে বঙ্গবন্ধুর অপ্রতিরোধ্য গতিকে আটকে দেওয়ার লক্ষ্যে নতুন কূটকৌশলের অংশ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ তথা রবীন্দ্রসাহিত্য নিষিদ্ধ করার অপপ্রয়াস চালানো হয়। বাংলাদেশের এক শ্রেণির মানুষ পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির মানসিকতার সঙ্গে একমত পোষণ করে বাংলাদেশ জন্মের বিরোধিতা করেছে এবং এই শ্রেণির মানুষের বেশির ভাগই ছিল তথাকথিত ধর্মাশ্রয়ী মানুষ। তাদের আরও বেশি সোচ্চার করার লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য অনুশীলনকে তাদের ধর্মীয় রীতির বিপরীতে দাঁড় করিয়ে বাংলাদেশের এই শ্রেণির মানুষের মগজ ধোলাই করেছিলেন বেশ শক্ত করেই। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিখাদ হিন্দু বলার সুযোগ নেই, কেননা তিনি পারিবারিকভাবেই ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী ছিলেন, ধর্মবিশ্বাস মতে যা একেশ্বরবাদী। পাকিস্তানি মস্তিষ্কজাত ঠিক সেই মানসিকতার পরম্পরা বাংলাদেশের একটি বিশেষ শ্রেণিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে এখনো বিদ্যমান রয়েছে, যার ফলে আমরা দেখতে পাই আমাদের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে তাদের নানারকম কটাক্ষ, বিদ্রুপাত্মক ব্যবহার এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ। মূলত বাংলা সংস্কৃতিকেই তারা বিজাতীয় সংস্কৃতি বলে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্ত ছড়িয়ে চলেছেন আজও পর্যন্ত।

ধর্মনিরপেক্ষতার মন্ত্রে দীক্ষিত অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বিনষ্ট করে, সাধারণ মানুষকে সার্বক্ষণিক সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা দ্বারা পরিচালিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যারা বিশ্বাস করে না, ওই সব পাকিস্তানি ভাবধারার মানুষ নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের মনে রাখা দরকার ধর্মকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ লেগে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি, বরং নানা রকম জুলুম-অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনা, গঞ্জনার মতো অধর্ম থেকে মুক্তি পাবার লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে অনিবার্য কারণে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। এটি মোটেও ধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মের যুদ্ধ ছিল না। বাঙালি সংস্কৃতিকে গলাটিপে ধ্বংস করে বাংলা ভাষাভাষি মানুষের মধ্যে পাকিস্তানের সংস্কৃতিকে পরিপূর্ণ রূপে চালু করার যে অপচেষ্টা যুগ যুগ ধরে চলে আসছিল, তা রুখে দিয়ে বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতিকে বাংলার একান্ত সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জন্ম দেন। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অত্যাচার, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যতটা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য অন্তর্নিহিত ছিল, একই ধারায় সাংস্কৃতিক মুক্তির চেতনাও সমভাবে নিহিত ছিল।

লেখক: পুলিশ সুপার। গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :