ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে (পর্ব-৫)


ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া
  প্রকাশিত : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৮:২৭
অ- অ+

তো গত পর্বে স্বরবৃত্ত ছন্দের উদাহরণ নিয়ে বলবো বলে যেমনটা বলেছিলাম। স্বরবৃত্ত ছন্দ মূলত: ছড়ার ছন্দ। ছড়া আসলে পদ্য অর্থাৎ ‘কবিতা’র গুণগত মানের কঠিন বিচারে উচ্চ মার্গের কবিতা না। ছড়ার রয়েছে প্রায় দেড়হাজার বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস। সেগুলো লিখা হয়ে থাকে সাধারণত: স্বরবৃত্ত ছন্দে। ছড়া মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত ঝংকারময় পদ্য। এটি সাহিত্যের একটি প্রচীন শাখা। ‘ছেলেভুলানো ছড়া’, ‘ঘুম পাড়ানি ছড়া’ ইত্যাদি শিশুতোষ প দীর্ঘকাল যাবৎ প্রচলিত। যেমন;

‘খোকন খোকন ডাক পাড়ি,

খোকন মোদের কার বাড়ী?

আয় রে খোকন ঘরে আয়,

দুধ মাখা ভাত কাকে খায়।’

কিংবা;

হাট্টি মাটিম টিম,

তারা মাঠে পাড়ে ডিম

তাদের খাড়া দুটো শিং,

তারা হাট্টি মাটিম টিম।

অথবা;

দোল দোল দুলুনি,

রাঙা মাথায় চিরুণী।

বর আসবে যখনি,

নিয়ে যাবে তখনি।

কিংবা,

‘খোকা ঘুমোল পাড়া জুড়োল,

বর্গী এলো দেশে;

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে,

খাজনা দিব কিসে?

ধান ফুরুল, পান ফুরুল,

খাজনার উপায় কি?

আর ক'টা দিন সবুর কর,

রসুন বুনেছি।’

অথবা;

‘ঘুম পাড়ানী মাসি পিসী,

মোদের বাড়ি এস,

জলপিঁড়ি দেব তোমায়,

পা ধুয়ে বস।

চাল কড়াই ভাজা দেব,

গাল ভরে খেও,

খুকুর চোখে ঘুম নাই,

ঘুম দিয়ে যেও।’

কিংবা,

‘তাই তাই তাই,

মামা বাড়ি যাই,

মামা দিল দুধ ভাত,

পেট ভরে খাই;

মামী এলো লাঠি নিয়ে;

পালাই পালাই!’

অথবা,

‘আয় আয় চাঁদমামা,

টিপ দিয়ে যা,

চাঁদের কপালে চাঁদ,

টিপ দিয়ে যা।

মাছ কুটলে মুড়ো দেবো,

ধান ভানলে কুঁড়ো দেবো,

সোনার থালে ভাত দেবো,

রাজার মেয়ে বিয়ে দেবো-

চাঁদের কপালে চাঁদ,

টিপ দিয়ে যা!’

কিংবা,

‘কে বকেছে, কে মেরেছে,

কে দিয়েছে গাল?

তাইতো খোকা রাগ করেছে,

ভাত খায়নি কাল।’

অথবা;

‘নোটন নোটন পায়রাগুলো

ঝোটন বেঁধেছে,

ও পাড়েতে দুটি মেয়ে

নাইতে নেমেছে,

সরু সরু চুলগুলো

ঝাড়তে লেগেছে,

কে দেখেছে-কে দেখেছে?

দাদা দেখেছে।

দাদার হাতের কলম ছিল,

ছুড়ে মেরেছে-

উফফ বড্ড লেগেছে!’

প্রাচীনকাল থেকে ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষায়ও ‘ননসেন্স রাইম' প্রচলিত রয়েছে। কথ্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে এর বিশেষ সঙ্গতি। ভাষার অর্থবোধকতা আর ভাবের গভীরতার চেয়ে সেগুলোতে প্রাধান্য পায় ধ্বনি-মাধুর্য।কারণ ছড়ার প্রধান দাবী যতোটা ধ্বনিময়তা ও সুরঝংকার, অর্থময়তা ততোটা নয়। যেমন; ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত’র ‘দূরের পাল্লা’ ছড়াটিঃ

‘ছিপখান তিন-দাঁড়

তিনজন মাল্লা

চৌপর দিন-ভোর

দ্যায় দূর-পাল্লা!

পাড়ময় ঝোপঝাড়

জঙ্গল-জঞ্জাল,

জলময় শৈবাল

পান্নার টাঁকশাল |

কঞ্চির তীর-ঘর

ঐ-চর জাগছে,

বন-হাঁস ডিম তার

শ্যাওলায় ঢাকছে|

চুপ চুপ - ওই ডুব

দ্যায় পান্ কৌটি

দ্যায় ডুব টুপ টুপ

ঘোমটার বৌটি!

ঝকঝক কলসীর

বক্ বক্ শোন্ গো

ঘোমটার ফাঁক বয়

মন উন্মন গো|

তিন-দাঁড় ছিপখান

মন্থর যাচ্ছে,

তিনজন মাল্লায়

কোন গান গাচ্ছে?...'

তবে সে কথাও সত্য যে, নিগূঢ় অর্থবোধক ছড়া কখনো কখনো কবিতা'র আবেদনকে ছাড়িয়ে যাবার এন্তার দৃষ্টান্তও রয়েছে। যেমন ধরা যাক অন্নদাশঙ্কর রায়’র ‘খুকু ও খোকা’ ছড়াটিঃ

‘তেলের শিশি ভাঙলো বলে

খুকুর পরে রাগ করো,

তোমরা যে সব বুড়ো খোকা

ভারত ভেঙে ভাগ করো;

তার বেলা!

সামান্য তেলের শিশি ভাঙার ঘটনা কেমন করে হয়ে দাঁড়ালো দেশভাগের এক প্রতিবাদী কবিতা--এই ছড়াটা তার প্রকৃষ্ট উদাহরাণ। অবশ্য এখনো অনেকেই ছড়াসাহিত্যকে শিশুসাহিত্যেরই একটি শাখা মনে করেন কিংবা ছড়াকে সাহিত্যের মূলধারায় স্বীকৃতি দিতে চান না। তবে পদ্য (কবিতা) এবং ছড়ার মধ্যে মূল পার্থক্য হলো পদ্যের বক্তব্য সহজবোধ্য ও স্পষ্ট হলেও, ছড়ায় রহস্যময়তা থাকে।

আদিতে সাহিত্য রচিত হতো মুখে মুখে। ছড়াই ছিল সাহিত্যের প্রথম শাখা বা সৃষ্টি। লোকসমাজে ‘ছড়া’ই ছিল ভাবপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম।গদ্যসাহিত্যের আগে তাই কেউ কেউ ছড়াকে লৌকিক সাহিত্য বলে বিবেচনা করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন—'ছড়া শিশুদের খেলামেলার কাব্য'। ছড়াপ্রসঙ্গে কবিগুরুর ভাষ্য এরকম, ‘সুদূর কাল থেকে আজ পর্যন্ত এই কাব্য (ছড়া) যারা আউড়িয়েছে এবং যারা শুনেছে তারা অর্থেও অতীত রস পেয়েছে। ছন্দতে ছবিতে মিলে একটা মোহ এনেছে তাদের মধ্যে। সেইজন্য অনেক নামজাদা কবিতার চেয়ে এর (ছড়া) আয়ু বেড়ে চলেছে।' যাক,সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

স্বরবৃত্ত ছন্দের ৩টি উদাহরণ দেখা যাক:

এক.
বাঁশ বাগানের ∣ মাথার উপর ∣ চাঁদ উঠেছে ∣ ওই ∣∣ (৪+৪+৪+১)
মাগো আমার ∣ শোলোক বলা ∣ কাজলা দিদি ∣ কই ∣∣ (৪+৪+৪+১)
প্রতি পংক্তিতে চার মাত্রার তিনটি করে পূর্ণপর্ব ও একমাত্রার একটি করে পূর্ণ পর্ব রয়েছে। লয়- দ্রুত ।
দুই.

পাতাল ফেড়ে ∣ নামব নীচে, ∣ ওঠব আবার∣ আকাশ ফুঁড়েঃ
বিশ্ব-জগৎ∣ দেখব আমি∣ আপন হাতের∣ মুঠোয় পুরে।।
মাত্রাবিন্যাস ৪+৪+৪+৪ । প্র তি পংক্তিতে চার মাত্রার চারটি করে পূর্ণ পর্ব রয়েছে। লয়- দ্রুত ।
তিন.
মামার বাড়ি ∣ আর যাবো না ∣ আর খাবো না ∣ মামীর গাল, ৪ + ৪ + ৪ + ৩
কথায় কথায় ∣ আমার পিঠে ∣ পড়বে না আর ∣ অমন তাল।৪ + ৪ + ৪ + ৩
সকাল বেলা ∣ জেগে আমি ∣ তাই তো গেলাম ∣ মায়ের ঘর, ৪ + ৪ + ৪ + ৩
“ভায়ের বাড়ি ∣ যাওগে একা ∣ আমার গায়ে ∣ ভীষণ জ্বর।” ৪ + ৪ + ৪ + ৩
তাহলে স্বরবৃত্ত ছন্দের এই কবিতাটির কাঠামো দাঁড়াচ্ছে : ৪ + ৪ + ৪ + ৩

স্বরবৃত্ত ছন্দে লিখা হয়েছে অসংখ্য কবিতা। নিচে অল্প ক'টি কবিতার উল্লেখ করা হলোঃ

কাজলা দিদি (যতীন্দ্র মোহন বাগচী), ফাঁকি (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), সংকল্প (কাজী নজরুল ঈসলাম), আসমানী (জসিম উদ্দিন), তোরা সব জয়ধ্বনি কর, (কাজী নজরুল ইসলাম) , ধন ধান্য পুষ্প ভরা (দ্বিজেন্দ্রলাল রায়), সবার আমি ছাত্র (সুনির্মল বসু), পাখির মতো (আল মাহমুদ), বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), প্রেমের কবিতা (শামসুর রাহমান), গরুর গাড়ি (সুলতান আহমাদ), মে দিবসের কবিতা (সুভাষ মুখোপাধ্যায়), আশার আলো ( নেয়ামত ভূঁইয়া)।

তাহলে কি এ পর্বের উপসংহারে স্বরবৃত্ত ছন্দের মোদ্দা কথাটা আবার বলে নেবো! এ ছন্দ ছড়ার ছন্দ বলে পরিচিত। সাধারণত: এর মূল পর্বে চারমাত্রা। অপর পর্ব/ পর্বগুলো চারমাত্রার বা তারও কম হতে পারে। চার বা তারচে কমমাত্রার ছন্দ মানেই চটুল ছন্দ, দ্রুততাল বা দ্রুতলয়ী। এই বৃত্তের পদ্যে একই পঙক্তিতে (আগেই বলেছি, পঙক্তি আর চরণ এক নয় কিন্তু) প্রতিটি পর্ব হয় সমমাত্রার। এর বাইরে গেলে তা ছড়ার দ্রুত বা চটুল তাল ছাড়িয়ে মধ্যলয় বা ধীরতালের দিকেই ছুটবে।আর আসল কথাটাতো আমরা নিশ্চয়ই ভুলিনিঃ এ ছন্দে মুক্তস্বর/ মুক্তাক্ষর এবং বদ্ধস্বর/রুদ্ধাক্ষর/বদ্ধাক্ষর প্রতিটা অবশ্যই হবে এমমাত্রা।

পরবর্তী পর্বে মাত্রাবৃত্ত ছন্দ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। তখন স্বরবৃত্তের সঙ্গে মাত্রাবৃত্তের ফারাকটা আরো স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে আশা করি।/চলে...

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
গাজায় ত্রাণপ্রার্থীসহ আরও ৮৬ জনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল বাহিনী
দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রসহ বৃষ্টির পূর্বাভাস, তাপমাত্রা কমতে পারে
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা মূল্যায়ন: বোমা হামলা ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ধ্বংস করতে পারেনি
ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া না করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, বুঝবেন যেভাবে
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা