পুঁ জি বা জা র

দেশ-বিদেশের বড় কোম্পানিগুলো যুক্ত হলে পুঁজিবাজারের কলেবর বাড়বে

অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান
 | প্রকাশিত : ২৩ জানুয়ারি ২০২২, ১১:২৬

২০২০ সালের মার্চে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত শুরু হয়। তখন থেকে আমরা সামগ্রিকভাবে করোনা মোকাবিলা করে আসছি। করোনা শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে থেকেই ক্যাপিটাল মার্কেটের লেনদেন কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল। যদিও একটি উদার এবং মুক্ত অর্থনীতিতে পুঁজিবাজার বন্ধ থাকাটা খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার। এটার কারণে পুঁজিবাজার বা দেশের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে একটা নেতিবাচক মেসেজ প্রদান করে। ঠিক এমন অবস্থার মধ্যে আমরা করোনার মধ্যে পড়ি। একজন বিজনেসের ছাত্র বা শিক্ষক হিসেবেই হোক আমরা একটু শঙ্কিত হয়েছিলাম। এই অবস্থাটি কত দিন চলতে থাকবে? অবশ্য আমরা এর কিছুদিন পরই দেখলাম প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামকে নিয়োগ দেন। উনি নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে পুঁজিবাজারকে একটি ট্র্যাকে নিয়ে আসার কার্যক্রম গ্রহণ করেন।

করোনার কারণে অর্থনৈতিকভাবে সব দেশই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশের অর্থনীতি করোনার কারণে কিন্তু কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর কারণ হলো, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে তাৎক্ষণিক কৃষি, গার্মেন্ট খাতসহ ক্ষতিগ্রস্ত খাতে সরকার প্রণোদনা দিয়েছে। এর ফলে অর্থনীতির চাকা কিছুটা হলেও সচল রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।

কিছু বিষয় ছিল আমার কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। যেমন আমাদের গার্মেন্টশিল্প কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পলিসি মেকিংয়ের কারণে সেটা আর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এছাড়া আমাদের যেসব লোক বাইরে থাকে তাদের মধ্যে কিছু এক্সিকিউটিভ তো আছে, আর আমাদের যারা মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন তাদের অনেকেই শ্রমিক শ্রেণির। যেকোনো পরিস্থিতিতে তাদের শ্রমের বিকল্প নেই। করোনায় বিদেশ থেকে যে পরিমাণ শ্রমিক ফেরত আসবেন বলে মনে হয়েছিল সেটা কিন্তু হয়নি। তবে শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে, এই আতঙ্কে ছিলেন। তারা ফলে ওই দেশে তাদের যে সঞ্চিত টাকা ছিল, তারা সেগুলো দেশে পাঠিয়েছেন। এটা একটা ইতিবাচক দিক ছিল।

আরেকটা দিক ছিল আমাদের পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতের কিন্তু বাংলাদেশ থেকে তাদের ফিফথ লার্জেস্ট আর্নিং আসে। সরকারি হিসাবে আমাদের ঘাটতির পরিমাণ ৬ বা ৭ বিলিয়ন ডলারের মতো। তো এটার বাইরেও যেটা ছিল ইন্ডিয়ার অনেক শ্রমিক বাংলাদেশে কাজ করতেন, তারা আসতেন ট্যুরিস্ট ভিসায়। বাংলাদেশের একটা বিরাট অংশ বলা হচ্ছে ২১ থেকে ২৫ লাখ লোক চিকিৎসার জন্য ভারতে যেত। তারা ফরমাল চ্যানেলে কী পরিমাণ টাকা খরচ করতেন, এর হিসাব হয়তো আছে। কিন্তু এর বাইরেও যে ইনফরমাল চ্যানেলে যে টাকা ভারতে গেছে, এর হিসাব কিন্তু আমাদের কাছে নেই। ফলে ইন্ডিয়ার সঙ্গে আমাদের যে বাইলিটারেল ট্রেড, সেখানে করোনার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত তো হইনি বরং আমাদের ব্যাপক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। টাকাটা রাখতে পেরেছি। সেটা একটা পজিটিভ দিক।

বাংলাদেশের আরেকটা পজিটিভ দিক হলো কৃষিতে। যেহেতু আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম, ফলে আমাদের হয়তো জীবনযাত্রা কিছুটা ব্যাহত হয়েছে, সামগ্রিকভাবে আমরা কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হইনি। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি।

শিবলী রুবাইয়াত সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের দায়িত্ব নিয়ে যুগান্তকারী কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে- প্রবাসীদের প্রতি তিনি একটা উদাত্ত আহ্বান করলেন আপনারা টাকা দেশে নিয়ে আসেন। তাদের একটা অংশ দেশে টাকা এনেছে। অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, আমাদের অর্থনীতিতে কালোটাকার প্রাধান্য আছে। এছাড়া যে টাকাগুলো ফরমাল চ্যানেলে ছিল না, ওনার প্রতি জনগণের আস্থা ছিল বলে ওই টাকাগুলো ফরমাল চ্যানেলে এসেছে। যেটা দিয়ে আমাদের জিডিপি বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আবার দেশের মধ্যে কিছু দুষ্ট লোক বাইরে টাকা পাচার করেছিল। কী পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে, সেটা এখনো জানা সম্ভব হয়নি। তবে সেই টাকাগুলোর একটা বড় অংশ পুঁজিবাজারে আনতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। আমাদের পুঁজিবাজারটা ছিল শুধু স্টক-বেইজড এবং শেয়ার-বেইজড। তিনি যে পদক্ষেপটা নিয়েছিলেন, এই মার্কেটটাকে ভালো একটা পোর্টফোলিও তৈরি করা। সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে উনি বন্ডের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছেন। ফিক্সড ইনকাম সিকিউরিটিজের ব্যাপারেও ওনার সিদ্ধান্তগুলো আছে এবং ডেরেভেটিভ প্রোডাক্ট এই ক্যাপিটাল মার্কেটে কীভাবে যোগ করা যায়, সে ব্যাপারেও তার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।

একই সময়ে আমরা দেখেছি যে, সুদূর অতীতে কয়েকটা ভালো কোম্পানি বাদ দিয়ে বাকি কোম্পানিগুলোর পুঁজিবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে তাদের টাকা সংগ্রহ করার একটা প্রবণতা ছিল। সামগ্রিকভাবে বা মোটাদাগে যদি বলতে হয়, এই কোম্পানিগুলো মার্কেটে আসার আগে তাদের পারফরম্যান্স ভালো থাকে, মার্কেটে আসার পর এক-দুই বছর পর তাদের দাম ব্যাপকভাবে কমে যায় এবং তাদের পারফরম্যান্স একেবারেই কম। আল্টিমেটলি এই টাকাগুলো তারা বাজার থেকে নিয়ে যেত সুকৌশলে। বর্তমান কমিশনের কাছে এটা দৃশ্যমান ছিল। পরে তারা আইপিওতে অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হলো। শুধু ভালো কোম্পানিগুলো যাতে এখানে আসতে পারে সেই কাজটা করেছে।

তার মধ্যে একটা ভালো কোম্পানি রবি, ওয়ালটন। এ রকম আরও কিছু কোম্পানি যোগ হয়েছে। হয়তো তুলনামূলক দু-একটা কম শক্তিশালী কোম্পানি এসেছে, তবে এর ফলে মার্কেটে যেটা হয়েছে মার্কেটের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কেটের ক্যাপিটালাইজেশন বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কেটের ওপর জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ভালো ভালো কোম্পানিগুলো যখন মার্কেটে এনলিস্টেড হচ্ছে, তখন তাদের অপারেটিং প্রফিট যেহেতু ভালো তারা ভালো ডিভিডেন্ট, ভালো ডিক্লারেশন শেয়ারহোল্ডারদের জন্য দিচ্ছে। এটার কারণে যেটা হয়েছে, সুদূর অতীতে মার্কেট যে আন্ডারভ্যালু ছিল, সেই জায়গা থেকে মার্কেটটাকে একটা নরমাল অবস্থানে আনা সম্ভব হয়েছে। কিছু কিছু সমালোচকের দৃষ্টিতে সমালোচনা থাকবেই। সমালোচনা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। গঠনমূলক সমালোচনাকে আমরাও গ্রহণ করব। তারা হয়তো বলছে মার্কেট অতি মূল্যায়িত হয়েছে, আসলে কিন্তু মার্কেটের বটম লাইনটাই ছিল অনেক নিচে, এই প্রাসপেক্টিভ অনেকের নেই। আমরা বলছি মার্কেট অনেক আন্ডারভ্যালুড ছিল সেই জায়গা থেকে একটা নরমাল অবস্থানে এসেছে। মাঝেমধ্যে এখনো এক-দুই সপ্তাহ ধরে কারেকশন হচ্ছে। আবার ঠিক হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কমিশন তাদের আইনেরও কিছু পরিবর্তন করেছে। আমরা দেখেছি সব লিস্টেড কোম্পানির ক্ষেত্রে ডাইরেক্টরদের শেয়ার হোল্ডিংয়ের কথা ছিল ৩০ ভাগ, অনেক কোম্পানির এটা ছিল না। এই কমিশন যেটা করেছে, তাদের চিঠি দিয়ে সতর্ক করে অল্প অল্প করে ফাইনের মাধ্যমে

কম্প্লায়েন্সের মাত্রাটা বাড়াচ্ছে। কেন আইনটা করা হয়েছে, যারা স্পন্সর ডিরেক্টর তারাই যদি একটা কোম্পানির ৩০ ভাগ শেয়ারের মালিক থাকে, তখন তাদেরও একটা ইন্টারেস্ট থাকে, কোম্পানিকে তার যদি অতিরিক্ত ১০০ টাকা বেশি লাভ করাতে পারে, তার ৩০ ভাগ সে পাবে। আর যখন স্পন্সর শেয়ার থার্টির কম থাকে, ৫ ভাগ বা ১০ ভাগ থাকে, তখন তাদের লুটপাটের প্রবণতা বেশি থাকবে।

ইনস্যুরেন্সের বেলায় আপনারা জানেন, অনেকবার আইন করা হয়েছে, তাদের ইদরা থেকে বারবার বলা হচ্ছে তাদের ৬০ ভাগ শেয়ার হোল্ডিং থাকার কথা। কিন্তু অনেক কোম্পানির ৩০ ভাগও ছিল না বা ৩০ ভাগ ছিল। দু-একটা কোম্পানি ছাড়া বেশির ভাগ কোম্পানিকে তাগিদ দেওয়ার ফলে তারা তাদের এই হোল্ডিংটা কিন্তু বাড়াচ্ছে। তো মার্কেট যে স্ট্যাবল পজিশনে আনা বা রাখার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে অনেক সতর্কভাবে সবকিছু ডিল করতে হবে। যে আইনগুলো আছে সেগুলো মেনে চলছে কি না, তা দেখাশোনা করতে হবে। এবং গ্রস ভায়োলেশন করলে সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আমি মনে করি, দেশি ও বিদেশি কোম্পানিগুলোকে মার্কেটে আনতে পারলে, তাহলে হবে কি মার্কেটের কলেবরটা বাড়বে।

একটা বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলাম, এনবিআররের যে ট্যাক্স আইনটা করেছে সেখানে বলা আছে একটা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি যদি শেয়ারবাজারে এনলিস্টেড হয়, তারা যদি কমপক্ষে ১০ পার্সেন্ট ডিভিডেন্ট ঘোষণা করতে পারে, তাহলে ১০ পার্সেন্ট ট্যাক্স তাদের কম দিতে হয়। আমরা দেখেছি বাংলাদেশের অনেক বড় বড় কোম্পানি এই ট্যাক্স সুবিধা না নিয়ে তারা কিন্তু এনলিস্টেড হচ্ছে। এনবিআরের চেয়ারম্যানকে বলেছিলাম বড় বড় কোম্পানিগুলো কেন আসছে না তার কারণ হচ্ছে, তাদের তদারকি বাড়বে। সার্ভিল্যান্স বাড়বে। তাদের লাভের পরিমাণ লুকাতে কষ্ট হবে। অবৈধভাবে এর চেয়ে বেশি সুবিধা পাওয়ায় তারা পুঁজিবাজারে আসছে না, ১০ পার্সেন্ট ট্যাক্স সুবিধা নেয় না।

আমি মনে করি, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন যে পদক্ষেপটা নিয়েছে তা হলো নানাভাবে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেওয়ার পাশাপাশি নৈতিক একটা চাপও দিচ্ছে, যাতে কোম্পানিগুলো বাজারে আসে। তাহলে মার্কেটের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়বে, বিদেশিদেরও আস্থা বাড়বে। বিদেশি কোম্পানিগুলো আসতে পারে। আমাদের এখানে স্টক মার্কেটে ভাইভারসিফায়েড (বৈচিত্র্যময়) তেমন কিছু নেই। পুরোটাই স্টক-বেইজড। হয়তো আরও সময় লাগবে। বর্তমান কমিশন চেষ্টা করলেও রাতারাতি এটা করা সম্ভব নয়।

আমাদের মার্কেটের আরেকটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলোÑ পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্টের ক্ষেত্রে বিদেশিদের অবদান খুুবই কম। বিদেশিদের পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট ব্যাপকভাবে ভ্যারি করে। কোনো একটা সময়ে আমাদের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২ থেকে ১১ ভাগ পর্যন্ত এটা ভ্যারি করে। কিন্তু আমাদের এখানে এটা আরও বেশি থাকার কথা। বিদেশি বা বিদেশি কোম্পানি যাতে আরও বেশি বিনিয়োগ করে, সে দিকটায় একটু চেষ্টা করা দরকার। তাদের আস্থার বিষয়ে আরও কাজ করতে হবে।

আরও একটা বিষয় হলো, উন্নত দেশগুলোর পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ ৬০ থেকে ৮০ ভাগ। কিন্তু আমাদের দেশের বড় বড় কোম্পানির বিনিয়োগ কিন্তু খুবই কম। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর সংখ্যাই বেশি। ইদানীং কিছু প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ বেড়েছে। কিন্তু আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। আর দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের এখানে পুঁজিবাজার সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা নেই। এখনো বেশির ভাগ মানুষ মনে করে এটা ‘শেয়ার মার্কেটÑ ফাটকাবাজার’।

অতীতে কতিপয় দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু নেতিবাচক মন্তব্যের কারণে সাধারণ মানুষেরও একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। কারণ, এক্সিট স্ট্যাটিটিকস না থাকলেও আমরা বলতে পারি উন্নত বিশ্বে উত্তর আমেরিকা বা ইউরোপ সেখানে কিন্তু ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষ তাদের স্টক হোল্ড করে। তারা রিয়েল টাইম ট্রেডটা করতে পারে। বাংলাদেশেও এটা চলছে, কিছুদিনের মধ্যে পূর্ণরূপে শুরু হবে। এটা আমরা বিশ্বাস করি।

ব্লকচেইন এই টেকনিকটা বা এই প্রযুক্তিটা যদি আমরা এখানে প্রয়োগ করতে পারি, আমাদের এখানে সামগ্রিক স্বচ্ছতা আরও বাড়াতে পারব। সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি, রেগুলেটরসহ সরকারের দিক থেকে এই দায়িত্ব নেওয়া উচিত। পুঁজিবাজার সম্পর্কে যেন একটা ভালো ধারণা সবার সৃষ্টি হয়। এই বাজারে জনগণের অংশগ্রহণ থাকবে, আরও নতুন নতুন কোম্পানি রেইজ হবে। নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারবে, বিনিয়োগ করতে পারবে। আমি মনে করি এর মাধ্যমে অর্থনীতি ত্বরান্বিত হবে।

দেশের শিক্ষিত মহলের একটা বড় অংশের ধারণা, পুঁজিবাজারের সঙ্গে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক কী? কিন্তু এটার মাধ্যমে কোম্পানিগুলো তাদের আইপিও, রিআইপিও, বন্ড বিক্রি করে টাকা বিনিয়োগ করে। তার মাধ্যমেই দেশের উৎপাদন জিডিপির পরিমাণ বাড়ে, এই ধারণাটা অনেকের নেই।

বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে কিছু পরামর্শ হলোÑ অন্যরা বিনিয়োগ করেছে দেখে তারাও বিনিয়োগ করে, এমন অনেকে আছেন। কোন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে, কেন বিনিয়োগ করেছে, তারা সেটা বিচার করতে চায় না। তাদের এ ক্ষেত্রে আরও সচেতন হওয়া দরকার। একটা কোম্পানির ফান্ডামেন্টালসগুলো দেখা দরকার। তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে শুধু কোম্পানির ফান্ডামেন্টালস দেখেই যে বিনিয়োগ করা যাবে, তা কিন্তু নয়। কারণ, আমরা বিজনেসের ভাষায় একটা কথা বলি, শুধুু কোয়ান্টেটিভ ফ্যাক্টর অর্থাৎ ইপিএস, আর্নিং, প্রাইজ আর্নিং রেশিউ, অপারেটিং প্রফিট বা কোম্পানির রিজার্ভ, এনএভি। এটা দিজ ইজ সামথিং। এটা দিয়েই যে সব মূল্যায়ন করা যাবে, তা কিন্তু নয়। কারণ, একটা কোম্পানির কোয়ান্টিটিভ ফ্যাক্টরের বাইরেও কিছু কোয়ালিটিটিভ ফ্যাক্টর থাকে। সেটা হলো, এই কোম্পানির ইতিহাস কেমন, ব্যবস্থাপনায় কারা আছে, এই কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কী? ভবিষ্যতে তারা কী করতে চায়। তার এক্সপোর্ট পোটেনশিয়াল কেমন? তার গ্রোথ পোটেনশিয়াল কেমন? সরকারের পলিসির সঙ্গে তারা কতটুকু কমপ্লাই করেছে, এথিক্যালি কাজ করছে। তাদের প্রোডাক্টেও বৈচিত্র্য আনছে কি না। এক্সপোর্ট বৃদ্ধির জন্য তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে কি নাÑ এই বিষয়গুলো দেখা দরকার।

বিনিয়োগকারীদের কোম্পানির অতীত যেমন দেখা দরকার, তেমনি তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও দেখা দরকার। সর্বোপরি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা বা স্পন্সর কারা, সেটাও দেখা দরকার। এই ইনসাইট দেখা দরকার। তাদের বেশ সতর্ক হওয়া দরকার।

যারা বিনিয়োগ করবে তারা যেন শর্টটার্ম বিনিয়োগ না করে লংটার্ম বিনিয়োগ করে। তাদেরকে কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করে কোনো একটা পোর্টফোলিওতে বিনিয়োগ করা দরকার। তাতে হবে কি, ক্ষতির মাত্রাটা কমবে। লাভ কখনো কখনো কম হলেও স্থিতিশীলতা বাড়বে। কারণ, সিঙ্গেল স্টকে বিনিয়োগ করা ঠিক নয়। একই সঙ্গে বিনিয়োগের জন্য ইন্ডাস্ট্রির অবস্থাও বোঝা উচিত। কোন কোন ইন্ডাস্ট্রিগুলো অর্থনীতিকে লিড দেবে। এই যে অন্তর্দৃষ্টি। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

আর কমিশন যেভাবে করছে সেটা ভালো। তবে তাদের সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু আইন পরিবর্তন, পরিবর্ধন করা দরকার। আর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ, মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউসগুলোর মধ্যে একধরনের সমন্বয় থাকা দরকার। আমি মনে করি মাসিক বা পাক্ষিক একটা সমন্বয় সভা হওয়া দরকার। তাহলে হবে কি, ছোট ছোট অনেক সমস্যা সামনে চলে আসবে, সেগুলো সমাধানের পথ তৈরি হবে। কারণ আমরা অতীতেও দেখেছি মার্কেট ক্রাশের বড় কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো সমন্বয়হীনতা। আরেকটা জিনিস হলো প্রতিটি রেগুলেটরি বোর্ডই যেন অন্য রেগুলেটরি বোর্ডকে সম্মান করে। যোগাযোগ সমন্বয়টা করে। যখন মিউচুয়াল এরিয়া থাকবে তখন যেন সমন্বিত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। সম্প্রতি আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিসিকের মধ্যে যে টানাপোড়েন দেখেছি, এটা কিন্তু হওয়ার কথা ছিল না।

বন্ডে পাবলিক বা ইনস্টিটিউট যখন বিনিয়োগ করেছে, তখন তাদের একটা নিশ্চিত রিটার্ন তারা পাবে। যদিও রিটার্নের পরিমাণটা বেশি না, কিন্তু রিস্ক ফ্রি। যারা নির্দিষ্ট আয়ের ওপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য বন্ডের বিনিয়োগটা ভালো। সে ক্ষেত্রে বন্ডের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা জানি বন্ডের একজন ট্রাস্টি থাকে যেন বন্ডগ্রহীতার অধিকার ক্ষুণ্ন না হয় এবং বন্ডের শর্তগুলো যেন প্রতিফলিত হয়। বন্ড সিকিউরড হওয়ার কথা। কোনো কারণে কোম্পানি যদি অপারগ হয় এই বন্ডের টাকা বা বন্ডের শোধ পে করতে। সে ক্ষেত্রে এর বিপরীতে যে সম্পদগুলো রাখা হয়, সেগুলো বিক্রি করে যেন টাকা দেওয়া যায় সেটাই করা হয়। এই টেকনিক্যাল জায়গাগুলো বিসিককে সুন্দরভাবে দেখা দরকার। যাতে মার্কেটে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে।

একটা ভালো মার্কেটে বন্ডের কন্ট্রিবিউশন থাকার কথা, কিন্তু আমাদের এর পরিমাণ খুবই কম। যেহেতু বন্ড আমাদের মার্কেটে নতুন। আর সুকুক যে বন্ডটি এসেছে সেটির পরিমাণ অনেক বেশি। সে ক্ষেত্র আমরা যাতে কোনো ধরনের বিচ্যুতি ছাড়া এগোতে পারি, সেটাই দেখার বিষয়। একটু সতর্ক থাকা ভালো, যেন ভবিষ্যতে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে। আশা করি ঘটবে না।

মার্কেটটাকে যে ডাইভারসিফাই করা হচ্ছে, এটা আমার কাছে একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ মনে হয়েছে।

আমার জানা মতে, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্টক মার্কেটে কোনো বাধা নেই। সরকারি কর্মকর্তা কেন, যেকোনো মানুষই সেখানে বিনিয়োগ করতে পারেন। আবুল খায়ের হিরু একজন জেলা পর্যায়ের সমবায় কর্মকর্তা। যেহেতু তিনি যেখানে চাকরি করেন সেখানে তার সমিতিগুলোর অনেক ফান্ড থাকে। আমি যতটুকু জানি তাদের ফান্ডের ১০ ভাগ তারা বিনিয়োগ করতে পারেন। তাকে আমি যতটুকু জানি তিনি বিনিয়োগ করেছেন। সেখানে তারা লাভবান হয়েছে। প্লাস পরবর্তী সময়ে তার সফলতা দেখে মানুষের তার প্রতি আস্থা বেড়েছে। অনেকেই সে কারণে মার্কেটে ধাবিত হয়েছেন। আমার কাছে মনে হয়, এই মার্কেটে সামান্য কিছু অবদান হলেও তার আছে। তার এখন সরাসরি না হলে মোটামুটি একটা পোর্টফোলিও তিনি দেখাশোনা করেন। আজকে মার্কেটের যে কলেবর বেড়েছে, বিনিয়োগ বেড়েছে সে ক্ষেত্রে কিছু অবদান তো তার আছেই। তার মতো যদি আরও কিছু লোক মার্কেটে আসত, মার্কেটটা আরও ভালো হতে পারত। আশা করি সামনে হয়তো আসবে।

আবুল খায়ের হিরু আমাদের বিভাগের ছাত্র ছিলেন, ডিপার্টমেন্টে তার সুদৃষ্টি আছে। ডিপার্টমেন্টের অনেক প্রয়োজনে আর্থিকভাবে সাহায্য করা থেকে শুরু করে তিনি এগিয়ে এসেছেন, সেটা আলাদা ইস্যু। সামগ্রিকভাবে আমি মনে করি চাকরিজীবী হয়ে তিনি দেশের পুঁজিবাজারে যে সময় দিচ্ছেন, উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে সমবায় সমিতির বিনিয়োগ করে যে লাভবান হচ্ছে আমি মনে করি নিঃসন্দেহে এটা ভালো দিক। ঝুঁকি নিয়ে যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটা তো ভালোই। ঝুঁকি নিয়ে সফল হয়েছে, আবার লসও করেছেন। নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ জীবনযাপন করা তো ভালো। কিন্তু দেশের বা জাতির পরিবর্তনের জন্য আপনাকে ঝুঁকি নিতেই হবে। পাকিস্তানের জনগণ আমলারা যদি পাকিস্তানের নিয়ম মানতেন তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। তারা সেই দেশের সংবিধান লঙ্ঘন করেই কিন্তু দেশ স্বাধীন করেছেন। সেটাও একধরনের অনিয়ম। কিছু ঝুঁকি আপনাকে নিতে হবে। এটাই পজিটিভ দিক।

লেখক: চেয়ারম্যান, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :