আত্মহত্যা প্রবণতা ঠেকাতে সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় হতে হবে

তৌহিদুল হক
 | প্রকাশিত : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৯:২৩

আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা এটা হচ্ছে বাংলাদেশের নতুন ট্রেন্ড। এই ট্রেন্ডটা মানুষ বেছে নিচ্ছে কেন? এটা একটা বিষয়। এই বিষয়ের ক্ষেত্রে আমার বিশ্লেষণটা হলো, মানুষ বেঁচে থাকার জন্য নানা ধরনের সম্পর্কে জড়িত হয় বা জড়িয়ে পড়ে। নানা ধরনের সংকট জীবনে তৈরি হয়। সংকটগুলোকে মোকাবেলা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হয়। কিন্তু যখন তার কোনো সংকট সে এককভাবে মোকাবেলা করতে পারে না অথবা একজন ব্যক্তি তার এই দীর্ঘ যাপিত জীবনে যে পরিবার-পরিজনের জন্য কাজ করেছে তারা যখন তাকে অবহেলা করে বা তার প্রতি গুরুত্ব দেয় না অথবা সে যখন তার নানান দিক থেকে ব্যর্থ হয় তখন তার মধ্যে নানা ধরনের হতাশা কাজ করে। তিনি সহযোগিতা প্রত্যাশা করে যখন পান না তখন তার মধ্যে একটা তাৎপর্যহীন জীবনের রূপ বা প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। আমাদের এখানে সংকট অথবা সমস্যার কথা শোনার মত সমাজের ধরনটা আমরা তৈরি করতে পারিনি। আমরা শুধু সাফল্যই শুনতে চাই এবং সেটাকে ব্যক্তির বড় গুণ মনে করি। কিন্তু একটি ব্যক্তির সাফল্যের পাশাপাশি তার যে নানা ধরনের সংকট সমস্যা থাকতে পারে, সেগুলোর সমাধান করা যে প্রয়োজন বা সমাধানের ব্যবস্থাও যদি থাকে সেই সমস্যাগুলো সোনার পরিবেশ বা কালচারটা কিন্তু আমরা আমাদের সমাজে তৈরি করতে পারেনি। একটা মানুষ যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আত্মহত্যা, নিজে নিজেকে গুলি করে কিংবা বিষপান করে, বা নিজে নিজের গলা চাকু দিয়ে কেটে ফেলে তার মানে কিন্তু এই যে সে আসলে সে বাঁচার চেষ্টা করেছিল কিন্তু আসলে সেভাবে কেউ তাকে সহযোগিতা করেনি। আরেকটা ব্যাপার হলো যে আমাদের এখানে আমরা যেটা মনে করি যে তাকে কষ্টের কথাগুলো বা হতাশার কথাগুলো সবাইকে বলে যাই অথবা সে শেয়ার করে। এই শেয়ারের মধ্যে দিয়ে দুই ধরনের প্রবণতা সৃষ্টি হয়।

একটা হলো তার কষ্টের ব্যাপারগুলো সমাজে কি চলছে বা ব্যক্তিকে বাহ্যিকভাবে খুব ভালো দেখালেও ভেতরে যে কষ্ট বা হতাশার ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার একটা পরিস্থিতির কথা কিন্তু বিষয় বিশ্লেষণে আমরা এই ধরনের চিত্রের মাধ্যমে বুঝতে পারি। আর দ্বিতীয়ত ব্যাপার হলো ব্যক্তির প্রয়োজনে ব্যক্তিকে যে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। কারণ আমরা সবসময় অর্থের পিছনে, ক্যারিয়ারের পিছনে অতিমাত্রায় মনোযোগ না দিয়ে সম্পর্ক বন্ধনের পেছনেও যে আমাদের মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন, চর্চা করা প্রয়োজন এবং এগুলোর ভিত্তিতেই যে সমাজ টিকে থাকে এই বিষয়টাও কিন্তু আমাদের এখান থেকে শিক্ষণের বিষয় আছে।

কিন্তু বিষয়টা হলো আমাদের দেশের আত্মহত্যার বিষয়গুলো সামাজিক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে আমরা দেখি। যে পরিবারের কেউ একজন আত্মহত্যা করে সে পরিবারটাকে সমাজের অন্যরা ছোট করে দেখে। অথবা নানা ধরনের কলঙ্কের দিয়ে তাদেরকে বিবেচনা করে। তাদেরকে নানা ধরনের বদনাম দেওয়া হিসেবে বিবেচনা করে। তো এই জায়গাগুলো দেশে আরও বেশি সচেতনতার প্রয়োজন আছে।

তারপর সরকারেরও একটা ভূমিকা প্রয়োজন। ‘আত্মহত্যাকে না বলুন’ এই যে শ্লোগান সামনে রেখে্ এগোতে হবে। যখন একজন ব্যক্তি নানা ধরনের সমস্যা ও সংকটের মধ্যে যাই তখন তাঁকে ভালো করার ব্যবস্থাগুলোও আছে। ভাল করার ব্যবস্থাগুলোকে যাতে গ্রহণ করে। সেটি যদি সে সমস্যা কে আলোচনা বা শেয়ার করার জন্য বিশ্বস্ত কোন বন্ধু, পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়স্বজনও না পাই তাহলে পেশাগত ব্যক্তি আছে, সাইকেট্রিক বা সাইকোলজিস্ট আছে। তাদের যাতে শরণাপন্ন হয়ে বিষয়টি আলোচনা করে। চিকিৎসা গ্রহণ করলেই কিন্তু এই বিষয়গুলো থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারে। আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারে। তা না করে আসলে অনেক ব্যক্তি শেয়ার করতে না পেরে অথবা জীবনের প্রতি এত বিরূপ ধারণা তার তৈরি হয়, এত কষ্ট সে পাই, নিজের প্রতি তার এত অনীহা তৈরি হয় তখন সে আসলে মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করে।

এটি আসলে বৃহৎ পরিসরে আমাদের গোষ্ঠীগত, সমবেত বা সমাজের সামগ্রিক ব্যর্থতা হিসেবে আমি মনে করি। যে আমরা এই সমস্ত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে পারছি না। সমাজটা এমন তৈরি করতে পারলাম না যে একজন মানুষ কষ্টে আছে, সংকটে আছে, মনস্তাত্ত্বিক অস্থিরতায় আছে সে এটা কারও সাথে শেয়ারও করতে পারছে না। তাকে সমবেদনা জানানোর মতো কেউ নেই। তার সন্তানেরা নেই, তার পরিবারের অন্য সদস্যরা নেই, তার আত্মীয়-স্বজনেরা নেই এবং সমাজের অন্য সদস্যদের তো আমরা সেভাবে প্রস্তুতি করতে পারছি না। অর্থাৎ আমরা যেভাবে অর্থনৈতিকভাবে আমরা সমৃদ্ধি বা এগিয়ে যাচ্ছি আমাদের যতটুকু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তৈরি হচ্ছে তার সাথে কিন্তু আমাদের সামাজিক অথবা সাংস্কৃতিক যে প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি তৈরি হওয়ার কথা ছিল সেই জায়গাগুলো কিন্তু আসলে সামঞ্জস্যভাবে তৈরি হচ্ছে না। যে কারণে আজকে আমরা আত্মহত্যা দেখছি। আত্মহত্যার অন্যান্য কৌশলগুলো মানুষ ব্যবহার করছেন।

মানুষের বিরুদ্ধে মানুষ দাঁড়াচ্ছে, ব্যক্তি নিজের বিরুদ্ধে নিজে দাঁড়াচ্ছে এই ধরনের অস্থিরতাগুলো সমাজের চারপাশ থেকে সমাজকে কিন্তু আবদ্ধ করে ফেলছে। এটা সমাজের জন্য আরও চরম একটা ভোগান্তি তৈরি করবে এবং সমাজকে আরও অস্থির করে তুলবে।

লেখক: শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ

সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :