দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সেবার মান প্রশ্নহীন হবে কবে?

দেশে যাব। যখনই ভাবি, মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করে দেশের বিমানবন্দরে ভোগান্তি, হয়রানি আর অনিরাপত্তার কথা। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রতিদিন বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার বহু বিমান ওঠা-নামা করে। কিন্তু বিমানবন্দরটি নামে আন্তর্জাতিক হলেও মানে কি উত্তীর্ণ?
সাংবাদিকতা, লেখালেখির সঙ্গে আমার ছুটে চলা এক যুগের বেশি সময়। তার মাঝে দুই বছর কাতার এয়ারপোর্টে চাকরি করার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানে বিমানবন্দরের পরিচালক থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবিরত যাত্রীসেবার মান শতভাগ নিশ্চিত করাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। তারপর কাতার থেকে এসে বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে একটি এয়ারলাইন্সে কিছুদিন কাজ করেছি। খুব কাছ থেকে দেখেছি অবকাঠামো থেকে শুরু করে দুটি এয়ারপোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সেবার মান আকাশ-পাতাল পার্থক্য। যেমনটি অভিজ্ঞতা আছে যাত্রী হিসেবেও।
দেশে ফিরে বিমানবন্দরে চরম হয়রানির শিকার হওয়ার কথা বলতে শোনা যায় যাত্রীদের। শুধু বিদেশফেরত যাত্রীই নন, বিদেশ গমনের ক্ষেত্রেও যাত্রীরা হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হন। বর্তমানে প্রায় সোয়া কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি বিশ্বের আনাচে-কানাচে বসবাস করছেন। প্রবাসীরা দেশে ফেরার সময় প্রতিনিয়ত বিমানবন্দরে কতিপয় কর্মকর্তার অসদাচরণ ও দুর্নীতির কারণে নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অসংখ্য অভিযোগ, বছরের পর বছর সংবাদ প্রকাশ, মন্ত্রীপর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সিভিল অ্যাভিয়েশনের কড়া তদারকি, প্রশাসনিক নজরদারিসহ গোয়েন্দা বিভাগগুলোর নানামুখী তৎপরতার পরও বন্ধ হচ্ছে না হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসী হয়রানি। বিমানবন্দর সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন ১১০ থেকে ১২৮টি ফ্লাইট এখানে ওঠানামা করে। এসব ফ্লাইটে প্রায় ২০ হাজার যাত্রী প্রতিদিন যাতায়াত করেন।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকেও বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি বন্ধের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না হয়রানি। নিরাপত্তা তল্লাশির নামে যাত্রীদের বড় ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, যাত্রীদের লাগেজ সংগ্রহে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় রাখার। বিমানবন্দরের ভেতরে অনেক সময় সংঘবদ্ধ চক্র লাগেজ কেটে ফেলে, আবার গায়েব করে দেয়। প্রবাসীদের পাশাপাশি ট্যুরিস্ট ভিসায় আসা অনেক বিদেশিও এই বিমানবন্দরে এসে হেনস্তার শিকার হন।
এদিকে বিমানবন্দরে ভোগান্তির পাশাপাশি এর বা্ইরে প্রবাসীদের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সন্ধ্যা নামার পরপরই বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফেরার পথে ঢাকার আশপাশে ডাকাতদলের কবলে পড়ছেন প্রবাসী যাত্রীরা। গত ফেব্রুয়ারিতে একই দিনে সৌদি আরব প্রবাসী গিয়াস উদ্দীন সবুজ ও কাজী জামাল উদ্দিন ডাকাতের কবলে পড়েন।
বিয়ে ঠিক হয়েছে। তাই হবু স্ত্রীর জন্য অলংকার, কসমেটিকস নিয়ে সৌদি আরব থেকে দেশে এসেছেন কুমিল্লার ছেলে জাহিদ হাসান। পথে ডাকাত দলের কবলে পড়ে সব হারিয়ে কোনো রকমে জীবন রক্ষা করলেন।
যারা প্রবাসে থাকেন, তাদের অধিকাংশেরই বাড়ি গ্রামে। ফ্লাইট যাদি সন্ধ্যার পরে অবতরণ করে নিরাপত্তার আশঙ্কায় দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে প্রবাসীদে কপালে। ভিনদেশে পরিশ্রম করে র্যামিট্যান্স পাঠিয়ে নিজদেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেন বড়ি ফিরতে হয় প্রবাসীদের! তাই রাতের ফ্লাইট মানে একটি আতঙ্ক মনে করেন প্রবাসীরা।
পুলিশ বলছে, বিদেশফেরতরাই ডাকাতদের টার্গেট থাকে। তার মানে বিমানবন্দর থেকে চক্রটি কাজ করে। তাই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা আরও জোরদার করার দাবি প্রবাসীদের।
শাখাওয়াত হোসেন নামের এক ভদ্রলোক কিছুদিন আগে সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশ গিয়ে ছুটি কাটিয়ে এসেছেন। ফোনে জানাচ্ছিলেন বিমানবন্দরে তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। শাখাওয়াত হোসেন বলেন, “অনেক দিন পর বাংলাদেশে গিয়েছি তাই সিমকার্ডও সাথে ছিল না। তাই বাইরে অপেক্ষমাণ স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করা কঠিন। বিমানবন্দরে নামেমাত্র টেলিফোন বুথ দিয়ে রাখছে, ব্যবহার করা যায় না। বাইরে কিছু লোক থাকে মোবাইল ফোন নিয়ে, তাদের কাছ থেকে কল করলে অনেক টাকা লাগে । আমার দিতে হইছে ৫০০ টাকা।”
শাখাওয়াত হোসেন আরো বলেন, ‘লাগেজ পেতে অনেক দেরি হয়েছে। কর্মকর্তাদের কাজের গতি খুব স্লো। ফলে যেকোনো কিছুতে দীর্ঘ লাইন। করোনা টেস্ট নিয়েও চরম হয়রানি নানা বিড়ম্বনা। বসার জন্য পর্যাপ্ত সুব্যবস্থাও নেই। আর মশার কথা কী আর বলব।’
যেসব প্রবাসী বছরের পর বছর বিদেশে থাকেন তাদের কাছে বাংলাদেশি কোনো সিম থাকে না। পরিবহন সেবা নিতে ও বিমানবন্দরে আসা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সমস্যায় পড়তে হয়। প্রবাসীদের সুবিধার জন্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের সহায়তায় চারটি টেলিফোন বুথ স্থাপন করেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। এমন উদ্যোগে প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু যাত্রীরা এই ফ্রি ইন্টারনেট ও টেলিফোনকে বলছেন ‘ভুতুড়ে আয়োজন’।
বিমানবন্দরে ‘আমরা’ ও ‘উই’- এর মাধ্যমে ফ্রি ইন্টারনেট সেবার আয়োজন করে রেখেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রবাসীরা যখন বিমানবন্দরে ফ্রি ইন্টারনেট সুবিধা পেতে চান, শত চেষ্টা করেও তাদের পক্ষে ওই সেবা নেয়া সম্ভব হয় না। কারণ তাদের কাছে বাংলাদেশি কোনো সিম থাকে না। বিশ্বের অন্যান্য দেশে পাসপোর্ট নম্বরের মাধ্যমে ফ্রি ইন্টারনেট সেবা দেয়া হলেও বাংলাদেশে এখনো ওই ব্যবস্থা করা হয়নি।
ঝাঁকে ঝাঁকে মশার কারণে শান্তিতে দাঁড়ানোর উপায় নেই বিমানবন্দরে। বিদেশিরা দেশে ঢোকে বিমানবন্দর দিয়ে, বিমানবন্দর থেকে একটা দেশ সম্পর্কে অনেক কিছু ধারণা পাওয়া যায়।
শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বিদেশে যেতে বা ফিরে এসে মশা নিয়ে যাত্রী ও স্বজনদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ এবং ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও চিত্র বদলায়নি। শাহজালাল বিমানবন্দর ঘিরে আন্তর্জাতিকমানের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হলেও মশার কাছে হার মানতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে!
আব্দুল হালিম সোহাগ গত ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশে গিয়ে কিছুদিন আগে আবার কোরিয়াতে ফিরেছেন। গল্পের ছলে জানান ঢাকার বিমানবন্দরে ভোগান্তির অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, ‘দেশে যাওয়ার উদ্দেশে কোরিয়ার ইনচন এয়ারপোর্ট থেকে বিমানে উঠি। ঢাকার বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের সুশৃঙ্খল লাইনের কোনো ব্যবস্থা দেখলাম না। বিশাল লাইন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। বিমানবন্দরের কর্তব্যরত আনসার ট্রলিম্যান কিছু ভিআইপিকে টার্গেট করে তাদের সার্ভিস দেয়ার চেষ্টা করছে। বেল্টে লাগেজ আসতেও অনেক দেরি। তারপর এদিকে ট্রলির হাহাকার। কেউ কেউ ট্রলি না পেয়ে মাথায় করে ভারি লাগেজ বা ব্যাগ নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বের হচ্ছে।’
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বিমানবন্দরের দুই টার্মিনাল ঘুরে যাত্রীদের সাথে ভোগান্তির বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেন। এ সময় প্রতিমন্ত্রী কথা দিয়েছিলেন যাত্রীদের বিদেশযাত্রা ও আগমনকে আরও আরামদায়ক করতে চলতি বছরের গেল ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নতুন করে ২৫০০ ট্রলি যুক্ত হবে।
বিমানবন্দরের আশপাশে দালাল চক্রের নিয়মিত শোডাউন চলে নতুন সহজ-সরল যাত্রীদের কেন্দ্র করে। বিমানবন্দরের ভেতরে কর্মরত একশ্রেণির আনসার, সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্মী, কাস্টমস-ইমিগ্রেশন পুলিশ হয়রানির কারণ হচ্ছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। তাদের কারণে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে প্রবাসীদের।
হাজারো প্রবাসী স্বপ্ন দেখে কিছু অর্থ উপার্জন করে নিরাপদে দেশে ফিরে যাবে। ফিরে যাবে স্ত্রীর-সন্তানের কাছে, বাবা-মায়ের কাছে। প্রবাসে পাখির ডাকে ভোরে ঘুম ভাঙে না, ভাঙে ঘড়ির অ্যালার্মে।
লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক, সিউল, দক্ষিণ কোরিয়া।

মন্তব্য করুন