মন্ত্রীকে সিইসি, ইসি ‘স্যার’ কেন বলবেন না?

কেন এভাবে বিতর্কে জড়াচ্ছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার? সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন সমালোচকদের? বিষয়টি কি শুধুই কাকতালীয়? না-কি এর পেছনেও আছে পরিকল্পিত কোনো মস্তিষ্ক?
কেনই বা দু-একজন নির্বাচন কমিশনারের কণ্ঠেও শোনা যাচ্ছে ভিন্ন সুর? কেমন যেন তালগোল পাকানোর একটা আলামত পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের কথাবার্তা এমন বেসুরো কেন? তারা নিজেরাই তাদের কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবোধক করে তুলছেন না?
এই মুহূর্তে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পাখির চোখে দেখা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে। কিন্তু বর্তমান কমিশন ফাইনাল পরীক্ষার আগেই কেমন যেন নার্ভাস! সত্যিই কি তাই!
হইহই কাণ্ড। রইরই ব্যাপার। ঢাকা টাইমসের নিউজরুমের মাধ্যমে যখন প্রথম খবরটা পেলাম তখন মনে হলো কানের কাছে বোমা ফাটালো কেউ। সিইসি সত্যিই কি এমন কিছু বলেছেন? কানখাড়া করে টেলিভিশন অন করলাম। পরিষ্কার শুনতে পেলাম সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলছেন, তলোয়ারের জবাব রাইফেলে দিতে। ধাক্কা খেলাম। এ কি শুনলাম! এ কেমন রসিকতা? ভ্যাবাচ্যাকাও খেলাম। এই মন্তব্যের তাৎপর্য যে গভীর তা-কি আসলে না বুঝেই বলেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার? আমার অনুসন্ধিৎসু মন তা বিশ্বাস করতে চাইলো না। বরং এই নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে তৈরি হলো গভীর সংশয়।
সংশয়ের মাত্রাটা একটু বাড়লোও বৈ-কি। যখন সিইসি, ইসির সাম্প্রতিক কিছু কথাবার্তা নিয়ে অভিজ্ঞ কয়েকজন সরকারি আমলার মন্তব্য, প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলাম। একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বললেন, একাধিক মাধ্যমে তিনি আভাস পেয়েছেন, এবার নির্বাচনের আগেই নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করে ফেলার সবরকম চেষ্টা হবে। ওই কর্মকর্তার সন্দেহ, নির্বাচন কমিশনে নেতিবাচক মানসিকতার কেউ কেউ ঢুকে পড়েছে। আঁতকে উঠি। এসব কি শুনছি। রীতিমতো গা হিম হিম করতে থাকে। একজন গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী বলেন— অবাক হবেন না। বরং তৈরি থাকুন। দেখবেন, শেষ মুহূর্তে কেটে পড়তে পারেন দায়িত্বরত কেউ কেউ।
তাহলে এসব কি সেই প্রেক্ষাপট তৈরিরই আলামত?
তাই যদি না হবে তাহলে সিইসি কি করে বলেন রাজনীতিতে পচন ধরেছে। এটা কি যেই সেই কথা? এটা তো তাদের কথা যারা দেশে বিরাজনীতিকরণ চান। ১/১১তে দেশে সেনাসমর্থিত তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনীতি, রাজনীতিককে নিয়ে এমন কটাক্ষ আমরা অনেক শুনেছি। নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাতারাতি দল গঠন করলেন তখন। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হলো।
তথাকথিত সংস্কারের নামে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ভাঙ্গার কত তৎপরতাই না আমরা দেখলাম। এক শ্রেণির অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্ব পর্যন্ত সেই সময়কার অনির্বাচিত ক্ষমতাধরদের পাতা ফাঁদে পা দিলেন। সংস্কারপন্থীদের খাতায় নাম লিখিয়ে আম-ছালা দুইই হারালেন। যার জেরে এক ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা আজও ভেতরে ভেতরে চলমান।
দু’বছরের ওপরে অনির্বাচিত সরকার দেশ শাসনও করলো তখন। রাজনীতিতে পচন ধরেছে, সেই পচন থেকে দেশকে, জাতিকে রক্ষা করার বুলি আউড়িয়ে সীমাহীন ক্ষমতা চর্চা করেছেন কেউ কেউ। এখন রাজনীতির পচনের কথা শুনলে কিছু ক্ষমতালিপ্সু জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন, সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর কথা মনে হয়।
তলে তলে কি তাহলে অনেক কিছু হচ্ছে?
যতদূর মনে করতে পারি বর্তমান সিইসির সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে। ওষুধ শিল্পের একজন উদ্যোক্তার অফিসে। তখন তিনি সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সচিব। মনে হয়েছিল পরিমিত একজন মানুষ। মেপে, মেপে কথা বলেন, তাঁর বন্ধু শিল্পপতিকে বলেছিলাম হাবিবুল আউয়ালসুলভ আমলাই আমাদের চাই। আসলেই কি তাই? এখন আমি কনফিউজড! সিইসি হওয়ার পর সেই হাবিবুল আউয়ালসুলভ কথাবার্তায় এত ঘাটতি! কিন্তু কেন?
সিইসি এবং কোনো কোনো ইসি বোধহয় কখনো কখনো একটু বাড়তি কথাই বলছেন। যা-কি তাদের কাছ থেকে আমরা কেউই আশা করছি না। ঢালাও মন্তব্য করা কি দায়িত্বশীল আচরণের মধ্যে পড়ে? দেশের মানুষ তো বটেই, আন্তর্জাতিক মহলও নির্বাচন কমিশনের কাছে আশা জাগানিয়া কথা শুনতে চায়। ইতিবাচক কাজ দেখতে চায়। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনার বা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেন তাদেরকে অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচন কমিশনার করে দিতে বলবেন? এটা তো বাংলাদেশ, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থাকেই ছোট করার নামান্তর।
বাংলাদেশের ইসি যখন বলেন, ‘এখানে নির্বাচন করা অনেক কঠিন কাজ। এটা হচ্ছে আমাদের রাজনীতি। অর্থশক্তির কথা বলা হচ্ছে, অর্থশক্তিকে আমরা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবো? আমি জানি, ১২ কোটি টাকা ১৫ কোটি টাকা নিয়ে আপনারা...’ কাজী হাবিবুল আউয়ালের এসব কথায় আমরা কিন্তু হতাশ। কথাগুলো নিঃসন্দেহে ইঙ্গিতপূর্ণ।
নির্বাচন কমিশনের কাছে দেশের সাধারণ মানুষ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ভোট চায়। বক্তৃতা করা, কথার পৃষ্ঠে কথা বলে এগিয়ে থাকার চেষ্টা কি তাদের কাজ?
কৌতুক আমরা কে না পছন্দ করি। কিন্তু সিইসির মতো একটি সংবেদনশীল পদে থেকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কৌতুক কতটা মানানসই? এই প্রশ্ন এসেই যাচ্ছে। যদিও সিইসি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তবুও অনেকের মধ্যে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলো তা কি সহজে কাটবে?
নির্দিষ্ট মেয়াদ পূরণের আগে কেন বিদায় নিতে চান সিইসি? এখন যদি বিদায় নিতে পারতাম, এই হতাশাব্যঞ্জক কথা কিন্তু শুভ লক্ষণ নয়। নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত সব পক্ষের মধ্যে আস্থার পরিবেশ তৈরি করাই নির্বাচন কমিশনের কাজ। সেই কমিশনের প্রধানকে আমরা আরও পরিমিত আরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে অনুরোধ করবো।