অর্ধশতাব্দী পর সিলেটের বধ্যভূমি এখন শহীদ স্মৃতি উদ্যান

এনামুল কবীর, সিলেট
 | প্রকাশিত : ০৫ মার্চ ২০২৩, ১৮:৩১

অর্ধশতাব্দী পর সিলেটের সবচে বড় বধ্যভূমি নতুন রূপ পেয়েছে। রপান্তরিত হয়েছে শহীদ স্মৃতি উদ্যানে। প্রাথমিক কাজ শেষে এই উদ্যান যাত্রা শুরু করেছে। শনিবার শহীদ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এই উদ্যোনের যাত্রা শুরু হয়। সিলেট শহরতলীতে অবস্থিত ক্যাডেট কলেজের পেছনের টিলার পাদদেশে সিলেটের সবচে বড় এই বধ্যভূমি। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে পাক হায়েনাদের ক্যাম্প ছিল।

সিলেটের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম বীর প্রতীকের মতে, গুয়ানতানামো বে'র চেয়েও নিকৃষ্ট ছিল এই ক্যাম্প। এখানে শুধু মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে ধরে এনে হত্যা করা হয়নি, বরং অনেক অসহায় নারীকে এখানে ধরে এনে দিনের পর দিন মাসের পর মাস পাশবিক নির্যাতন করা হয়।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এমন একটা গৌরবময় অধ্যায় এতদিন পড়েছিল নিতান্ত হেলাফেলায়। ঝোপঝাড়ের জঙ্গল পরিষ্কার করে এখন এটাকে রীতিমতো উদ্যানে রূপান্তর করা হয়েছে। এ এক বিশাল পরিকল্পনা, যার নায়কও দুই মুক্তিযোদ্ধা। একজন আবার শহীদ পরিবারের সন্তান।

তাদের একজন হলেন সিলেটের শহীদ ডা. শামসুদ্দিনের যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসীর ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জিয়া উদ্দিন আহমদ। অপরজন তারই সহযোদ্ধা, বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বীর প্রতীক।

বর্তমান প্রজন্মের কাছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে দৃশ্যমান করে তুলতে কাজ করছেন তারা। তারই অংশ হিসেবে কয়েক বছর আগে তারা এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তা বাস্তবায়নে আর সরকারের অপেক্ষা করেননি। সেনপ্রধানের অনুমতি পাওয়ার পর নিজেরাই নিজেদের পরিবারের সদস্য আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে কাজ শুরু করেন। প্রায় অর্ধকোটি টাকা বাজেটের এই উদ্যানে আগামীতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও করার পরিকল্পনা তাদের। উদ্যানটির সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ এমনভাবে হবে যে, এটি সিলেটের পর্যটন শিল্পেও একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে। এমনটিই জানিয়েছেন ডা. জিয়া ও কর্নেল সালাম বীর প্রতীক।

এই বধ্যভূমিতে মোট ৬১ জন শহীদের কবর শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এই কাজ চলছে এবং যখনই যার কবরের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে তখনই তা এখানে লিপিবদ্ধ করা হবে।

শনিবার শহীদ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এই শহীদ স্মৃতি উদ্যানটি উদ্বোধন করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী।

উদ্বোধনের পর এখানে গণকবর দেয়া বীর শহীদদের স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন এবং শহীদদের কবরে ফুল দিয়ে গভীর শ্রদ্ধা জানান তারা।

এসময় স্বজনরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন এবং তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াতে থাকে।

এ প্রসঙ্গে এই উদ্যানের অন্যতম উদ্যোক্তা আব্দুস সালাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসজুড়ে যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল সেখানে এখন রয়েছে সিলেট ক্যাডেট কলেজ। কলেজের পেছনে পূর্বদিকের টিলার পাশে মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে নিয়ে হানাদাররা নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে এই বধ্যভূমিতে। বধ্যভূমি সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় গত বছর এখানে শহীদদের স্মরণে ‘স্মৃতিসৌধ’ নির্মাণ করে সিলেটের গণপূর্ত বিভাগ।

আর আজ নতুনভাবে পরিচিতি পেল এই বধ্যভূমি। এখানে যাদের কবর দেয়া হয়েছিল তাদের নামফলক স্থাপন করা হয়েছে।

জানা গেছে, ওই বধ্যভূমিতে গণকবর দেয়া শহীদদের পরিচয় জানতে স্থানীয় পত্রিকাতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। প্রাপ্ততথ্যের ভিত্তিতে ৬৬ জন শহীদের নামফলক বসানো হয়েছে। এ প্রচেষ্টা চলবে।

এখন পর্যন্ত যাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে তারা হলেন, নারায়াণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার মোসলেহ উদ্দিন ভুঁইয়ার ছেলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ড. এএফ জিয়াউর রহমান, হবিগঞ্জ জেলার আউশকান্দি এলাকার সৈয়দ সাজিদ আলীর ছেলে সৈয়দ সিরাজ আবদাল, সিলেট নগরীর পুরানলেন এলাকার উপেন্দ্র কিশোর সেনগুপ্তের ছেলে বিমলাংশু সেন, ছড়ারপাড় এলাকার আব্দুন নুরের ছেলে বাছির মিয়া, সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার দেউল গ্রামের মন্তাজ আলীর ছেলে নুরুল হুদা গউস, ইপিআর ক্যাপ্টেন আলাউদ্দিন, সিলেট নগরীর মুগলটুলা এলাকার মশরফ আলীর ছেলে সোনাওর আলী, মিরাবাজার এলাকার শারদাচরণ দেবের ছেলে শুভেন্দু শেখর দেব শংকর, একই এলাকার গিরিধারী চক্রবর্তীর ছেলে গির্বানী কান্ত চক্রবর্তী, তার ছেলে গকুলানন্দ চক্রবর্তী ও গঙ্গোত্রী চক্রবর্তী।

এছাড়াও অন্যান্যরা হলেন, খাদিমপাড়ার দত্তগ্রাম এলাকার ইয়াকুব আলীর ছেলে সিদ্দিক আলী, একই গ্রামের আব্দুল লতিফের ছেলে আব্দুর রব হীরা, মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার খলাগ্রামের সূর্যকুমার ধরের ছেলে সুরতিমোহন ধর, একই গ্রামের দীনরাম দেবের ছেলে নরেন্দ্র দেব, সিলেট মহানগরের জল্লারপাড় এলাকার বলেনদ্র চন্দ্র রায়ের ছেলে শুভন্দ্র শেখর রায়, সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার ছোটদেশ এলাকার আছদ্দর আলীর ছেলে তোতা মিয়া, সিলেট সদর উপজেলার মহালদিক গ্রামের আনোয়ার পাত্রের ছেলে কুমেদ পাত্র, একই গ্রামের কানতুর পাত্রের ছেলে ফরছন পাত্র, রবাই মিয়ার ছেলে ইসরাইল আলী, সৈয়দ আলীর ছেলে আব্দুর রহমান, কনাই মিয়ার ছেলে আব্দুল গনি, মুছন আলীর ছেলে রমজান আলী, সিলেট সদর উপজেলার ধোপাগুল এলাকার হামিদ উল্লার ছেলে আমজদ আলী, সিলেট মহানগরের আখালিয়া ব্রাহ্মণশাসন এলাকার করুণাময় ভট্টাচার্যের ছেলে কালিপদ ভট্টাচার্য, তার ছেলে হীরেন্দ্র ভট্টাচার্য, নগরীর নয়াটিলা এলাকার সদাই নমঃশুদ্রের ছেলে সুখাই নমঃশুদ্র, সিলেট সদর উপজেলার উমদারপাড়া গ্রামের আলাই মিয়ার মেয়ে ছুরেতুননেছা।

আরও যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন, একই গ্রামের ওয়াহাব উল্লার মেয়ে রহিমা বেগম ও খলিলা বেগম, দক্ষিণ সুরমা উপজেলার খোজারখলা গ্রামের সুরুজ আলীর ছেলে তজমুল আলী, সিলেট সদর উপজেলার মহালদিক গ্রামের আব্বাস আলীর মেয়ে ময়না বিবি, গোয়াইনঘাট উপজেলার বীরকুলি গ্রামের ছমেদ আলীর ছেলে আব্দুল খালিক, সিলেট সদর উপজেলার লাখাউড়া গ্রামের হায়দার মিয়ার ছেলে আব্দুল মজিদ, একই উপজেলার পোড়াবাড়ি গ্রামের রামচরণ উড়াংয়ের সন্তান দূর্গা উড়াং ও ভাদুয়া উড়াং, একই গ্রামের লিব উড়াংয়ের সন্তান ঘাটমা উড়াং, একই উপজেলার বাবার হাট এলাকার কিশোরপাত্রের ছেলে শচীন্দ্রপাত্র, মহালদিক গ্রামের ছফর আলীর ছেলে আব্দুল গণি, সিলেট সদর উপজেলার লালবাগ এলাকার আব্দুল আলীর ছেলে জহির আলী, একই গ্রামের ইয়াকুব আলীর ছেলে জফুর আলী। সিলেট সদর উপজেলার বালিয়াকান্দি গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে আব্দুল ছোবহান, দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বরইকান্দি গ্রামের সৈয়দ আহমদের ছেলে আব্দুল আলী, সিলেট সদর উপজেলার জৈনকারকান্দি গ্রামের ইব্রাহিম আলীর ছেলে সাজিদ আলী, একই উপজেলার বাউয়ারকান্দি গ্রামের সফর আলীর ছেলে আব্দুল গনি, গোয়াইনঘাট উপজেলার কচুয়ারপাড় গ্রামের উমেদ আলীর ছেলে আকবর আলী, একই গ্রামের ফুরকান আলীর ছেলে ইউসুফ আলী, সিলেট সদর উপজেলার দাফনাটিলা গ্রামের ইসরাইল আলীর ছেলে কুটি মিয়া, একই উপজেলার কালাগুল এলাকার কেয়ামত আলীর ছেলে সুরুজ আলী।

সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার সিরাজপুর গ্রামের ফজল খানের ছেলে নুরুল হক খান, সিলেট সদর উপজেলার মহাজনপট্টি এলাকার গুরুচরণ মিত্রের ছেলে গজেন্দ্রলাল মিত্র, একই এলাকার মদনমোহন বণিকের ছেলে প্রাণ গোবিন্দ বণিক, শুধাংশু শেখর দত্তের ছেলে সুনীল দত্ত, সিলেট নগরীর সুবিদবাজার নয়াবস্তি এলাকার নারায়ন সিংহের ছেলে আনন্দ সিংহ, তার ছেলে খগেন্দ সিংহ, বড়বাজার রায়হোসেন এলাকর গরবা সিংহের ছেলে গৌরমোহন সিংহ, সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার কর্মকলাপতি গ্রামের বৃন্দাবন চন্দ্র দেবের ছেলে বসন্ত কুমার দেব, সিলেট নগরীর তাঁতীপাড়া এলাকার বংকেশ দাশ, সিলেটের ওসমানীনগর উপজলার তাজপুর রবিদাশ এলাকার গজেন্দ্র কুমার দেবের ছেলে মিহির লাল দেব এবং মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার নন্দনগর গ্রামের আব্দুল গণি চৌধুরীর ছেলে আব্দুল আহাদ চৌধুরী, সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণবাঘার মসিউদ্দিন চৌধুরী ছেলে সাইফুদ্দিন চৌধুরী এবং ইপিআরের মেজর আব্দুল্লাহ, ক্যাপ্টেন খালেদ ও মেজর চৌধুরী। তবে শেষের ৩ জনের বাবার নাম ও পূর্ণ ঠিকানা জানা যায়নি।

(ঢাকাটাইমস/০৫মার্চ/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :