গাজীপুরের ‘মরণযান’ তাকওয়া পরিবহনের হাইওয়ে মিনি

মহিউদ্দিন আহমেদ, শ্রীপুর (গাজীপুর), ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ২৫ জুন ২০২৩, ১৬:১২
অ- অ+

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে আতঙ্কের নাম তাকওয়া পরিবহনের হাইওয়ে মিনি। ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও অদক্ষ চালকের কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। মহাসড়কের গাজীপুরের শ্রীপুর অংশের মাওনা চৌরাস্তা থেকে ময়মনসিংহের ভালুকা পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার সড়ক দাপিয়ে বেড়ানো এই মিনি বাস যেন গাজীপুরের ‘মরণযান’।

সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনা, এ পরিবহনের ভয়াল চিত্র দৃশ্যমান হয়েছে। এর মধ্যে গত ১৬ জুন হাইওয়ে মিনি পরিবহনের বাসে ভালুকা এলাকায় এক নারীকে ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয়। দুদিন চিকিৎসার পর ওই নারী হাসপাতালে মারা যান। ওই নারী গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক ছিলেন। ওই ঘটনায় গাড়িটি জব্দের পাশাপাশি এর চালক ও সহকারীকে আটক করে পুলিশ। নিহতের ভাই বাদী হয়ে ভালুকা থানায় হত্যা মামলাও দায়ের করেন। বৈধ কাগজপত্রবিহীন সেই বাস চালকের কোনো লাইসেন্সও ছিল না।

ওই ঘটনার এক সপ্তাহ পর গত শুক্রবার (২৩ জুন) মহাসড়কের শ্রীপুর উপজেলার রঙিলা বাজার এলাকায় এক পোশাক কর্মীকে তাকওয়া পরিবহনের বাসের নিচে পিষে হত্যা করা হয়। গাড়িতে টেনে হিঁচরে হত্যা করা হয় শহিদুল ইসলাম নামে ওই ব্যক্তিকে। নিহত শহিদুল ইসলাম (৬৫) উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের মুলাইদ গ্রামের মৃত আব্দুল কাদিরের ছেলে। এ ঘটনায় শহিদুলের স্ত্রী সাহারা খাতুনও গুরুতর আহত হন। তিনি বর্তমানে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

শহিদুল ইসলাম তার স্ত্রীকে নিয়ে এক স্বজনকে দেখতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। সড়ক পাড় হওয়ার সময় হাইওয়ে মিনি তাকওয়া পরিবহনের একটি গাড়ি তাদের উপর উঠে পড়ে। পরে শহিদুলের স্ত্রী ছিটকে সড়কের পাশে পড়ে গেলেও শহিদুল বাসের সঙ্গে পিষে যায়। পরে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা টেনে হিঁচড়ে নিলে তার মৃত্যু হয়।

এছাড়া ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর রাতে কালিয়াকৈরের ভান্নারা এলাকায় তাকওয়ার চলন্ত বাসে চকলেট বিক্রেতা এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে চালক সাদ্দাম হোসেন। পরে তাকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। এছাড়া ২০২২ সালে মারধরের পর স্বামীকে ফেলে দিয়ে চলন্ত বাসে পোশাককর্মীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তাকওয়া পরিবহনে।

ধর্ষণের ঘটনা ছাড়াও তাকওয়া পরিবহনকে গাজীপুরে মরণযান বলা হয়। এ পরিবহনের বাসের কর্মীদের বিরুদ্ধে ধাক্কা দিয়ে যাত্রী ফেলে পিষে হত্যার রেকর্ড অনেক পুরনো। ২০২২ সালের ৭ জুলাই গাজীপুরে শিববাড়ি এলাকায় ভাড়া নিয়ে বিতণ্ডার জেরে তাকওয়ার বাস থেকে মো. সায়েম নামে এক যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় হেলপার। পরে চালক তাকে পিষে মেরে পালিয়ে যায়। ওই বছরের ১৪ জুলাই শ্রীপুরে এ বাসের চাপায় মারা যান তাসলিমা আক্তার নামে এক পোশাক শ্রমিক।

পরিবহন শ্রমিক ও হাইওয়ে মিনি তাকওয়া পরিবহনের বেশ কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রায় ৬০টি গাড়ি হাইওয়ে মিনি তাকওয়া পরিবহন নাম দিয়ে চলাচল করছে অনেক দিন ধরেই। এসব গাড়ির কোনো ফিটনেস নেই। বেশ কিছু গাড়ি স্থানীয় ওয়ার্কশপগুলাতে নিজস্ব পদ্ধতিতে তৈরি করা। নেশাগ্রস্থ যুবক ও অদক্ষ চালকদের নিয়োগ করা হয়েছে এসব পরিবহনে।

এদের কারণে সড়ক দুর্ঘটনার পাশাপাশি সামাজিক অপরাধও বাড়ছে। এসব পরিবহনের শ্রমিকরাও যাত্রীদের মালামাল, টাকা পয়সা ও মুঠোফোনও ছিনতাই করে মাঝে মধ্যে। প্রতিটি মিনি বাসকে মাসে তিনহাজার টাকা মাসহারা গুনতে হয়। অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে এ টাকার একটি ভাগ যায় হাইওয়ে পুলিশের পকেটে। তারা সরাসরি এসব অবৈধযান চলাচলে সহযোগিতা করেন। এছাড়াও মোড়ে মোড়ে এসব পরিবহন থেকে চাঁদা তোলে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও।

মহাসড়কের নিরপত্তায় মাওনা হাইওয়ে থানার অধিভুক্ত এলাকা হচ্ছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি তুলাফার্ম থেকে মহাসড়কের নাসির গ্লাস পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার। এর পর অংশ ভালুকা ভরাডোবা হাইওয়ে থানার অধীন। ওই দুই থানার অধীনের এলাকায় চলছে অবৈধ যান হাইওয়ে মিনি পরিবহন।

হাইওয়ে মিনি পরিবহনের গাড়ির মালিক আমিনুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, সব কিছু ম্যানেজ করেই চলতে হয়। এর ওপর জায়গায় জায়গায় চাঁদা দিয়ে দিন শেষে যে লাভ হয় কর্মচারীদের বেতন ভাতার পেছনেই ব্যয় হয়ে যায়।

তিনি বলেন, জিপি (চাঁদা) দিলে পুলিশ আমাদের আর হয়রানি করে না, না হলে মামলা দিয়ে দেয়।

হাইওয়ে মিনি পরিবহনের মালিক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, হাইওয়ে মিনি পরিবহনের ৪০-৪৫টি বাস রয়েছে। এসব গাড়ি মহাসড়কে লোকাল বাস হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। তবে ব্যাটারীচালিত অটোরিকশা চলাচলের কারণে অনেক পরিবহন শ্রমিক অটোরিকশা চালাতে চলে গেছে। দক্ষ চালক না থাকায় মালিকরা অদক্ষ চালকদের হাতে গাড়ি তুলে দিয়েছেন। ফিটনেস বিহীন গাড়ি মহাসড়কে কেমন করে চলাচল করে এ বিষয়ে তিনি বলেন, সবাই মিলে মিশেই আমরা গাড়ি চালাই।

হাইওয়ে মিনি চলার পেছনে পুলিশের সহযোগিতার বিষয়ে অভিযোগ অস্বীকার করে মাওনা হাইওয়ে থানার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কংকন কুমার ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমরা এসব অবৈধযানে আটক করে নিয়মিত মামলা দিচ্ছি। একই বক্তব্য দেন ভরাডোবা হাইওয়ে থানার ওসি মাহমুদ।

আরও পড়ুন: জ্বালানি সংকট কেটেছে, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন শুরু

তবে এ বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর রিজিওনের পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, মহাসড়ক নিরাপদ করতে পুলিশ সকল ধরনের অবৈধযান চলাচল বন্ধের বিষয়ে কাজ করছে। আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই কাজ করছি। তবে যদি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায় তবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।

(ঢাকাটাইমস/২৫জুন/এসএম)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
আবু সাঈদ হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে জমা, আসামি ৩০
হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ অতঃপর মন্ত্রী ফরিদুল হক খান দুলাল…
ব্যর্থতা ঢাকতে ট্রাম্প অস্বাভাবিক বাড়িয়ে বলছেন: খামেনি
এখন পর্যন্ত ৬০ হাজার ৫১৩ হাজি দেশে ফিরেছেন
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা