সংলাপ, সমঝোতা ও ক্ষমার ক্ষেত্র হোক প্রসারিত

ভূমধ্যসাগরের উপকূলে প্যালেস্টাইনে ও ইসরাইল জনগণের নিবাস গাজা। সেই ভূখণ্ডে আবার শুরু হয়েছে যুদ্ধ। অত্যন্ত বেদনাদায়ক একটি অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে সেখানে। এই যুদ্ধ আরেকবার প্রমাণ করে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও প্রকৃতপক্ষে আমরা কতটা উন্নত হতে পেরেছি। আমরা কেন মিলেমিশে থাকতে পারি না?
প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিভীষিকাময় অবস্থা থেকে আমাদের সামান্যতম উত্তরণ হলেও সেটা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আমাদের লোভী দৃষ্টি ও প্রতিশোধের মনোভাব বার বার আমাদের মাঝে পশুত্বকে জাগিয়ে দিয়েছে। তাই তো ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয়ে আবার ১৯৭১ সালে আমাদের অস্ত্র ধরতে হয়েছে। এ লড়াইয়ের যেন শেষ নেই!
১৯৯৮ সালে আমাদের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি হয়।যেটাকে বলা হয় শান্তিচুক্তি। আমরা ঐকবদ্ধ হয়েছি একসঙ্গে বসবাস করবো; আমরা একে অপরকে মর্যাদা দেবো, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হবে আমাদের। কিন্তু এখনো সেখানে রক্ত ঝরার সংবাদ শুনতে পাই। পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ কি আমাদেরকে কোনো উন্নতি বা শান্তি দিতে পারছে? আমাদের কী পরিমাণ জায়গা প্রয়োজন?
বিশ্বব্যাপী অশান্তি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে উদ্বিগ্ন করছে। করোনা মহামারী আমাদেরকে তেমন কোনো উপলব্ধি দিতে পারেনি বলেই আমরা যেন আরও নিষ্ঠুর হয়ে গেছি। আমরা কি তবে ধ্বংসের পথে হাটছি!
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর সেই অস্পষ্টতার সুযোগ নিচ্ছে লোভী ব্যাবসায়ীরা।জিনিপত্রের দাম বাড়ছে। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলো প্রয়োগে সফল হচ্ছে বলে মনে হয় না। জনমনে হতাশা জমছে। সহিংসতার আশঙ্কায় আন্তর্জাতিক মহল একটি সমঝোতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টা এখনও কোনো সাফল্যের মুখ দেখেনি। সমঝোতা যে একান্ত জরুরি তা আমাদের সকলকে বুঝতে হবে। নতুবা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংকটে পড়বে।বিগত ২০১৮ সালের নির্বাচনের মধ্যদিয়ে একটি শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। সেটাকে একটি অশুভ মহল নষ্ট করে দেয়। করোনাকালে সরকার একটি উদার অবস্থান গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এক অজানা কারণে আবার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। সরকার সর্বোচ্চ ছাড় কি দেবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। যারা আন্দোলন করছেন তারা অতিমাত্রায় বিদেশ নির্ভর হয়ে পড়েছেন। তাতে করে দূরত্ব আরও বাড়ছে বলেই মনে হচ্ছে।
ক্রমাগত বিশ্ব পরিস্থিতি ঘোলা হয়ে উঠছে। এমন সময় আমাদের সকলের সহনশীল আচরণ প্রয়োজন।দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হরতাল-অবরোধসহ যে হানাহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে—এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি ব্যবস্থা নেন এবং একটি সংলাপের সুযোগ করেন; যেমনটি ২০১৮ সালে করেছিলেন—তবে খুবই উপযুক্ত কাজ হবে।এই সংলাপ প্রতিটি মহল্লায় মহল্লায় হোক। সংলাপ যেকোনো সংকট সমাধানের শান্তিপূর্ণ উপায়।সংলাপ থেকে নির্বাচনি সরকার গঠনের কাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব হবে।
আমরা বাঙালি, আমরা বাংলাদেশি উভয়ই। বিষয়টা দৃষ্টিভঙ্গির।কিন্তু আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক।সমঝোতায় আসতে সরকারকেই ছাড় দিতে হবে। যেভাবে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য জাতিকে ঐকবদ্ধ করেছিলেন সেইরকম একটি ঐক্য আজ সকলের জন্য কাম্য হোক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেভাবে জাতীয় পার্টি ও জাসদকে সঙ্গে নিতে পেরেছিলেন সেভাবে দেশের প্রয়োজনে বিএনপিকেও দেশগড়ার সুযোগ করে দিতে হবে।আমার অভিমত হলো— বিএনপি বিদেশিদের কাছে দৌড়ানো বন্ধ করে জনগণের কাছে যেন ফিরে আসে। আমরা শান্তির বাংলাদেশ চাই।যেভাবে চারিদিকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শুরু হয়েছে তাতে করে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠছে।এমন সময় অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে সামনে নিয়ে আসলে বিরোধ আরও বাড়বে ছাড়া কমবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংস্কারপন্থীদের উদ্দেশে বলেছিলেন—ক্ষমা করে দিয়েছি তবে ভুলে যায়নি।
আমরা জানি, ক্ষমার সীমা যার বড়ো তিনি ততটা মহান। আমরা ৩০ লক্ষ শহিদের কথা ভুলে যাইনি, তবে বঙ্গবন্ধুও কিন্তু পররাষ্ট্রনীতির অংশ হিসেবে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন।বঙ্গবন্ধুর আদর্শ যারা ধারণ করেন তাদের সে আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য বস্তুনিষ্ঠ সংলাপ, সমঝোতা ও ক্ষমার ক্ষেত্র প্রসারিত হওয়া জরুরি। বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে আবেদন—বাংলাদেশের নির্বাচন নয়, প্যালেস্টাইনসহ বিশ^ব্যাপী মানবতাবিরোধী যুদ্ধের অবসানে আপনাদের কার্যকর মনোযোগ সকলের কাম্য। অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ: দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন