জীবন ও জীবিকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ হোক চিরতরে

অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ
  প্রকাশিত : ১৮ নভেম্বর ২০২৩, ১০:১৮
অ- অ+

ভেবেছিলাম কিছুই লিখবো না। রাজনৈতিক লড়াইতে কে কতটুকু যেতে পারে তা চুপচাপ দেখব। কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে একটি সমঝোতা হয়েছিল রাজনীতিবিদের মধ্যে। জনগণ একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল; ভেবেছিলাম হয়তো আমরা সঠিক পথের সন্ধান পেয়েছি। কিন্তু সবকিছুকে জলাঞ্জলি দিয়ে আমরা যা করছি তা যৌক্তিকতার সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছে। এ আর রহমান কবি কাজী নজরুল ইসলামের বজ্রকণ্ঠকে বানিয়ে দিচ্ছেন জারি গান, আর বাংলাদেশে গণতন্ত্র হয়ে যাচ্ছে লেক কালো বিষাক্ত পানিÑ যাকে কালো টাকা, পেশিশক্তি দিয়ে বিভিন্ন সময়ের সামরিক নেতারা কলুষিত করেছেন। ফলে একজন সৎ মানুষ রাজনীতিতে টিকতেই পারছেন না। যার কারণে গণতন্ত্রের থাকছে না কোনো সৌন্দর্য; পান করলে মরতে হবে, মাছ চাষ করলে সেগুলো বাঁচবে না এবং স্নান করলে গায়ে দুর্গন্ধ হবে। সেই ভয়ে সৎ মানুষগুলো দূরে থাকেন। সেসব কারণেই বিরোধী দলের আন্দোলন পদ্মা-মেঘনা না হয়ে রূপ নিয়েছে চোরাগোপ্তা হামলায়; পুড়ছে ট্রেন, বাস, ভাঙছে জাতীয় ঐক্য। হুমকিতে পড়েছে জীবন ও জীবিকা সাধারণ মানুষের।

গত বৃহস্পতিবারের সকাল বেলায় সংবাদে দেখলাম আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো সুলভ মূল্যে সবজি বিক্রি করছে। এর আগে তারা পাড়ায় পাড়ায় নিরাপত্তা রক্ষার কাজ করেছে। এমন একটি কাজকে স্বাগত না জানিয়ে পারছি না। মানবতার সেবায় থাকবে রাজনীতি। সেই রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়েছে। আমি খুবই খুশি হতাম ২০১৮ সালের মতো সকল বিরোধী দলকে যদি কাছে ডাকতেন এবং সকলকে নিয়ে নির্বাচন করতেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার দাবি ছিল সংলাপ, সমঝোতা ও ক্ষমার সীমা বাড়িয়ে রাজনৈতিক ঐক্য সৃষ্টিতে তিনি যেন বিশ্বনন্দিত নেত্রী হিসেবে সকল মহলের আস্থা অর্জনে সফল হন। নিন্দা জানাই সন্ত্রাসবাদকে এবং সহিংসতাকে; নৈরাজ্যের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদারতা যেন কেউ বাধা না দেন সেই দাবি সকলের কাছে।

নিরাপত্তা দেওয়া, জীবন ও জীবিকার ব্যবস্থা করবার মানসে যদি সকল রাজনৈতিক দল জনগণের সেবায় নিবেদিত হয়, তবেই আমরা কাক্সিক্ষত মুক্তি পেতে পারি। আর সেই রাজনৈতিক চেতনা জাগাতেই সংলাপ, সমঝোতা ও ক্ষমার সীমা বাড়ানোতে রাজনৈতিক অঙ্গন হবে কলুষমুক্তÑ যা আমাদের সকলের জন্যই কাম্য। জানি না সেই বোধোদয় আমাদের হবে কি না? সংলাপ, সমঝোতা ও ক্ষমার পরিসীমা বাড়িয়ে এভাবে যদি সকল নৈরাজ্যকে আমরা বিদায় জানাতে পারি, তবে সোনার বাংলা কেবল স্বপ্ন হিসেবে অধরা থাকবে না, অর্জনযোগ্যও হবে।

কিন্তু প্রায়শই ঘটে যায় নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাÑ যেটা কারও কাম্য থাকে না। গত বৃহস্পতিবাবের একটি ঘটনাÑ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান অডিটোরিয়াম। আমার বিভাগের মহিলা শিক্ষককে উঠিয়ে বিভাগের ছাত্রকে বসানো হয়েছে এবং এই কাজটি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর। আশা করি, এই সংবাদটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নজরে পড়েছে। অপেক্ষায় রইলাম কী বিচার সমাজ পায় সেটা দেখার জন্য। সুনাগরিক বানানোর কারিগর শিক্ষক যদি সঠিক দায়িত্ব পালন না করেন, তবে সকল উন্নয়ন চেষ্টা বৃথা যাবে। আমার আবেদন সকল রাজনীতিবিদের কাছে, আসুন আগে সুনাগরিক তৈরি করি তারপর গণতন্ত্রের কথা বলি।

সকল পরিস্থিতিতে জনগণের প্রত্যাশা থাকে সুশাসনÑ যার মুলে আছে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ন্যায়পরায়ণতা, সুষম বণ্টন ও বিভিন্ন প্রকার অধিকারের সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন। এসব বক্তব্য রাজনৈতিক দার্শনিকদের সুচিন্তিত মতামত। সুতরাং সকলের রাজনৈতিক অঙ্গন যাতে কোনোভাবে সংকুচিত না হয় এবং রাজনৈতিক অধিকার ও স্বাধীনতা যাতে ভোগ করতে পারে সেজন্য প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকবে। কাউকে অনুকূল পরিবেশ দেওয়া এবং কাউকে দমন করা যৌক্তিক হয় না। এ কথার মানে এই নয় যে, আমাদের প্রশাসনকে অভিযুক্ত করছি বিরোধীদের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বাধীনতাকে সংকুচিত করবার জন্য।

ডিম ভাজি শিক্ষার কারিকুলম:

সম্প্রতি পত্রিকাতে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় উঠেছে আমাদের নতুন কারিকুলম সম্পর্কে। অভিযোগকারীদের অভিমতÑ আমাদের সন্তানদেরকে স্কুলে পাঠাচ্ছি কাজের বুয়া বানানোর জন্য নয়। শিক্ষা হবে মজাদার। আর ডিম ভাজি করা একটি মজাদার বিষয়; এটা ভেবে কি কারিকুলামে ডিমভাজি যোগ করা হয়েছে? না আসলে তা নয়। তাদেরকে চা বানানো শেখাতে, ভাত রান্না করতে কারিকুলামে ওই সব বিষয় যুক্ত করা হয়নি। না জেনে, না বুঝে সমালোচনা করা হচ্ছে।

আমরা পড়েছি পানির তিনটি অবস্থা। এটি বিজ্ঞান। পানি ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় বাস্প হয়। সে বাষ্প দিয়ে ইঞ্জিন চালানো হয়। সেই ইঞ্জিন দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আর বিদ্যুৎ আমাদের আলো বাতাস যেমন দিয়ে থাকে তেমনি আমাদের রান্না করতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়।

ডিম এর সাদা অংশ কী এবং হলুদ অংশ কী এবং এসবের গুণাগুণ আমাদের জানা প্রয়োজন। ডিম ভাজি আর ভাত রান্না কেবল কাজের বুয়া বানাতে শিক্ষা নয়। এখানে বিজ্ঞানও শেখানো হবে। অনুরূপভাবে কৃষক-মালি-চাষা বানাতে গাছ লাগানো শেখানো হবে না। তাদেরকে মেকানিক্স বানাতে ইঞ্জিন নিয়ে শেখানো হয় না। আমরা বিজ্ঞান ক্লাসে ব্যাঙ কেটেছি, কেঁচোর স্নায়ুতন্ত্র খুঁজেছি, তেলাপোকার পরিপাকতন্ত্র দেখেছি বিজ্ঞান শেখার জন্য এবং আগামীতে ডাক্তার হব সেই স্বপ্ন থেকে।

আমরা খুব করে বলি, আমাদের শিক্ষার উন্নতি হয়েছে। আজ কারিকুলাম নিয়ে যে ঝগড়া করা হচ্ছে সেটা বলছেÑ আমাদের শিক্ষার মান বাড়েনি, কমেছে।

যখন ভাত রান্না করা হয় তখন ঢাকনা নড়তে থাকে। এরপর সেখান দিয়ে বাস্প উঠে। কীভাবে গতি সৃষ্টি হয় সেটা শিখতে পারে একজন শিশু। সেটাকে বিজ্ঞানের আলোকে শিক্ষক শেখাবেন তাতে কোনো ত্রুটি নেই। আশা করি, সমালোচকরা বুঝবেন।

অবরোধে ক্ষতি কার?

একজন লিখছে অবরোধে সবকিছু চলছে। হ্যাঁ অবরোধের আগে আমি প্রেসক্লাব থেকে কাঁটাবন আসতে এক ঘণ্টা বাসে বসে থাকতাম। এখন মাত্র ৫ মিনিটে চলে আসি। অনেকেই বলার চেষ্টা করছেনÑ অবরোধ জনগণ ও সরকারের উপকার করছে। এতে করে জ্বালানি ব্যয় কমেছে, ডলারে চাপ কমেছে এবং ভোগের প্রবণতা কমেছে। ওই যে কথায় আছে প্রত্যেক কাজের একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। একটি পত্রিকায় দেখলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আইটি উপদেষ্টা বলেছেন, চারদিনের অবরোধে ৪.৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। সুতরাং, প্রশ্ন হলো অবরোধে সবকিছু স্বাভাবিক বলে যারা দাবি করছেন তারা সরকারি দলের লোক না কি হাইব্রিড?

গাজায় পথে-ঘাটে লাশ পড়ে আছে:

হে দূতেরা, হে রাজনীতিবিদ, হে শিক্ষকÑ আপনারা কি দেখেছেন, গাজার পথে-ঘাটে লাশ পড়ে আছে। আসুন মানবতার এই ক্রান্তিকালে স্বার্থের ভুতকে তাড়িয়ে শান্তির পথ খুঁজি এবং বিশ্বকে শান্তির নিবাসে পরিণত করি। এভাবে কি একটি জাতিকে যুগের পর যুগ লড়তে লড়তে প্রাণ দিতে হবে? আসুন নিজেদের কাছে প্রশ্ন করিÑ আমি কি সঠিক কাজটি করছি বা করবার সুযোগ পাচ্ছি ? জীবন ও জীবিকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ হোক চিরতরে। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জীবনযাপন যদি হয় রাজনীতির উদ্দেশ্য তবে কেন এই হানাহানি? আসুন, আলিঙ্গন করে ত্যাগের মহিমায় জীবনকে করি ধন্য। পুনর্ব্যক্ত করিÑ জীবন ও জীবিকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ হোক চিরতরে সারা পৃথিবী থেকে।

অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ: দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
রেললাইনে ভিডিও করতে গিয়ে ফটোগ্রাফারের মর্মান্তিক মৃত্যু
‘সাময়িকভাবে’ ফ্লাইট বন্ধ করলো নভোএয়ার
সিরাজগঞ্জে নেশার টাকা না দেওয়ায় ছেলের মারধরে প্রাণ গেল বাবার, মা আহত
আফতাবনগরে পশুর হাট না বসানোর দাবিতে মানববন্ধন
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা