ভেষজ ঔষধি রঙিন ফুলকপি ক্যানসার প্রতিরোধ করে
স্বাস্থ্য রক্ষায় ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহারের ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসের মতোই সুপ্রাচীন। সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ভেষজ ওষুধ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। প্রাচীনকাল থেকে ফুলকপি অত্যন্ত কার্যকরী ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে পরিচিত। শীতকালীন সবজির মধ্যে অন্যতম সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর হচ্ছে ফুলকপি। ফুলকপিকে খাদ্যতালিকায় সুপারফুড বলা হয়। যেটিতে ভিটামিন, খনিজ এবং অন্যান্য পুষ্টিকর অণু রয়েছে। ফুলকপি হল ভাত এবং পিৎজা ক্রাস্টের মতো কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবারের উপযুক্ত বিকল্প। সাধারণত রান্না করে, সালাদের সঙ্গে মিশিয়ে বা ভেজে, নানান ধরনের সুপ তৈরি করে বিভিন্নভাবে ফুলকপি খাওয়া যায়। ফুলকপির ফুল অর্থাৎ সাদা অংশটুকু বেশি খাওয়া হলেও এর চারপাশের ঘিরে থাকা ডাটা ও পাতা দিয়ে তৈরি হয় সবজি ভাজি ও স্যুপের মতই খাবার। ফুলের মতন অংশটুকু শুধু সাদা হয় হয় না, কমলা-সবুজ-হলুদ-বেগুনি রঙের ফুলকপিও জন্মায় বিশ্বজুড়ে।
শীতের শুরুতে নানা রঙের ফুলকপি সবজির বাজারে ক্রমশ জনপ্রিয় ও সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। রঙিন ফুলকপি সবজি নজর কাড়ছে সবার। অনেকে একে বলে রেনবো ফুলকপি, অনেকে বলে রঙিন ফুলকপি, অনেকে বলে বিদেশি ফুলকপি। গত কয়েক বছর ধরে বাজারে আসছে এই ধরণের রঙিন ফুলকপি। চিরন্তন সাদা রঙের ফুলকপির পাশাপাশি বাজারে দেখা মিলছে হলুদ, সবুজ, বেগুনি রঙের ফুলকপি। এই রঙিন ফুলকপি মন ভরাতে পেরেছে খাদ্যপ্রেমীদের।
উপজেলা কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দেখতে হলুদ ও বেগুনি রংয়ের ‘রঙিন’ ফুলকপির বাংলাদেশে চাষাবাদ শুরু হয় ২০২১ সালে। বিভিন্ন জেলায় রঙিন ফুলকপি চাষ শুরুর পর ব্যাপক সাড়া পড়েছে আশাপাশের সব গ্রামে। রঙিন এসব ফুলকপির সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিনই এলাকার কৃষকসহ সাধারণ মানুষ জমিতে ভিড় করছেন। কেউ নিচ্ছেন চাষের পরামর্শ আবার কেউ কেউ তুলছেন ছবি। তাছাড়া বাজারে নেয়া মাত্রই বিক্রি হয়ে যায় এসব রঙিন ফুলকপি।
রঙিন ফুলকপিও সাদা ফুলকপির মতোই। এরা ‘ক্রুসিফেরাস উদ্ভিদ’ পরিবারের সদস্য। স্বাদে এবং গঠনে কোনো সাদা ফুলকপি থেকে আলাদা করা যায় না তাদের। আলাদা শুধু রঙে। এ ছাড়া পুষ্টিমূল্যের সামান্য পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কৃষি বিজ্ঞানীদের এক আশ্চর্যজনক বৈকল্পিক পদক্ষেপ। যার দ্বারা ঐতিহ্যবাহী সাদা ফুলকপিগুলোকে পরিবর্তিত করে কমলা, বেগুনি এবং সবুজ করা হচ্ছে।
রঙিন ফুলকপির আদিনিবাস ইটালি ও দক্ষিণ আফ্রিকা। ফুলকপির বৈজ্ঞানিক নাম ব্রাসিকা অলিরাসিয়া। ফুলকপিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে। রঙিন ফুল কপি মূলত অ্যান্টোসায়ানিন থেকে তার সুন্দর ও আকর্ষণীয় রঙ পায়। এর স্বাস্থ্য গুনাগুন অন্য যেকোনো কপির তুলনায় বেশি। অ্যান্টোসায়ানিন একটি অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ফ্ল্যাভোনয়েড যা ফেনোলিক অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট গ্রুপের অর্ন্তগত। এর উপকারিতা হলো- রক্তনালির ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। এটি কোলাজেন ধ্বংস করে যা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। রঙিন ফুলকপিতে সাধারণ ফুল কপির তুলনায় পঁচিশ শতাংশেরও বেশি ক্যারেটিন রয়েছে যা ত্বক ও চোখকে ভালো রাখে। এদিকে অ্যান্টোসায়ানিনগুলো তাদের শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি বলা যায় সবজিটি রঙে স্বাদে ও ভেষজ ঔষধি গুণে ভরপুর।
বিজ্ঞানীদের মতে, ফুলকপির কচি পাতা সপ্তাহে এক আউন্সের কিছু বেশি খেলে তার দেহে ক্যানসারের ঝুঁকি অর্ধেক কমতে পারে। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, ফুলকপির কচি পাতা থেকে সংগৃহীত আইসো থায়োসায়ানেটস নির্যাস প্রয়োগে ওদের বুকের টিউমারের আকার ও সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে, যা ক্যানসারে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা ছিল। ফুলকপির পাতায় প্রচুর ভিটামিন ‘এ’ ক্যালসিয়াম, খাদ্যশক্তি ও আয়রন আছে। এতে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কালো কচুশাকের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ, সবুজ কচুশাকের চেয়ে প্রায় ৩ গুণ, লালশাকের চেয়ে দ্বিগুণ, কলমিশাকের চেয়ে ৬ গুণ, পুঁই ও পাটশাকের চেয়ে ৭ গুণ, পালং ও ডাঁটা শাকের চেয়ে ৮ গুণ, মুলাশাকের চেয়ে ২৫ গুণ ও গরুর দুধের চেয়ে ৫ গুণ বেশি আছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ফুলকপিকে পুষ্টির সুপারস্টার হিসাবে গণ্য করা হয় কারণ এটি পুষ্টিতে ঘন। এটিতে উচ্চ ফাইবার সামগ্রী এবং বি এবং সি এর মতো ভিটামিন রয়েছে। এটিতে ক্যারোটিনয়েড (অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট) এবং গ্লুকোসিনোলেটের সমৃদ্ধ ঘনত্বও রয়েছে। যদিও এই দুটি যৌগই ক্যানসার বিরোধী বৈশিষ্ট্যের জন্য পরিচিত।
আমেরিকান কলেজ অফ নিউট্রিশন-এর তথ্য, যারা নিয়মিত ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খান তাদের হার্টের অসুখের ঝুঁকিও অনেক কম। এছাড়া ফুলকপিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন কে রয়েছে। যা ব্লাড ক্লটকে ঠিক করে হার্টের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে খুব কার্যকর।
ফুলকপির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান শরীর পরিষ্কারে সাহায্য করে। এছাড়াও এতে গ্লুকোসাইনোলেটস থাকে যা এনজাইমকে সক্রিয় করে এবং ডিটক্স হতে সাহায্য করে।
ফুলকপির পাতার উপরিভাগে ক্যানসার নিরোধক উপাদান পেয়েছেন বলে একদল বিজ্ঞানী জানিয়েছেন। গবেষণায় দেখেছেন, কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অর্ধেক কমাতে হলে সপ্তাহে প্রায় এক কেজি ফুলকপি এবং সমজাতীয় শাকসবজি খেতে হবে। ফুলকপির কচি পাতা সপ্তাহে প্রায় ৩০ গ্রাম পরিমাণে খেলে ওই ক্যানসারের ঝুঁকি অর্ধেক কমতে পারে। আরেক গবেষণায় দেখা যায়, ফুলকপির কচি পাতা থেকে সংগৃহীত আইসো থায়োসায়ানেটস নির্যাস প্রয়োগে বুকের টিউমারের আকার ও সংখ্যা কমে। এসব টি’উমার ক্যানসারে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা ছিল।
মূত্রথলি ও নারীদের প্রোস্টেট, স্তন ও ডিম্বাশয় ক্যান্সার প্রতিরোধে ফুলকপির ভূমিকা অপরিসীম। ফুলকপিতে সালফারের যৌগ সালফোরাফেন থাকে যা ব্লাড প্রেশারের উন্নতিতে সাহায্য করে। গবেষণা মতে সালফোরাফেন ডিএনএ এর মিথাইলেশনের সঙ্গে সম্পর্কিত যা কোষের স্বাভাবিক কাজের জন্য এবং জিনের সঠিক প্রকাশের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। বিশেষ করে ধমনীর ভেতরের প্রাচীরের। সালফোরাফেন ক্যানসার সৃষ্টিকারী কোষ ধ্বংস করতে পারে এবং টিউমারের বৃদ্ধিকে বাঁধা দেয়।
অন্য এক গবেষণায় জানা যায় যে, ফুলকপির সঙ্গে হলুদ যোগ করে গ্রহণ করলে প্রোস্টেট ক্যানসার নিরাময়ে ও প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
যেকোনও ধরনের ফুলকপিতেই কোসিনোলেট’ নামক প্রাকৃতিক উপাদান থাকলেও রঙিন ফুলকপিতে রয়েছে বেশি পরিমাণে যা মানবশরীরে প্রবেশ করে‘আইসোথিয়োসিয়ানেট তৈরি করে। এটি অতি শক্তিশালী অ্যান্টি ক্যানসারাস উপাদান। যা শরীরে ক্যানসার সেল সৃষ্টিকারী উপাদানকে সহজেই বিনষ্ট করতে সক্ষম।
ফুলকপি ওজন কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও ফুলকপিতে ভিটামিন বি, সি এবং কে রয়েছে। যা সর্দি, কাশি, জ্বর, গা-ব্যথা ইত্যাদি সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। এমনকি আমাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ করে ফুলকপি।
বেগুনি কপির মধ্যে অ্যান্থাসোয়ানিন নামক রঞ্জক বর্তমান। যা ব্রেনের জন্য খুবই ভাল। এছাড়া ক্যারোটিনয়েডের সঙ্গে ফ্লাভোনয়েডও রয়েছে হলুদ ও বেগুনি ফুলকপিতে যা চোখ ভাল রাখতে কার্যকারি। গবেষণায় দেখা গেছে অ্যান্থাসোয়ানিন অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসাবে দারুণ কাজ করে। রিউমাটয়েড আথ্রাইটিসে আক্রান্ত-দের জন্য খুব উপকারী।
অভিনব ‘রেনবো ফুলকপি’ স্বাদে হয়তো রয়েছে একই রকম, কিন্তু রঙের গুণে তা সহজেই খাবার টেবিলে অন্য চমক তৈরি করছে। এই রঙিন কপিগুলো হলো কৃষির বিশেষ প্রজননের ফলাফল। কিছু বিজ্ঞানী এমন দাবি করেছেন যে, এই নতুন ফুলকপিগুলো যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর।
কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, সাদা ফুলকপিগুলোকে সূর্যের আলো থেকে দূরে রাখা হতো যাতে আলোর প্রভাবে সাদা ফুলকপিগুলো হলুদ রঙে পরিণত না হতে পারে। তাই পুরোনো জাতগুলোকে ব্লাঞ্চ করার দরকার পড়ত (আলোর অনুপ্রবেশের পরিমাণ কমাতে ভিতরের পাতাগুলো ছোট মাথার উপর আলগাভাবে বাঁধা হয়)। কিন্তু নতুন জাতগুলো নিজে থেকেই ব্লাঞ্চিং হয়। কারণ গাছপালা অভ্যন্তরীণ পাতা তৈরি করে যা আলোর অনুপ্রবেশ রোধ করে মাথাকে শক্তভাবে ধরে রাখতে পারে।
বেগুনি ফুলকপি তার রঙ পায় ‘অ্যান্থোসায়ানিন’ থেকে, এটি একটি প্রাকৃতিক ফাইটোকেমিক্যাল যা অন্যান্য লাল, নীল বা বেগুনি রঙের ফল এবং সবজির পাশাপাশি লাল ওয়াইনেও পাওয়া যায়।
কমলা ফুলকপির রঙের পিছনে ‘ক্যারোটিনয়েড’-এর ভূমিকা রয়েছে। এই ক্যারোটিনয়েডগুলি গাজর, স্কোয়াশ এবং অন্যান্য হলুদ শাকসবজি এবং ফলগুলোতেও পাওয়া যায়। কমলা ফুলকপি আসলে একটি জেনেটিক মিউটেশন হিসেবে এসেছে যা এটিকে তার সাদা অংশের তুলনায় বেশি বিটা ক্যারোটিন ধারণ করতে দেয়।
কমলা ফুলকপিতে বিটা ক্যারোটিন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় থাকে। এটি ভিটামিন এ-এর একটি রূপ যা ত্বককে স্বাস্থ্যকর করে। বেগুনি রঙটি আসে অ্যান্থোসায়ানিন থেকে, যা রক্ত জমাট বাঁধা কমিয়ে হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। আমেরিকায় কমলা ফুলকপির পরীক্ষায় দেখা গেছে যে সাধারণ ফুলকপির তুলনায় এতে বিটা ক্যারোটিনের ঘনত্ব প্রায় ২৫ গুণ বেশি থাকে।
সবুজ রঙের ফুলকপি, ‘ব্রোকোফ্লাওয়ার’ নামেও পরিচিত, যা ব্রকলি এবং ফুলকপির একটি সংকর। সবুজ ফুলকপিতে সাদা ফুলকপির চেয়ে বেশি বিটা ক্যারোটিন থাকে, তবে তা ব্রকলির চেয়ে কম।
পুষ্টিবিদদের মতে, যে রঙেরই ফুলকপি হোক না কেন তাতে পুষ্টিগুণ একই থাকে। আবার সবগুলোই শরীরের জন্য দারুণ উপকারী। জানলে অবাক হবেন, সাদার চেয়ে রঙিন ফুলকপিতে একটু বেশিই পুষ্টিগুণ থাকে। আপনি যে রঙেরই ফুলকপি খান না কেন, তাতে কমবেশি সব পুষ্টিগুণই পাবেন। যা ক্যানসার প্রতিরোধী, ফাইবার সমৃদ্ধ, ভিটামিন কে ও সি’তে ভরপুর।
(ঢাকাটাইমস/১৩ নভেম্বর/আরজেড)
মন্তব্য করুন