ফিরে দেখা ২০২৪

দেড়যুগ পর টার্নিং পয়েন্ট বিএনপির, আন্দোলনের ফসল পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস

জাহিদ বিপ্লব, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:০৭| আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫:১০
অ- অ+

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের গত দুই মেয়াদে নানা ধরনের চাপের মধ্যে ছিল বিএনপি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০২৪ সালের শুরু থেকেও হামলা, মামলা, গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করতে না পারাসহ নানা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকার হয় দলটি। তবে এই ঘটনাবহুল ২০২৪ সালই বিএনপির জন্য টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বছরের শেষে দীর্ঘ দেড়যুগ ধরে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ফসল পেয়েছে দলটি, যার মধ্য দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে দলের নেতাকর্মীরা। একই সঙ্গে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বর্তমানে দেশ গঠনের কাজে অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। দলটির এই দীর্ঘ লড়াইয়ে পারি দিতে হয়েছে নানা চড়াই-উতরাই। বারবার হতে হয়েছে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীকে অসংখ্য মামলা মাথায় নিয়ে লড়তে হয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, বিশ্বে সাড়া জাগানো অভ্যুত্থানগুলো মধ্যে একটি। জুলাই-আগস্টের অভূতপূর্ব গণজাগরণের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের জোর করে চেপে বসা শাসনের অবসান হয়। যার মধ্য দিয়ে লম্বা সময় পর, দেশ গঠনের লক্ষ্যে ক্ষমতার খুব কাছাকাছি প্রধান শক্তি হয়ে দাড়িয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তবুও, নির্বাচন ও ক্ষমতায় আসতে চ্যালেঞ্জ দেখছে দলটি। বিএনপির তৃণমূল, শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সচেতন মহল বলছে, ২০২৪ বিএনপির সম্ভাবনার দুয়ার খুললেও এখনো কঠিন পরীক্ষায় দলটি।

২০২৪ এর শুরুতে বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে তৎকালীন আওয়ামী সরকারের নানান চাপ মোকাবেলায় হিমশিম খেয়েছে। তবে, বছরের শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে হাসিনার পতনের ফলে দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এতে দলটির অনেক নেতাকর্মীর প্রাণহানি ঘটে। তবে এতে দেশ গঠনের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদেরকে আত্মপ্রকাশ করে বিএনপি।

২০২৪ কেমন গেল বিএনপির

বছরের শুরুতে চরম চাপে ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। তবে শেষের দিকে ঘুরে দাঁড়ায় দলটি। যদিও এখনো নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। বিএনপি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা বলছেন, ‘ শেষ ভালো যার সব ভালো তার’। দলটির জন্য ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঠিক সেই প্রবাদেরই প্রতিফলন ঘটেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের এ যুগান্তকারী ঘটনায় ‘সুদেআসলে’ লাভবান হওয়ার পথ তৈরি হয়েছে বিএনপির ক্ষেত্রে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বছরের শুরুতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের নানা ধরনের চাপ মোকাবেলা করতে হিমশিম খেয়েছে বিএনপি। আর বছরের শেষভাগে এসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে পতন হয়েছে দীর্ঘ ১৬ বছরের শেখ হাসিনা সরকারের। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বর্তমানে দেশ গঠনের কাজে প্রধান শক্তি হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করেছে বিএনপি। চলতি বছরের শুরুতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নানা ধরনের কর্মসূচি হাতে নেয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে রাজধানীসহ সারা দেশে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, গণমিছিল, গণসংযোগ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন ধরনের গণমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে দলটি। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হয় দলটি। এতে আহত হন হাজার হাজার নেতাকর্মী। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীকেও কারাবরণ করতে হয়। এসব কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় দলটিকে। তবে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটে ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনে পতিত স্বৈরাচারী সরকার পতনের মধ্য দিয়ে। মূলত এরপর থেকেই ১৭ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ফুরফুরে অবস্থানে রয়েছে বিএনপি। যেখানে দলটির নেতাকর্মীকে আন্দোলন কর্মসূচিতে সঠিকভাবে পাওয়া যেত না, সেখানে এখন নেতাকর্মীদের দখলে রাজপথ থেকে অলিগলি পর্যন্ত।

৫ আগস্টের পর রাতারাতি পাল্টে যায় ভাগ্য

ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। দলীয় নেতাকর্মীদের রেখে স্বৈরাচার তকমা পাওয়া সাবেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে যান ভারতে। এতে রাতারাতি পাল্টে যায় বিএনপির ভাগ্য। ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে সাজা থেকে মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। একই সঙ্গে কারাগার থেকে মুক্তি পান দলটির কয়েক হাজার হাজার নেতাকর্মী। বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘ সময় বিদেশে অবস্থান নেওয়া দলটির নেতাকর্মীরাও দেশে ফিরতে থাকেন। দলটির পছন্দের লোকজন দায়িত্ব পান রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। বলা যায়, আগামী দিনে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে বিএনপি।

নির্বাচন সামনে রেখে দল গোছানোর ব্যস্ততা

আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দল গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন বিএনপি নেতারা। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও হচ্ছে সভা-সমাবেশ। আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে কোণঠাসা হয়ে পড়া বিএনপির পালে হাওয়া লেগেছে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে মাঠের রাজনীতিতে। তবে রাষ্ট্র পুনর্গঠনে দলটির সামনে এখনো রয়েছে নানামুখী চ্যালেঞ্জ।

এসব বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপিকে এখন সংগঠন গুছিয়ে নিয়ে এসে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। তবে বিগত দিনে দেওয়া ৩১ দফার রূপরেখা যে ‘কথার কথা’ নয়, তা প্রমাণ করতে হবে কাজের মাধ্যমে। তাদের সংস্কার প্রস্তাবগুলো নতুন আঙ্গিকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে।

নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে বিএনপির ব্যর্থতা, সামনে যে চ্যালেঞ্জ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ভিন্ন রকম এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে বিএনপি। আগামী নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র সংস্কারের ব্যাপারে নিজেদের প্রস্তাবনা ও দলীয় নেতাকর্মীর কর্মকাণ্ড দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে দলটিকে। রাজনীতিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ এখন কঠিন সংকটে। এবারের নির্বাচনে সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় নামতে হতে পারে বিএনপিকে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলকে নিয়ে ইসলামী ফ্রন্ট এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-তরুণদের সম্ভাব্য নতুন দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হতে পারে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলটিকে। একই সঙ্গে বিএনপিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে নিয়ে যেতে হবে দেশকে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, দেশের সামরিক-বেসামরিক শক্তি ও সুশীল সমাজের সমর্থন আদায়ও করতে হবে। সঙ্গে রয়েছে লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ।

বিগত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে আন্দোলন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। দ্বাদশ সংসদের একতরফা নির্বাচনের ছয় মাসের মাথায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতনে বদলে যায় দৃশ্যপট। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারামুক্ত হন। রাজনৈতিক মামলায় দলের কারাবন্দি সর্বস্তরের নেতাকর্মীও বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে দলটির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠছে। এতে দলটি আবার জনপ্রিয়তা হারানোর চ্যালেঞ্জে পড়েছে। যদিও হাইকমান্ড কঠোর অবস্থান নিয়ে অনেককে বহিষ্কার করেছেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বড় লাভবান বিএনপি

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যাওয়ার পরে যে দুটো রাজনৈতিক দল সবচেয়ে লাভবান হয়েছে সেগুলো হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগবিরোধীদের দখলে চলে গেছে। ৫ আগস্টের পরে বেশ দ্রুততার সঙ্গে বিএনপি নেতা খালেদা জিয়াকে মুক্তির আদেশে স্বাক্ষর করেন রাষ্ট্রপতি। এরপর বেশ কিছু সিনিয়র নেতা কারাগার থেকে দ্রুত ছাড়া পান। অনেকে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।

লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য-বিবৃতি শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রচার করা নিষিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারিত হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের এখন আর পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে না। এসব কিছু বিএনপিকে তাৎক্ষণিকভাবে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছে। গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের শাসনামলকে ফ্যাসিবাদের সঙ্গে তুলনা করেছে বিএনপি। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরে বিএনপির দেওয়া ‘ফ্যাসিবাদ তকমা অনেকেই ব্যবহার করছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে।

খালেদা জিয়ার মুক্তি ও রাজনীতিতে ফেরা নিয়ে সংশয়

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুদকের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে পাঠানো হয় বেগম খালেদা জিয়াকে। দুই বছরের বেশি সময় কারাভোগের পর করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার শর্তসাপেক্ষে তাকে সাময়িক মুক্তি দেয়। তারপর বিভিন্ন সময় তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হলেও শর্ত অনুযায়ী তাকে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হয়েছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। প্রায় সাত বছর পর গত ৭ আগস্ট বিএনপির জনসভায় খালেদা জিয়ার ভিডিওতে ধারণকৃত বক্তব্য প্রচার করা হয়। আর একযুগ পর গত ২১ নভেম্বর সেনাকুঞ্জে অনুষ্ঠিত সশস্ত্র বাহিনী দিবসে যোগ দেন তিনি। তবে তার শারীরিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা সমালোচনা সৃষ্টি হয় এবং নানা ধরনের সংশয় তৈরি হয়।

তারেক রহমানের ফেরার প্রসঙ্গ

আইনের দৃষ্টিতে পলাতক থাকা অবস্থায় তারেক রহমানের বক্তব্য বা বিবৃতি প্রচারে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাসরিন সিদ্দিকী একটি রিট দায়ের করেন। পরের দিন হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। তারেক রহমানের সব ধরনের বক্তব্য ও বিবৃতি গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়। গত বছরের আগস্টে রিট আবেদনকারী সম্পূরক আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৮ আগস্ট এক আদেশে হাইকোর্ট তারেক রহমানের বক্তব্য, বিবৃতি, অডিও ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে সরাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দেয়। কিন্তু ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের কিছুক্ষণ পর গণমাধ্যমগুলো তারেক রহমানের বক্তব্য ও ভিডিও প্রচার শুরু করে। ফলে, প্রায় ১০ বছর পর গণমাধ্যমে ফিরে আসেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।

উন্মুক্ত রাজনীতিতে ফিরে সারাদেশে বাধাহীন পরিবেশে কর্মসূচি পালন

বিগত এক যুগের বেশি সময় অর্থাৎ ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত যে কোনো রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া বিএনপির জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। অনেক সময় আবেদন করেও পাওয়া যেত না অনুমতি। আবার দেওয়া হলেও সেটা কর্মসূচি শুরুর এক কিংবা দুই ঘণ্টা আগে। পাশাপাশি পুলিশের বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কর্মসূচি শেষ করা, কর্মসূচির মাঝপথে হামলার ভয় ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। সেই হামলায় উল্টো আসামি করা হতো বিএনপির নেতাকর্মীদের। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপির সেই অবস্থা কেটে গেছে। এখন সারাদেশে বাধাহীন পরিবেশে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে দলটি।

আলোচনার শীর্ষে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা, জেল ও মুক্তি

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও আমীর খসরুকে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ কর্মসূচির পরপর গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ২০২৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান তারা। প্রায় সাড়ে তিন মাস কারাগারে ছিলেন তারা। এছাড়া নানা অভিযোগে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, রুহুল কবির রিজভী, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আমান উল্লাহ আমান, শাহজাহান ওমর (দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হন তিনি), মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ শীর্ষস্থানীয় সব নেতার বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের হয়। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা, জেল ও মুক্তির বিষয়টি ছিল ২০২৪ সালের বড় আলোচনা।

৭ জানুয়ারির ভোটবর্জন ও ৩৫ সিনিয়র নেতা কারাবন্দি

চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির ৩৫ সিনিয়র নেতাকে কারাগারে বন্দি রাখা হয়। এছাড়া মধ্যম সারি ও তৃণমূলের অন্তত ৩০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিএনপি দেশবাসীকে নির্বাচনের ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ৬ জানুয়ারি ভোর ৬টা থেকে ৮ জানুয়ারি ভোর ৬টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালন করে। এরপর ১১ জানুয়ারি বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে দীর্ঘ ৭৫ দিন বন্ধ থাকার পর মূল ফটকের তালা ভেঙে প্রবেশ করেন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটবর্জন ও ৩৫ সিনিয়র নেতাকে কারাবন্দি করার ঘটনাটি দেশবিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।

ভারতীয় পণ্য বয়কট প্রচারাঅভিযানে সমর্থন

চলতি বছর মার্চ মাসে ভারতীয় পণ্য বয়কট বা প্রচারাভিযানে সমর্থন দেয় বিএনপি। এছাড়া এই কর্মসূচিতে ৬৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটও সমর্থন দেয়। মূলত, বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়েছে- এমন অভিযোগে নির্বাচনের পরপরই সামাজিক মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য বয়কট বা ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারাভিযান শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা। ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণায় জনগণের মধ্যে ব্যাপক আস্থার জায়গা করে নেয় দলটি।

বিএনপি ভাঙার তৎপরতা ঠেকানোর চ্যালেঞ্জ

গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে বিএনপি ভাঙার তৎপরতা ছিল। তাতে কোনো মহলই সফল হয়নি। নানা চাপ ও প্রলোভন থাকার পরও ‘দল ভাঙার প্রকল্পবাস্তবায়ন করা যায়নি। দল ভাঙার তৎপরতার অংশ হিসেবে শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের গ্রেপ্তার, মামলা এবং কয়েকশ নেতাকর্মীকে সাজা দেওয়া হয়। নেতাদের ভোটে নিতে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম ও বিএসপি নামে কিংস পার্টি গঠন করা করা। এতেও সারা মেলেনি। শুধু ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, একরামুজ্জামান ও শাহ আবু জাফর ছাড়া আর কাউকে দল থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। ফলে শেখ হাসিনা সরকারের সব পরিকল্পনাই ভেস্তে যায়। তখন সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা বিএনপির জন্য এটিই বড় ধরনের সাফল্য ছিল।

কোটাবিরোধী আন্দোলনে সমর্থন, টার্গেট দীর্ঘদিনের আন্দোলনের সফলতা

গত ৬ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন দেয় বিএনপি। পরে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে প্ল্যাটফরম তৈরি করেন। একের পর এক কর্মসূচি দেন। আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হয় বিএনপির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সারা দেশ যখন উত্তাল, তখন সর্বশক্তি দিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক আসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনে সবস্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের অংশ নেওয়ার নির্দেশ দেন। ৪ আগস্ট ছাত্ররা ‘মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি পালন করে। সেদিন ছিল আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। ওইদিন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা মাঠে থেকে বড় ভূমিকা পালন করেন। এতে নিহত হন দলটির প্রায় ৫০০ নেতাকর্মী। এরপর জনগণের হৃদয়ে জায়গা করে দলটি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বিএনপি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ভিন্ন রকম এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বিএনপি। আগামী নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র সংস্কারের ব্যাপারে নিজেদের প্রস্তাবনা ও দলীয় নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ড দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে দলটিকে। নির্বাচনে সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় জামায়াতে ইসলামীসহ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-তরুণদের সম্ভাব্য নতুন দলের মুখোমুখি হতে হবে। একই সঙ্গে বিএনপিকে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে নিয়ে যেতে হবে দেশকে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, “দেশের মানুষের মাথার ওপর এক ধরনের জগদ্দল পাথর চেপে বসেছিল। ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালানোর পর মানুষ স্বস্তিতে ফিরেছে। তবে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত শতভাগ সাফল্য আসবে না। সে কারণে যত দ্রুত সম্ভব জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত।”

দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, “১৬ বছরে আওয়ামী লীগ দেশের প্রতিটি সেক্টর ধ্বংস করে দিয়েছে। এ অবস্থায় আগামীতে জনগণের ভোটে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলে বিএনপিকে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। তবে, বিএনপি তারেক রহমানের নেতৃত্বে সব চ্যলেঞ্জ মোকাবেলা করে জনগণের স্বপ্ন পূরণ করে আগামীর রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।”

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক ঢাকা টাইমসকে বলেন, “১৫ বছরের স্বৈরশাসকের দোসররা এখনো দেশের প্রতিটি সেক্টরে ঘাপটি মেরে রয়েছে। এদের চিরতরে বিদায় করতে না পারলে প্রকৃত শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না।”

তিনি বলেন, “বিএনপির দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে ৫ আগস্ট হয়েছে।”

বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশের মানুষ শান্তিতে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

(ঢাকাটাইমস/৩১ডিসেম্বর/জেবি/এফএ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
আধুনিক বিমান বাহিনী গড়ে তুলতে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে: প্রধান উপদেষ্টা
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন 
ক্রান্তিকালে দেশ, আয় কমছে শ্রমজীবী মানুষের: রিজভী
পিপিএম পদক পেলেন এসপি কুদরত-ই-খুদা
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা