বাদী জানেন না অনেক বিষয়
ফরিদপুরে আ.লীগ-বিএনপির ১৭০ নেতাকর্মীর নামে মামলা, মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক সাংবাদিক স্কুলছাত্র আসামি

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার, সাংবাদিক ও শিক্ষকসহ আওয়ামী লীগ-বিএনপির ১৭০ নেতাকর্মীর নামে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে থানায় মামলা হয়েছে। মামলায় আরও আড়াই-তিন হাজার অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। মামলার একজন আসামি ওয়ার্ড যুবদলের এক নেতাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে আলফাডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারুন-অর রশীদ জানান, গত বৃস্পতিবার রাতে পৌরসদরের বুড়াইচ এলাকার ইদ্রিস সর্দারের ছেলে বিএনপির সমর্থক দিনমজুর লাভলু সর্দার বাদি হয়ে মামলাটি করেন।
মামলার তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, স্কুলছাত্র, বিদেশফেরত যুবক এবং বেশ কয়েকজন বয়োবৃদ্ধের নাম রয়েছে। আসামির নামের তালিকায় বিএনপি ও যুবদলের বেশ কজনের নামও পাওয়া গেছে।
শনিবার সকালে পুলিশ আলফাডাঙ্গা পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সহ-সভাপতি ও পৌরসদরের ইছাপাশা গ্রামের তফসীর উদ্দিনের ছেলে মো. ইকবাল জিহাদীকে (৪০) গ্রেপ্তার করে। পৌর যুবদলের কমিটিতে ইকবালের থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন আলফাডাঙ্গা পৌর যুবদলের আহ্বায়ক সৈয়দ মিজানুর রহমান।
জানা যায়, মামলাটিতে প্রধান আসামি করা হয় আলফাডাঙ্গা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র মো. সাইফুর রহমান সাইফারকে। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আকরাম হোসেনের ভাতিজা। তিন নম্বর আসামি পার্শ্ববর্তী বোয়ালমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সদ্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এম এম মোশাররফ হোসেন মুসা মিয়া। ৪ নম্বরে রয়েছে বোয়ালমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান মীরদাহ পিকুলুর নাম। আলফাডাঙ্গার সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিদ্দিকুর রহমান ২৩ নম্বর আসামি।
আসামির তালিকায় সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন আলফাডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সভাপতি এনায়েত হোসেন (২ নম্বর আসামি), দপ্তর সম্পাদক ঢাকা টাইমস প্রতিনিধি রিয়াজুল ইসলাম (রিয়াজ মুস্তাফিজ, ১০৫ নম্বর), প্রেসক্লাবের কার্যকরী সদস্য কামরুল ইসলাম (৮ নম্বর), কালবেলা প্রতিনিধি তারিকুল ইসলাম (৬৬ নম্বর আসামি) প্রমুখ। তবে এ আসামিদের মধ্যে অনেকেই আওয়ামী রাজনীতির পদপদবিতে রয়েছেন বলে সূত্র জানায়।
মামলায় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে রয়েছেন আলফাডাঙ্গা সদর ইউনিয়নের ৭, ৮, ৯ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মনিতারা মন্ডল, বানা ইউনিয়নের শিরগ্রাম এলাকার ইউপি সদস্য রাজ ইসলাম খোকন, আড়পাড়া গ্রামের ইউপি সদস্য উকিল মোল্যা, বুড়াইচ ইউনিয়নের হেলেঞ্চা গ্রামের ইউপি সদস্য আবুল বাশার, খোলাবাড়িয়া গ্রামের ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম, টগরবন্দ ইউনিয়নের কেষ্টপুর গ্রামের ইউপি সদস্য শামীম মল্লিক।
আলফাডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলীম সুজা, উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা কৃষক লীগের আহবায়ক শেখ দেলোয়ার হোসেন, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ আলী বাশার, উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের আহ্বায়ক হাসমত হোসেন তালুকদার তপন, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি কাজী কাওছার হোসেন টিটোসহ আওয়ামী লীগ, কৃষকলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ১৭০ নেতাকর্মীর নাম রয়েছে আসামির তালিকায়।
মামলার বিবরণ থেকে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশে ফিরছেন এমন খবরে ওই দিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত আসামিরা আগ্নেয়াস্ত্র ও বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আলফাডাঙ্গা সদর বাজারের চৌরাস্তায় যানবাহন ভাঙচুর করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করে ককটেল ও হাতবোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এছাড়া আসামিরা বিএনপির নেতাকর্মীদের খুন-জখমের হুমকি দেন বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
মামলার বাদি বিএনপি সমর্থক লাভলু সর্দার একজন দিনমুজুর। মামলার বিষয়ে সবকিছু তিনি জানেন কি না জানতে চাইলে লাভলু সর্দার বলেন, ‘বিষয়টা সেই রকমই। তবে মামলার অনেক ঘটনাই আমার জানা নেই। পড়ালেখা জানলে হয়তো অনেক কিছুই বুঝতে পারতাম।’ মামলার বিষয়ে আরও কিছু জানতে চাইলে সরাসরি সাক্ষাতে কথা বলবেন বলে জানান তিনি।
মামলায় আসামির তালিকায় যুবদল নেতার নাম (গ্রেপ্তারকৃত) থাকার বিষয়টির নিশ্চিত করে আলফাডাঙ্গা পৌর যুবদলের আহ্বায়ক সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃত আসামি ইকবাল আমার কমিটির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সহ-সভাপতি। এ মামলায় বিএনপির আরও কর্মী-সমর্থক রয়েছেন।’
শান্ত আলফাডাঙ্গাকে বিএনপির কিছু নেতা পুলিশ প্রশাসনের সাথে যোগসাজশ করে অশান্ত করার চেষ্টা করছে অভিযোগ করে এই যুবদল নেতা আরও বলেন, ‘এসব ঘটনায় দ্রুতই আমরা পুলিশের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করব।’
আলফাডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, মামলার দিন রাতেই অভিযান চালিয়ে মো. ইকবাল জিহাদ নামে এক আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়। তার রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানেন না বলে জানান ওসি।
মামলার অনেক বিষয়ে বাদি জানেন না- এ প্রশ্নে ওসি বলেন, ‘তিনি স্বাক্ষর করার সময় আমার সামনেই দেখে-শুনে স্বাক্ষর করেছেন। হয়তো কোনো চাপে এখন এমন কথা বলছেন। যাচাই-বাছাই ও তদন্ত করা হচ্ছে। যারা মূলত এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মামলায় ১৩ নম্বর আসামি মো. আজাদুল ইসলাম আলফাডাঙ্গা সরকারি এ জেড পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তিনি বলেন, ‘আমার কোনো দলের পদ-পদবি নেই।রাজনীতির সাথে জড়িত নই আমি। স্কুল সরকারি হওয়ার আগে আওয়ামী লীগের পদে ছিলাম। সরকারি (সরকারিকরণ-২০১৮) হওয়ার পরে দল থেকে আমাকে বহিষ্কার করা হয়। শত্রুতামূলকভাবে হয়রানি করার জন্য হয়তো আমাকে আসামি করতে পারে বিএনপির লোকজন।’
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মামলার ১৫৮ নম্বর আসামি রাসেল মিয়া দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকে গত ডিসেম্বর মাসে বাড়ি আসেন। তাকেও এ মামলায় আসামি করা হয়েছে।
আড়পাড়া গ্রামের বিএনপির সমর্থক এক পরিবারের সাতজনকে আসামি করা হয়েছে এ মামলায়। ওই পরিবারের মিটুল মিয়া ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমার বাপ, চাচা, ভাই ও সন্তানসহ ৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। আমার ছোট ভাই রাসেল (১৫৮ নম্বর আসামি) গত বছর ১৭ ডিসেম্বর সৌদি আরব থেকে বাড়ি আসছে। আমার ছেলে নিরব (১৫৯ নম্বর) এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী, নাবালক ছেলেটাকেও তারা আসামি করেছে। আমার বাপ-চাচাদের বয়স এখন ৭০-৭৫ বছর, তাদেরও মামলায় জড়ানো হয়েছে। আমরা বিএনপির সমর্থক হওয়ার পরেও গণহারে আমাদের আসামি করা হয়েছে।’ স্থানীয় শত্রুতার জেরে তাদের আসামি করা হয় বলে মনে করেন মিটুল মিয়া।
(ঢাকাটাইমস/১৯জানুয়ারি/মোআ)
মন্তব্য করুন