পল্লী উন্নয়ন ও সামাজিক দায়িত্ব পালনে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার ভূমিকা

ইকবাল মাসুদ
  প্রকাশিত : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৪:১৩
অ- অ+

যেকোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বৃহত্তর উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। পূর্ব পাকিস্তানে অবকাঠামো উন্নয়নের ত্রুটি ও বিচ্যুতি সুষম ও জনকল্যাণমূলক উন্নয়ন অন্তরায় ছিল। বাস্তবতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তান সরকার অসম উন্নয়ন অবকাঠামো পল্লীর মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। অবহেলিত পল্লীর উন্নয়নের কথা বলেছেন ও তৎকালীন সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার করেছেন যাতে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে পল্লী উন্নয়ন বাদ না পড়ে।

সে সময় পল্লীর মানুষের জন্য ছিল না স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল না। এছাড়া সড়ক বলতে বোঝাতো শুধু মেঠোপথ আর কাঁচা মাটির রাস্তাকে। কালের বিবর্তনে সে চেহারা হয়তো অনেকখানি বদলেছে। আজ হয়তো আমরা পিচঢালা সড়কে চলাচল করছি এবং এখন আর উন্নয়ন বলতে শহরের একচেটিয়া অধিকার নেই। পল্লী অঞ্চলের অনেক সড়কই এখন পাকা হয়েছে। এসব সড়ক ব্যবহার করে আজ গ্রামীণ কৃষকের উৎপন্ন শস্য ও কৃষিপণ্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে শহরাঞ্চলের বাজারে পৌঁছে যাচ্ছে। ধারাবাহিক এই উন্নয়নের পেছনেরও পরিবর্তন এসেছে অনেক মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ। সেই সময়ে আহ্ছানিয়া মিশনের প্রতিষ্ঠাতা খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা পিছিয়ে পড়া পল্লীর মানুষের জন্য নিয়মিতভাবে কাজ করেছেন। তিনি গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য সড়ক ও সেতু নির্মাণে মনোনিবেশ করেন, যা পল্লীর মানুষের চলাচল ও বাণিজ্য সহজতর করেছে, এলাকার মানুষের নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান উদ্যোগী ছিলেন, পল্লীর স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উন্নয়নে কাজ করেন, যা পল্লীর মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটায়।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা কর্তৃক আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠাতার পেছনে যে কটি কারণ নিহিত আছে তার মধ্যে পল্লী উন্নয়ন অন্যতম। আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘মিশনের মেম্বারগণ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পল্লী উন্নয়নের জন্য, রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য, দুস্থকে সাহায্যের জন্য।”

তিনি আরো বলেন, ‘‘অপরের খেদমত করাই ইহার উদ্দেশ্য; অন্য উদ্দেশ্য হইতেছে-ভ্রাতৃত্ব স্থাপন, দুঃখীর অভাব নিরাকরণ, শিশু ও বয়স্কদিগের দীনিয়াত শিক্ষাদান, পরদা সংরক্ষণ, পল্লী উন্নয়ন ইত্যাদি।” (আমার শিক্ষা ও দীক্ষা বই হতে উদ্ধৃত)।

আর এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এক্ষেত্রে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) নিজ উৎসাহে ও উদ্যোগে সাতক্ষীরা জেলার রাস্তাঘাট নির্মাণ, স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন, স্কুল-মাদ্রাসা, হোস্টেল প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি নিরলসভাবে করে গেছেন। তিনি বলেন, ‘‘শ্রমিক বেশে রাস্তা তৈয়ারী করিব, আর সেই রাস্তার আশেকের পদধূলি বক্ষে লইয়া চরিতার্থ হইব” (আমার শিক্ষা ও দীক্ষা বই হতে উদ্ধৃত)।

তিনি নানামুখী ও সমাজকল্যাণমুখী কর্মকাণ্ডে নলতা গ্রাম ও সাতক্ষীরার উন্নয়নে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দরখাস্ত দিয়ে এলাকার অভাব-অভিযোগ তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে আহ্ছানিয়া মিশনের সেক্রেটারি এম. জওহার আলীকে এক পত্র লেখেনÑ “তুমি শুনিয়া খুশী হইবে কালিগঞ্জে একটি ও সাতক্ষীরাতে আর একটি দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠিত হইতেছে। নলতার বুকে একটি প্রতিষ্ঠিত হইলে মৃত্যুর সময় শান্তিসহ ইহকাল ত্যাগ করিতে পারিবে।” তার এই পত্র থেকে বোঝা যায়, কতটুকু কমিটমেন্ট থাকলে তিনি বলেছেন, ‘‘মৃত্যুর সময় শান্তিসহ ইহকাল ত্যাগ করিতে পারিবে।”

স্থানীয় শিল্পের উন্নয়ন হ্যান্ডলুম বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন, যা স্থানীয় বস্ত্রশিল্পের বিকাশে ভূমিকা রাখে, ফলে কর্মসংস্থান ও আয়ের উৎস বৃদ্ধি পায়।

তিনি বেশ কয়েকটি সামাজিক সংগঠন ও যুবক সংগঠন তৈরি করেন। পল্লীর উন্নয়নে সামাজিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে কাজ করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করেন। এভাবে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার উদ্যোগ ও নেতৃত্ব পল্লীর অবকাঠামো ও সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

তিনি স্নেহের কয়েসউদ্দিনকে এক পত্রে লেখেন ‘‘পু: নলতা হাই স্কুল বর্তমান Development Scheme-এর অন্তর্গত হয়েছে। এ বৎসর ২০ হাজার টাকা সরকার দিয়াছেন, আগামী দুই বৎসরে ঐরূপ দিতে থাকবেন আর সংলগ্ন মডেল প্রাইমারি স্কুলটি ৬০০০ টাকা সরকার হতে পেয়েছে- সবই building বাবদ। মহাপ্রভুর করুণাধারা নেমেছে।”

তিনি শিক্ষার প্রসারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। তিনি বলেন, ‘‘নলতা গ্রামে আহ্ছানিয়া মিশনের তত্ত্বাবধানে সাতক্ষীরা মহকুমায় একটা লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত থাকিবে, সেখানে মিশনের মেম্বারগণ সাময়িকভাবে অবস্থান করিতে পারিবেন। উহার সংলগ্ন থাকিবে একটি ধর্মীয় পুস্তকাগার ও গরীবদের সেবার জন্য থাকিবে দাতব্য চিকিৎসার ব্যবস্থা। এতদুপলক্ষে যে ব্যয় হইবে শাখা মিশন তাহা বহন করিবেন।” এছাড়া মিশনের পক্ষ হইতে নলতা মসজিদের দক্ষিণে আর একটি লাইব্রেরি (ধর্মীয় পাঠাগার) প্রতিষ্ঠিত থাকিবে এবং সাতক্ষীরা লাইব্রেরির অনুকরণে পরিচালিত হইবে।”

‘‘সাতক্ষীরা মহকুমা ও নলতা গ্রামে দুইটি মিশন লাইব্রেরি (ধর্মীয় পুস্তকাগার) থাকিবে এবং উহাদের সংলগ্ন জায়েরীনদিগের সাময়িক অবস্থানের বন্দোবস্ত ও গরীবদের জন্য দাতব্য চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকিবে। উভয় লাইব্রেরি পরিচালনার জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা থাকিবে।”

তিনি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সামাজিক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান করেন এবং একত্রিত করার চেষ্টা করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘সমাজের প্রত্যেককে এই স্বরাষ্ট্র-সৌধের নির্মাণকল্পে সাহায্য করিতে হইবে-শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক পরিশ্রম দ্বারা।” তিনি তৎকালীন নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তানের পিছিয়ে পড়া ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের টেকসই উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘প্রত্যেকের শক্তির ব্যবহার করিতে হইবে; প্রত্যেককে কর্মবীর, জ্ঞানবীর ও ধর্মবীর হইতে হইবে। দুর্বলকে সবল, অচলকে সচল, ভীরুকে নির্ভয়, নিঃসহায়কে সহায় করিতে হইবে। ভিক্ষাবৃত্তি উঠাইয়া দিয়া কর্ম-বৃত্তির উন্মেষ করিতে হইবে।” তার চিন্তার গভীরতা সর্বকালের সমাজ সেবক ও সমাজ চিন্তকদেরও হার মানায়। আজও আমরা কতটুকু তার এই কথার মর্মার্থ অনুধাবন করতে পেরেছি তা বিশ্লেষণযোগ্য বলে আমরা মনে করি।

কালিগঞ্জ ও দেবহাটা থানার মধ্যে একটি হাসপাতালের অভাব তিনি অনুভব করেছিলেন যার কারণে এই দুই থানার মধ্যে হাসপাতাল নির্মাণের তাগিদ অনুভব করেন এবং সে অনুসারে উদ্যোগী হন। তিনি মিশনের সভায় প্রস্তাব গ্রহণ করেন ‘‘নলতার দাতব্য চিকিৎসালয়ের সহিত একটি হাসপাতালের অনুষ্ঠান করিতে হইবে এবং ব্যাধিগ্রস্ত অচল ব্যক্তিদের জন্য অন্তত চারটি ফ্রি বেড উক্ত হাসপাতালে সংযোজিত করিতে হইবে।”

তিনি ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাছে Rural dispensary Scheme-এর দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব করেন (ফাইল নং আইডি-২০/৪৯)। ১৯৬২ সালে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আব্দুর সবুর খানের কাছে এক পত্রে তিনি সাতক্ষীরা থেকে কালিগঞ্জ পর্যন্ত কুঞ্চা সড়কটি প্রাকৃতির আধার সুন্দরবন পর্যন্ত সম্প্রসারণের প্রস্তাব করেছিলেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, খুলনার মাধ্যমে পাকিস্তানি পোস্ট এবং টেলিগ্রাফ বিভাগে ১৯৫৯ সালে যশোর ও সাতক্ষীরার মধ্যে একটি মেইল মোটর সার্ভিস চালুর প্রস্তাব করেন।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা প্রেরিত ২০ জুলাই, ১৯৬২ তারিখের পত্রের প্রতিউত্তরে মহকুমা কর্মকর্তার কার্যালয়, সাতক্ষীরা থেকে মহাকুমা কর্মকর্তা এ. কে. এম. সিদ্দিকুল্লাহ তাকে এক পত্রে (মেমো নং ৫৭৭/প., ফঃ/- ২৫. ৭. ১৯৬২) জানানো হয় যে, সাতক্ষীরা ভেটখালী সড়ক মেটাল করার প্রকল্প গ্রহণের বিষয়টি যোগাযোগমন্ত্রী, সরকারের নজরে আনা হয়েছে। পাকিস্তানের অন্যান্য পরিকল্পনার মধ্যে তিনি অন্তর্ভুক্ত করে এই বর্ষাকাল শেষ হওয়ার পরেই উল্লিখিত রাস্তাটির প্রাথমিক কাজ শুরু করা হবে। এভাবে তিনি নিরন্তর পল্লী ও পল্লীর মানুষের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। পল্লী উন্নয়ন ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে তার অবদানের এমন শত শত উদাহরণ তুলে আনতে পারি এবং এই উদাহরণসমূহ আমাদের পথ দেখাতে পারে ও উৎসাহিত করতে পারে।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার জন্মের শতবর্ষ পরে আমাদের আত্মবিশ্লেষণের প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আমরা তার বহুমাত্রিক গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যকে কতটুকু ধারণ করতে পেরেছি। এই মহামানব যে আত্মিক শান্তি, প্রেম এবং মানবতার সেবার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন, তা আমাদের জীবনে কতটুকু প্রতিফলিত হচ্ছে?

আত্মিক উন্নয়নের পথে সহায়ক হিসেবে কি সামাজিক দায়িত্ব পালন করছি? এগুলো ভাবনার মাধ্যমে আমরা নিজেদের কর্মকাণ্ড এবং দায়িত্বসমূহ মূল্যায়ন করতে পারি। সামাজিক দায়িত্ব পালন করা আমাদের মানবতা ও সম্প্রীতির জন্য অপরিহার্য, যা খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার দর্শনে অন্তর্নিহিত আছে।

লেখক: পরিচালক, স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ১০০ দিন: যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি গোটা বিশ্ব পরিচালনার দাবি
গুলশান থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলো অভিনেতা সিদ্দিককে
রংপুরে রোহিঙ্গা নারীকে জন্মনিবন্ধন দেওয়ায় ইউপি চেয়ারম্যান বরখাস্ত
৬০ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানে আক্রমণ করতে পারে ভারত: আশঙ্কা পাক তথ্যমন্ত্রীর
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা