তামাক নিয়ন্ত্রণে সংস্কার: বাংলাদেশের আইনি সংকট ও অগ্রগতি

অধ্যাপক ড. সৈয়দ আকরাম হোসেন
  প্রকাশিত : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:৩৭
অ- অ+

বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের হার উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়ে জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশের জন্য বহুমুখী সংকট তৈরি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্যমতে, তামাকজনিত রোগে প্রতি বছর ৮ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়, যার মধ্যে ১.৩ মিলিয়ন নিষ্ক্রিয় ধূমপানের শিকার। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের ৩৫.৩% তামাক ব্যবহার করে, যার মধ্যে ১৮% ধূমপান এবং ২০.৬% ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য সেবন করে (গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে, ২০১৭)। অন্যদিকে, ১৩-১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের ৬.৯% তামাক ব্যবহার করছে (গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভে, ২০১৩), যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্যকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করছে। টোব্যাকো এটলাস ২০২২ অনুযায়ী, তামাকের অর্থনৈতিক ক্ষতি বছরে ৪২,৪৩৫.৬৮ কোটি টাকা (মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয়ে), যা স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় ও উৎপাদনশীলতা হারকে ছাড়িয়ে গেছে।

পরিবেশগত বিপর্যয়: তামাক চাষের নেপথ্য ক্ষতি

তামাক চাষ শুধু স্বাস্থ্যই নয়, পরিবেশের জন্যও ভয়াবহ। বিশ্বে প্রতি বছর ৬০ কোটি গাছ কাটা হয় তামাক পাতা শুকানোর জন্য, যা বনভূমি উজাড় ও কার্বন নিঃসরণ বাড়াচ্ছে। একটি সিগারেট উৎপাদনে ১৪ গ্রাম CO নির্গত হয়। হালদা নদীর মতো জলাশয় তামাক চাষের রাসায়নিক বর্জ্যে দূষিত হয়ে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। এছাড়া, তামাক চাষে ৫ গুণ বেশি পানি প্রয়োজন হয় ধানের। যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মতো পানিনির্ভর দেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি।

কৃষক, শিশু ও সমাজের স্বাস্থ্যঝুঁকি

গবেষণায় দেখা গেছে, একজন কৃষক তামাক ক্ষেত থেকে ৫০টি সিগারেটের সমান নিকোটিন ত্বকের মাধ্যমে শোষণ করে, যা কিডনি রোগ ও ফুসফুসের ক্যান্সার কারণ। এছাড়া, তামাক চাষে ব্যবহৃত বিষাক্ত কীটনাশক মাটি ও পানির উৎসকে দূষিত করছে, যা খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। শিশুরাও এই শিল্পের বলি—তামাক ক্ষেতে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে জড়িয়ে তাদের শৈশব ও শিক্ষার অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। UNICEF-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে ৭% শিশু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তামাক শিল্পের সাথে জড়িত, যা শিশু শ্রমিক নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

তামাক কোম্পানির বিপণন কৌশল: তরুণদের টার্গেট

তামাক কোম্পানিগুলো আইন লঙ্ঘন করে তরুণ প্রজন্মকে লক্ষ্য করে সৃজনশীল বিপণন কৌশল ব্যবহার করছে। ঢাকার স্কুল-কলেজের আশেপাশের ৭৫% দোকান তামাকপণ্য খোলামেলা প্রদর্শন করে, যা কৌতূহলী শিশুদের আকৃষ্ট করছে। মিষ্টি, চকোলেট বা ফলের স্বাদের মতো আকর্ষণীয় ফ্লেভার যুক্ত করে ই-সিগারেট ও হিটেড টোব্যাকো পণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে। সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাধ্যমে ব্র্যান্ড প্রচার এবং কনসার্ট, স্পোর্টস ইভেন্টে স্পনসরশিপের ছদ্মাবরণে তরুণদের মাঝে তামাককে "স্টাইল স্টেটমেন্ট" হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০% তরুণ ইতোমধ্যে তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপনের সংস্পর্শে এসেছে, যা ভবিষ্যতে ব্যবহারের হার আরও বাড়াবে।

আইনি প্রতিবন্ধকতা: শেয়ারহোল্ডিং ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব

২০০৫ সালের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও সংশোধনী বাস্তবায়নে ঘাটতির মূল কারণ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের তামাক শিল্পের সাথে আর্থিক সম্পর্ক। যেমন:

  • বিএটিবি-এর শেয়ারহোল্ডার তালিকায় বিডিডিএল (০.৩৪%), আইসিবি (৫.২০%), সাধারণ বিমা (২.৮৩%)-সহ সরকারি প্রতিষ্ঠান জড়িত।
  • রাষ্ট্রপতির নামে সরকারি শেয়ার ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিএটিবি’র বোর্ড/তাদের পরিবারের সদস্যদের চাকরিতে উপস্থিতি স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করে, যা তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিকে দুর্বল করছে।

আইন সংশোধনের প্রস্তাবনা (২০২৪) :

১. ধূমপান সীমিতকরণ: সব পাবলিক প্লেস, রেস্তোরাঁ ও কর্মক্ষেত্রে ধূমপান নিষিদ্ধ। জরিমানা ৫,০০০–২০,০০০ টাকা।

২. বিজ্ঞাপন ও প্যাকেজিং নিষেধ: তামাকের প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ বিজ্ঞাপন ও ব্র্যান্ড লোগো নিষিদ্ধ। প্লেইন প্যাকেজিং চালু হবে (৯০% জুড়ে স্বাস্থ্য সতর্কতা)।

৩. বিক্রয়স্থান নিয়ন্ত্রণ: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ধর্মীয় স্থানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক বিক্রয় নিষিদ্ধ।

৪. ফ্লেভার নিষিদ্ধ: মেন্টল, চেরি, চকলেট ফ্লেভারযুক্ত তামাকপণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় বন্ধ।

৫. জরিমানা বৃদ্ধি: সর্বোচ্চ ২০,০০০ টাকা জরিমানা, পুনরাবৃত্তিতে দ্বিগুণ।

SIN ট্যাক্স:

  • তামাকের উপর বর্তমান কর ৫৭–৬৫%, WHO সুপারিশ ৭৫%
  • কর বৃদ্ধি পেলে দাম বাড়বে, তরুণ ও নিম্নআয়ীদের ব্যবহার কমবে।
  • ফিলিপাইনে সিন ট্যাক্সে তামাক ব্যবহার ২৫% কমেছে।

অগ্রগতির পথ:

  • তামাক নিয়ন্ত্রণে সাফল্যের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনের কঠোর প্রয়োগ ও শেয়ারহোল্ডিং সংস্কার জরুরি।
  • সরকারি কর্মকর্তাদের তামাক শিল্পের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট নীতি জোরদার করতে হবে।
  • তামাক কর বৃদ্ধি, প্লেইন প্যাকেজিং বাস্তবায়ন ও তরুণদের সচেতনতা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করুন।
  • অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মতো তামাক ব্যবহার ২০% এর নিচে নামিয়ে আনতে কঠোর নীতি ও সামাজিক আন্দোলন অনুকরণীয়।
  • ২০৩০ সালের SDG অর্জনে গণমাধ্যম, শিক্ষক, চিকিৎসক ও তরুণদের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

লেখক: সদস্য,স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন, এবং কোঅর্ডিনেটর,স্কয়ার ক্যানসার সেন্টার, স্কয়ার হাসপাতাল

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
যে কারণে স্থগিত হয়ে গেল ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ১০০ দিন: যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি গোটা বিশ্ব পরিচালনার দাবি
গুলশান থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলো অভিনেতা সিদ্দিককে
রংপুরে রোহিঙ্গা নারীকে জন্মনিবন্ধন দেওয়ায় ইউপি চেয়ারম্যান বরখাস্ত
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা