নিরাপদ ও সুরক্ষিত জীবনের জন্য আর্থিক জ্ঞান কতটা জরুরি

এম এম মাহবুব হাসান
  প্রকাশিত : ১৮ মার্চ ২০২৫, ২০:৩৬
অ- অ+

এ বছর মার্চের ৩ তারিখে বাংলাদেশে তৃতীয়বারের মতো পালিত হয়ে গেল আর্থিক সাক্ষরতা দিবস। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সার্কুলারের মাধ্যমে প্রতি বছর মার্চ মাসের প্রথম সোমবার আর্থিক সাক্ষরতা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

একই বিজ্ঞপ্তির আলোকে, বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি এবং আর্থিক সাক্ষরতা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য আর্থিক সাক্ষরতা সহায়তা পুস্তিকা প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যেখানে প্রতি বছর আর্থিক সাক্ষরতা সপ্তাহ কর্মসূচি পালনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়।

এই নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্য রেখে, এই বছর ১৭ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে আর্থিক সাক্ষরতা সপ্তাহ পালনের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়, যদিও পবিত্র রমজান মাসের কারণে আর্থিক সাক্ষরতা সপ্তাহ কর্মসূচি পালন কিছুটা সীমিত রাখতে বলা হয়।

আর্থিক সাক্ষরতা বলতে কোনো ব্যক্তির অর্থসংক্রান্ত সেই জ্ঞান, দক্ষতা ও মনোভাবকে বোঝানো হয়, যা ব্যক্তি তাঁর অর্থ সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য ব্যবহার করে থাকেন।

সাধারণ জনগণের আর্থিক জ্ঞান বৃদ্ধি করা এবং আর্থিক বিষয়ে তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে ক্রমেই আর্থিক সাক্ষরতা কর্মসূচির গুরুত্ব বেড়ে চলেছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশেও নানাবিধ কার্যক্রমের মাধ্যমে আর্থিক সাক্ষরতা দিবসআর্থিক সাক্ষরতা সপ্তাহ কর্মসূচি পালন করা হয়ে থাকে।

আর্থিক সাক্ষরতা বলতে, আমরা বর্তমানে যে কর্মসূচি পালন করে চলেছি, সেটির ইতিহাস মূলত বিংশ শতকের প্রথম দিকে শুরু হয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে এই উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী ব্যাপক গতি লাভ করে। এরপরের ইতিহাস পরিক্রমা সবার কাছেই পরিষ্কার।

বাংলাদেশ ডিজিটাল হচ্ছে, কিন্তু বিশ্বব্যাপী নারী-পুরুষের আর্থিক সাক্ষরতার ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে। আপাতদৃষ্টে প্রাপ্তবয়স্ক ৩৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৩০ শতাংশ নারী আর্থিকভাবে শিক্ষিত হলেও বিশ্বব্যাপী এ ব্যবধান নেহাত কম নয়।

শিক্ষার এই বৈষম্য উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় অর্থনীতিতেই বিদ্যমান এবং শিগগিরই এটি দূর হবে বলে মনে হচ্ছে না।

একটি জরিপের ফলাফল অনুসারে, বিশ্বব্যাপী ৩৩ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ আর্থিকভাবে শিক্ষিত, যাঁদের বেশির ভাগই উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বসবাস করছে।

বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই আর্থিক সাক্ষরতার ব্যবধান বাংলাদেশের অগ্রগতিতেও একটি বড় বাধা। বাংলাদেশ আর্থিক সাক্ষরতার হার মাত্র ২৮ শতাংশ।

অর্থাৎ আমাদের দেশের এখনো ৭২ শতাংশ মানুষ আর্থিক জ্ঞান থেকে দূরে রয়েছে। এমনকি প্রায় ৩ কোটি মানুষ এখনো ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে।

এমন পরিস্থিতিতে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে আর্থিক জ্ঞানের বিকল্প নেই। আর্থিক জ্ঞান অর্জনের ফলে আমাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যের হতে পারে।

একটি সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ গড়তে আর্থিক জ্ঞান অর্জনের ন্যূনতম ৪টি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে, যেগুলো আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে।

১. ব্যক্তি জীবনে আর্থিক জ্ঞানের গুরুত্ব

ব্যক্তিগত আর্থিক পরিকল্পনার মূল ভিত্তি হলো আর্থিক জ্ঞান। আমাদের বাজেট পরিকল্পনা, সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও ঋণ পরিচালনার ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হলে আর্থিক বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। ব্যাংকের বিভিন্ন সেবা যেমন সঞ্চয় স্কিম, নির্দিষ্ট মেয়াদের আমানত, ঋণসুবিধা ইত্যাদি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হলে আমাদের এই জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আর্থিক জ্ঞান শুধু বর্তমান আর্থিক অবস্থাকে সুদৃঢ় করে না, ভবিষ্যতের জন্যও সঠিক পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।

২. সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মাধ্যমে সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ

ব্যাংকিং সেবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সুযোগ। নিয়মিত সঞ্চয় করে এবং তা সঠিকভাবে বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা যেকোনো আর্থিক সংকট বা জরুরি অবস্থায় আমাদের নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারি। আমাদের ছোট ছোট সঞ্চয় বা বিনিয়োগগুলোও সময়ের সাথে সাথে বড় হতে থাকে, যেটি আমাদের একটি সুদৃঢ় ও স্থিতিশীল আর্থিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। এছাড়াও, বিভিন্ন বিনিয়োগ পণ্য যেমন সঞ্চয়পত্র, ট্রেজারি বন্ড, ট্রেজার বিল, মিউচুয়াল ফান্ড, সিকিউরিটিজ ও বীমা পলিসি ব্যবহার করে আমারা আমাদের সম্পদের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারি এবং লাভজনক ফলাফল অর্জন করতে পারি।

৩. আর্থিক জ্ঞান অর্জনে ব্যাংকের ভূমিকা

ব্যাংক শুধু আর্থিক লেনদেনের মাধ্যম নয়, বরং এটি আর্থিক জ্ঞানের একটি শিক্ষণীয় প্ল্যাটফর্মও বটে। ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের জন্য বিভিন্ন আর্থিক শিক্ষা কর্মসূচি, সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও নানাবিধ সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এই শিক্ষামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে আমরা সঠিক বিনিয়োগের কৌশল, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং ভবিষ্যৎ আর্থিক পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করতে পারি। ব্যাংকের অভিজ্ঞ কর্মকর্তা বা প্রতিনিধিরা আমাদের আর্থিক লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা গড়ে তুলতে সাহায্য করেন।

৪. সঠিক ও দায়িত্বশীল আর্থিক পরিকল্পনা

আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সঠিক ও দায়িত্বশীল আর্থিক পরিকল্পনা অপরিহার্য। এই প্রক্রিয়ায় আমাদের আয়, ব্যয় এবং সঞ্চয়ের মধ্যে সঠিক সমন্বয় সাধন করতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে খরচের হিসাব রাখা, অপ্রয়োজনীয় খরচ এড়ানো এবং ভবিষ্যতের জন্য সঠিক বিনিয়োগের পরিকল্পনা তৈরি করা এই পরিকল্পনার মূল উপাদান। ব্যাংকের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে আমরা সহজেই আমাদের খরচ, সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের হিসাব রাখতে পারি, যা আমাদের আর্থিক স্বচ্ছতা এবং আর্থিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সহায়তা করবে।

ব্যক্তিজীবনে আর্থিক সাক্ষরতার নানান গুরুত্ব অনুধাবন করে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি) ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে আর্থিক শিক্ষা ও সচেতনতা কর্মসূচি চালু করে, যা পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

একই বছর যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক সাক্ষরতা ও শিক্ষা কমিশন’ (এফএলইসি) গঠন করা হয় যা অর্থ ব্যবস্থাপনার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রচারের জন্য কাজ শুরু করে। তখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও স্কুল পর্যায়ে আর্থিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়।

একইভাবে ভারতে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ২০১৩ সালে আর্থিক সাক্ষরতা কেন্দ্র স্থাপন করে। যদিও ২০০৫ সালে একটি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের মঙ্গলম গ্রামের সব পরিবারকে ব্যাংকিং সুবিধা প্রদান করে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও সাক্ষরতার একটি উদাহরণ সৃষ্টি করা হয়। তারপরও ভারতের আর্থিক সাক্ষরতার হার ৩৫ শতাংশ।

বৈশ্বিক গবেষণা বলছে ডেনমার্ক ও নরওয়েতে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের আর্থিকভাবে শিক্ষিত হওয়ার হার ৭১ শতাংশ, যা বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। তবে বিশ্বব্যাপী তরুণদের আর্থিক সাক্ষরতার হার ৫০ শতাংশের নিচে যেটি এখনো উদ্বেগের কারণ।

এ ছাড়া জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০–এর মধ্যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক শিক্ষা কর্মসূচি পরিচালনা করছে যা আর্থিক সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

২০১৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক শিক্ষা ও অন্তর্ভুক্তির জন্য জাতীয় আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কৌশল’ চালু করে, যার ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আর্থিক সাক্ষরতা কর্মসূচি চালু করা হয়। ডিজিটাল লেনদেন, ই-ওয়ালেট ও অনলাইন ব্যাংকিংয়ের প্রসারের ফলে মানুষের মধ্যে আর্থিক সচেতনতা আরও বৃদ্ধি পায়।

সঠিক আর্থিক জ্ঞান এবং পরিকল্পনার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি শুধু তার বর্তমান আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে পারেন না, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি মজবুত ও স্থিতিশীল ভিত্তি তৈরি করতে পারেন। কিন্তু ব্যক্তির আর্থিক জ্ঞান অর্জনের ইচ্ছাশক্তিটা জাগাবে কে?

লেখক: ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক।

ই-মেইল: [email protected]

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ১০০ দিন: যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি গোটা বিশ্ব পরিচালনার দাবি
গুলশান থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলো অভিনেতা সিদ্দিককে
রংপুরে রোহিঙ্গা নারীকে জন্মনিবন্ধন দেওয়ায় ইউপি চেয়ারম্যান বরখাস্ত
৬০ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানে আক্রমণ করতে পারে ভারত: আশঙ্কা পাক তথ্যমন্ত্রীর
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা