আমরা কি পারিবারিক সামাজিক রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় জীবনে স্বাধীন?

স্বাধীনতা হলো বাধা ছাড়াই কথা বলার, কাজ করার এবং ইচ্ছামতো পরিবর্তন করার ক্ষমতা বা অধিকার। কোনো কিছু ‘মুক্ত’ যদি তা পরিবর্তন করতে পারে এবং বর্তমান অবস্থায় সীমাবদ্ধ না থাকে তাকে ও স্বাধীনতা বলে। আধুনিক উদারপন্থি দেশগুলোতে, স্বাধীনতাকে একটি অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়, বিশেষ করে বাক-স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা।
পৃথিবীর যেসব দেশ উন্নতির স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে গেছে, ওই সব দেশের আইনশৃঙ্খলা ও বিধিবিধান স্বাধীন। আমাদের ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে না। স্বেচ্ছাচারিতা যেন আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানি না আমরা হাইব্রিড জাতি হওয়ার কারণে এমনটি হচ্ছে কি না। যে মায়ের রক্তপিণ্ড দিয়ে একেকজন নাড়ি ছেঁড়া ধন আদরের সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখে, সেই সন্তানটি প্রথম আঘাতটি বাবা-মা’কে করে। বাবা-মা যখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যায়, স্মৃতিশক্তি লোপ পায়, তখন ওই সন্তানরাই পিতা-মাতাকে হেয়প্রতিপন্ন করে কথা বলে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় উচ্চশিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে ধনী এমন সন্তানও বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে নিজেদের সঙ্গে না রেখে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠান। এমনো দেখা যায় বৃদ্ধ বাবা-মা ভিক্ষা করছেন, ছেলে বড় কর্মকর্তা। ছেলে ও ছেলের বউ মিলে বৃদ্ধ বাবা-মা’কে তাদেরই তৈরি করা ঘর থেকে বের করে দেয়। বাবা-মা’র আশ্রয় হয় গোয়ালঘর নয়তো রাস্তার পাশে। প্রায় দেখা যায় ভাইরা বোনের সম্পত্তি কুক্ষিগত করে। অথচ এই বোনরাই ছোটকাল থেকে ভাইদেরকে কোলেপিঠে করে পরম আদরযত্নে লালনপালন করে। অর্থাৎ এখানে পেশিশক্তিটা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, পিতা-মাতা ও ভাই-বোনদের সঙ্গেও একে অপরের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ হর-হামেশা হচ্ছে।
একজন শিক্ষক জাতির সবচেয়ে বড় অভিভাবক। বাংলাদেশের প্রায়ই শিক্ষকের হাতে ছাত্রী ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটছে। অনেক শিক্ষক সুযোগ পেলে ক্লাস না নিয়ে ফাঁকিবাজি করছেন এবং ছাত্রছাত্রীদেরকে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন। অর্থাৎ স্বেচ্ছাচারিতা ও পেশিশক্তি স্বাধীনভাবে একজন শিক্ষকও করছেন।
বাংলাদেশে প্রায়ই দেখি পিচঢালা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে একাধিক বন্ধু মিলে খোশগল্পে মেতে থাকেন। গাড়িগুলো ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে হর্ণ দিচ্ছেন। খোশগল্পরতদের ভাবখানা এমন যে, এটা তাদের অধিকার, রাস্তা বন্ধ করে খোশগল্প করা। কিছু বললে স্বাধীনভাবে দলবদ্ধভাবে আক্রমণ করে গাড়ির ক্লাস ভেঙে দিয়ে যায়। পৃথিবীর কোথাও এমনটি দেখা যায় না। এমনকি যেসব দেশে নেশা করে মাতাল হয়ে বুঁদ হয়ে যাওয়া আইনসম্মত, ওই সব দেশেও নয়।
বাংলাদেশের অধিকাংশ রাস্তাঘাট বাঁকা-ত্যাড়া এবং ব্যাকওয়ার্ড জায়গায়, যদিও এই রাস্তাঘাটগুলো যখন করা হয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই সরল রেখার মতোই করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছিল। তখন প্রভাবশালী শিয়ালের ন্যায় চালাক চতুর প্রকৃতির লোকগুলো জমির ওপর রাস্তা করতে বাধার সৃষ্টি করেছিল। যার প্রথমত কারণ হলো তাদের জায়গা কমে যাবে এই ভয়ে, দ্বিতীয়ত তাদের রাস্তা দিয়ে অন্যরা হাঁটবে এটাও কি মানা যায়? অর্থাৎ পরশ্রীকাতরতা। অন্যদিকে বোকা ও বুদ্ধিমান শ্রেণি সানন্দে জায়গা দিয়েছিল, কারণ তারা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে এই রাস্তা দিয়ে অল্প সময়ে পৌঁছে যেতে পারবে। প্রকারান্তরে এই বোকা শ্রেণি জিতে গেল, কারণ তাদের কিছু জায়গা রাস্তা করতে খরচা হলেও রাস্তার পাশে অবশিষ্ট জমির দাম চালাক চতুর লোকদের জমির তুলনায় রাতারাতি কয়েকগুণ বেড়ে গেল। চালাক শ্রেণি বিষয়টি যদি মনের জটিলতা কুটিলতা ত্যাগ করে ভেবে দেখতো, তাহলে আইনকে স্বাধীনভাবে চলতে বাধা দিত না।
অন্যদিকে বাংলাদেশে ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের দায়িত্ব জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা। কিন্তু এই কমিশন এদেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে বাদ দিয়ে কিভাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করবে, তা আমার বোধগম্য নয়। বরং আমি দেখছি এই কমিশনের এজেন্ডা বাস্তবায়ন হলে, এ জাতি প্রায় সমানভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। অর্থাৎ গৃহযুদ্ধ অত্যাসন্ন। সৃষ্টিকর্তা আমাদের মুখ, জিহবা ও বকালকর্ড বা স্বরযন্ত্র দিয়েছেন, যা দিয়ে আমরা যাচ্ছে তাই বলতে পারি ও করতে পারি। আমরা স্বেচ্ছাচারিতা করাটাকে হয়তো স্বাধীনতা মনে করি।
পবিত্র রমজান মাস চলছে, এই সময়ে শয়তান সৃষ্টিকর্তার শিকলে বন্দি। রমজানের পূর্বে যুক্তির খাতিরে ধরে নিলাম শয়তানের কুমন্ত্রণায় আমরা বেশি খারাপ কাজ করতাম। এখন মানুষ বেশি স্বাধীন, যেহেতু এখন আমরা শয়তানের রেঞ্জের বাইরে, কিন্তু এই রমজান মাসেই রেকর্ড পরিমাণ ধর্ষণ ও বলাৎকার হয়েছে বলে গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পারলাম। সারাদিন রোজা থাকার কারণে রমজান মাসে খাবার-দাবারের সংযম বা পরিমিত। এই রমজানে দেখলাম এক মোল্লা তার মাদ্রাসার শিশু ছাত্রকে বলাৎকার করেছে। এই রমজানে শিশু আছিয়া তার নিকট আত্মীয়স্বজনের হাতে ধর্ষিত হয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে। দুর্বলের ওপর সবলের আঘাত চলছেই।
কয়েক বছর পূর্বে একজন প্রভাবশালী আলেম নারায়ণগঞ্জের এক রিসোর্টে নিজের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বন্ধুর তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে নিয়ে ধরা পড়লেন। তার কথিত স্ত্রী এবং ওই ভদ্র মহিলার সন্তানের কথাবার্তার অডিও রেকর্ড ফাঁস হলো। ফাঁসকৃত কথাবার্তার আলোকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে, সহজ-সরল বন্ধুর পরিবারে নাক গলানোর সুযোগে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝামেলা পাকিয়ে তালাক করিয়েছেন ওই আলেম। অতঃপর সুযোগ বুঝে বিভিন্ন জেলায় ঘুরে তারা দৈহিক মেলামেশায় লিপ্ত হয়েছেন। তথাকথিত স্ত্রী ধর্ষণের মামলাও করেছেন। আমি প্রথমে ভাবলাম সরকার ভিন্ন মতাদর্শের কারণে তাকে ফাঁসিয়েছেন। আমি বারবার গণমাধ্যমে চোখ রাখতে লাগলাম, বিয়ের কোনো নিকাহনামা গণমাধ্যমে আসে কি না, কিন্তু দেখাতে ব্যর্থ হলেন। পরে ভাবলাম নিকাহনামা আমাদের সরকারি আইনের বিষয়, ধর্মীয় বিষয় হওয়ায় তিনি হয়তো সরকারি আইন নাই বা মানলেন, এদেশে কজনই বা সরকারি আইন মানে। এবার অপেক্ষায় রইলাম কবে কোথায় বা কে বিয়ে পড়িয়েছেন, সাক্ষীগণের তথ্য-উপাত্ত নিশ্চয়ই আসবে, শেষ অবধি কিছুই পেলাম না, অর্থাৎ পুরোটাই ভুয়া। নতুন লাল স্বাধীনতার পর দেখলাম, ওই আলেম ওয়াজ মাহফিলে সেকি হুংকার, সে কি বীর পুরুষ। আলেম ওলামাগণ নবী ও রাসূলদের উত্তরসূরি হওয়ায়, আমরা আপনাকে সম্মান করতে চাই, দয়া করে হম্বিতম্বি না করে জনাব বিয়ের তথ্য জাতির সামনে পরিষ্কার করুন, প্রমাণ উপস্থাপন করুন।
এবার স্বাধীন রমজান মাসে আমি নিজেই বাজার থেকে দামি খেজুরগুলোর মধ্যেই ২ ধরনের খেজুর ক্রয় করলাম। সুন্নত হিসেবে খেজুর দিয়ে রোজার সমাপ্তি ঘটানো উত্তম বলে আমি প্রথমে খেজুর ক্রয় করলাম। কিন্তু দ্বিতীয় রোজা না পেরোতেই আমার সঙ্গীয় অন্য রোজাদার এবং এক পর্যায়ে আমি নিজেও পেটের পীড়ার সম্মুখীন হলাম। প্রথমত ভাবলাম ভেজাল তেল বা অন্য কোনো ভেজাল উপকরণের কারণে এমনটি হলো কি না। তেল, ছোলা, বেসন ও ডালসহ অন্য সবই পরখ করে দেখলাম, তাতেও কোনো সমাধান মিলল না। আমার সবচেয়ে পছন্দের ও আস্থার খেজুরের প্রতি কোনো সন্দেহ হলো না। পেটের পীড়া আরো বেড়েই চলল। এক পর্যায়ে আমার আস্থার কয়েকটা খেজুর ভেঙে দেখলাম খেজুরগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ এবং অধিকাংশের ভিতরে পোকা রয়েছে। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এখন আমার মনে প্রশ্ন জাগ্রত হলো, এক নদী রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতার কি প্রয়োজন ছিল? খেজুরের কথা বাদই দিলাম, যেখানে আমরা শিশুখাদ্যেও ভেজাল সৃষ্টি করি। যেখানে আইনকানুন প্রায় কেউ তোয়াক্কা করছে না। এখানে স্বাধীনতা বলছে অধিকাংশ ব্যক্তি বুঝেন পেশিশক্তি, যাচ্ছে-তাই স্বেচ্ছাচারিতা। নিজেকে মগ মনে করে স্বাধীনভাবে মুল্লক তৈরি করাটাই জীবন, তবে কি এই স্বাধীনতার চেয়ে স্বৈরাচারী বা একনায়কতন্ত্রই শ্রেয় নয়? কারণ ওই ক্ষেত্রে একনায়ক ব্যতীত সবাই পরাধীন বা আইন মানতে বাধ্য।
অর্থাৎ আমরা আমাদের নিজেদের পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় জীবনে স্বাধীন নয়। যে জাতি নিজেরা একে অপরের নিকট নিরাপদ নয়, তারা বিদেশি শক্তির নিকট নিরাপদ থাকবে কিভাবে?
আসুন আজ হতে বিশ্বাস করি এবং কাজে পরিণত করতে দীপ্ত শপথ গ্রহণ করি, সংবিধান আইন-কানুন বিধিবিধান স্বাধীনভাবে চলতে দিব, তবেই আমরা সবাই স্বাধীন।
লেখক: প্রেসিডেন্ট, আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহল

মন্তব্য করুন