ঢাকার যানজটের অপ্রতিরোধ্য প্রভাব-যন্ত্রণা এবং তার সমাধান

ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব ও দাউদ ইব্রাহিম হাসান
  প্রকাশিত : ০১ মে ২০২৫, ১৮:৫৫| আপডেট : ০১ মে ২০২৫, ১৯:০০
অ- অ+

ঢাকা শহরের যানজট শুধু এক শহরের সমস্যা নয়, এটি আমাদের দেশের বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে। যখন আমরা প্রতিদিন রাস্তায় বেরোয়, তখন প্রতিটি মুহূর্তে আমরা একটি অদৃশ্য যুদ্ধের সম্মুখীন হই। রাস্তা, সড়ক, ব্রিজ, ফুটপাতসবকিছু যেন এক বিরাট স্লোগান হয়ে ওঠে, যেখানে শুধু চিৎকার আর যন্ত্রণা ফুটে ওঠে।

ঢাকা শহরে যানজট আর পরিবহন ব্যবস্থার সংকট এখন আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনের জীবনে এটি হয়ে উঠেছে এক দৈনন্দিন অভিশাপ। অর্ণব তার গান "এই শহর আমার"-এর লিরিক্স-এ প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন, এই শহরের যানজটের ভয়াবহতায় কীভাবে মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে।

এই শহর আমার,

এই মানুষ আমার...

এই শহর আমার,

এই মানুষ আমার...

তুমি শুনতে কি পাও

ভীড়ের মাঝে কেউ?

গত এক দশকে ঢাকার যানজট যেভাবে বেড়েছে, তা একে আর কেবল শহরের সমস্যা হিসেবে দেখা যায় না, বরং এটি একটি জাতীয় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২০১৮ সালের ঢাকা যানজট রিপোর্ট অনুযায়ী, ঢাকার বাসিন্দারা প্রতি বছর প্রায় ১ হাজার ২০০ ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকে (ঢাকা যানজট রিপোর্ট, ২০১৮)। এই পরিসংখ্যানটি শুধু একটি সংখ্যা নয়, এটি প্রতিটি নাগরিকের অসহায়ত্বের চিত্র। একজন ব্যক্তি বছরে তিন মাসের বেশি সময় যানজটে হারাচ্ছেএটি শুধু সময়ের অপচয় নয়, মানুষের জীবনের প্রতি এক তীব্র অবমূল্যায়ন। অফিস টাইমে বা গুরুত্বপূর্ণ কাজে বের হওয়া যে শুধুমাত্র একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত।

এই যানজটের আরেকটি প্রকট দিক হলো পরিবেশগত ক্ষতি। ঢাকার রাস্তায় যে মাত্রায় যানবাহন চলছে, তা শুধু মানুষের জীবনে নয়, পুরো শহরের পরিবেশেও ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে আসছে। ঢাকার বাতাসে যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ির ধোঁয়া মিশে থাকে, তখন শুধু শ্বাসপ্রশ্বাসে বাধা আসে না, এটি আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার বায়ুদূষণ এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ শ্বাসযন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০২০)। শহরের বুকে চলা এই যানবাহনগুলো আমাদের পরিবেশের জন্য এক অসম্ভব বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এমনকি এই পরিস্থিতির প্রতি সরকারের যে একাংশের অবহেলা রয়েছে, সেটিও আমাদের ক্ষতি বাড়াচ্ছে। রাস্তায় অগণিত গাড়ি এবং দূষণের মাত্রা বৃদ্ধির কারণেই মানুষ নিজের বাসার কাছেও সঠিকভাবে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে পারে না।

যানজট এবং পরিবহন ব্যবস্থার সংকটের আরেকটি কারণ হলো, শহরের যানবাহন ব্যবস্থার অপ্রতুলতা। ঢাকা শহরে যেখানে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ একসঙ্গে যাতায়াত করেন, সেখানে একটি সঠিক, কার্যকর পরিবহন ব্যবস্থা থাকাটা একেবারেই অপরিহার্য। দুর্বল ও অত্যন্ত অপ্রতুল পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা মানুষকে ব্যক্তিগত যানবাহনে নির্ভরশীল করে তুলেছে, যা যানজটের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধরুন, অফিস টাইমে যখন একদিকে লক্ষ লক্ষ মানুষ চলাচল করছেন, অন্যদিকে বাস, অটোরিকশা, সিএনজি, সবগুলোই নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছানোর জন্য একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছেতাহলে শহরের পরিবহন ব্যবস্থা কোথাও গিয়ে শুধু দুর্বল নয়, অকার্যকর হয়ে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং এতে সামাজিক, অর্থনৈতিক দিক থেকে বিরাট ক্ষতি হয়ে যায় (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন, ২০২১)।

ঢাকার যানজট শুধু কষ্টকর অভিজ্ঞতা নয়, এটি একটা সামাজিক সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু মানুষ এখন এই পরিস্থিতির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, এবং দিনযাপন করতে করতে এই সমস্যাটির প্রতি তারা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। এমনকি, দীর্ঘ সময় ধরে জ্যামে আটকে থাকা মানুষ তাদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে, এবং একপর্যায়ে এটি তাদের মানসিক চাপের কারণ হয়ে উঠছে।

স্ট্রেস, অনিদ্রা, হতাশাএগুলো সবই ঢাকা শহরের যানজটের প্রতিফলন। উদাহরণস্বরূপ, একজন অফিস কর্মী প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকা পড়ে কর্মক্ষেত্রে যেতে পারেন না, এবং সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে গিয়ে আর কোনো কাজ করার শক্তি পান না (বাংলাদেশ মনস্তত্ত্ব সোসাইটি, ২০১৯)। এই অবস্থায় তার জীবনের উৎপাদনশীলতা নষ্ট হয়, কর্মক্ষেত্রের প্রতি তার মনোযোগ কমে যায়, এবং আরও বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি।

এই সংকটের সমাধান সহজ নয়, তবে এটি অপ্রতিরোধ্যও নয়। প্রথমত, মেট্রোরেল এবং লাইট রেল ট্রানজিট সিস্টেমের দ্রুত বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। ঢাকার যানজটের অন্যতম বড় সমাধান হতে পারে দ্রুতগতির ট্রানজিট ব্যবস্থা। যে শহরে যানজট এতটা প্রকট, সেখানে মেট্রোরেলই একমাত্র বিকল্প হতে পারে, যা রাস্তার ওপর চাপ কমাবে এবং জনগণকে দ্রুত এবং সাশ্রয়ীভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছানোর সুযোগ দেবে (ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, ২০২২)। তবে এই প্রকল্পগুলির বাস্তবায়ন যদি শুধুমাত্র সরকারের হাতে থাকে, তবে তা কখনও সম্ভব হবে না, জনগণের অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকার যদি জনগণের জন্য এসব প্রকল্পের সুবিধাপ্রাপ্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করে, তবে এটি একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে।

এছাড়া, বাইসাইকেল এবং হাঁটার পথের উন্নয়নও জরুরি। বিশেষ করে ঢাকার মতো সংকটপূর্ণ শহরে কম দূরত্বের জন্য গাড়ি ব্যবহার করার পরিবর্তে মানুষ যদি সাইকেল বা হাঁটার রাস্তা ব্যবহার করে, তাহলে অনেকাংশে যানজট কমবে। এক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে, যেন তারা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বা সাইকেল ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে। যদি এটি মানুষের জন্য সুবিধাজনক এবং সুরক্ষিত হয়, তবে এটি শুধু পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতিই ঘটাবে না, বরং পরিবেশের উন্নতিতেও সাহায্য করবে (বিশ্বব্যাংক, ২০২১)। কয়েকটি উন্নত শহরে যেমন প্যারিসে সাইকেল ব্যবহারের মাধ্যমে যানজট কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঢাকাতেও তেমন উদ্যোগ নিতে হবে।

সড়ক সংস্কারের জন্য বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ এবং স্মার্ট ট্রাফিক সিস্টেমের বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। এটি একদিকে যেমন যানজট নিয়ন্ত্রণ করবে, অন্যদিকে শহরের প্রতিটি রাস্তায় সুষ্ঠু চলাচল নিশ্চিত করবে। একই সঙ্গে, ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে (বাংলাদেশ পুলিশ, ২০২০)। ট্রাফিক পুলিশ যদি তাদের কার্যক্রম আরও দক্ষভাবে পরিচালনা করতে পারে, তাহলে অনেকাংশে রাস্তার শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

ডেডিকেটেড বাস লেন তৈরি করা এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করা জরুরি। বাস ও অন্যান্য গণপরিবহন ব্যবস্থাকে আরও নির্ভরযোগ্য, সময়ানুবর্তী এবং সাশ্রয়ী করে তুলতে হবে, যাতে মানুষের মধ্যে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহারের আগ্রহ বাড়ে (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন, ২০২২)।

উন্নত দেশের মতো শেয়ারড রাইড সিস্টেম এবং ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু করা হলে ঢাকার যানজট অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে।

এসব উদ্যোগকে সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদের সমর্থন এবং অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কারণ ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার সংকট একটি একক সমস্যা নয়, এটি সবার সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ঢাকার যানজট কমানোর জন্য একসাথে কাজ করলে, আমরা একদিন একটি সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও উন্নত ঢাকা গড়ে তুলতে পারব, যেখানে সবাই অবাধে চলাফেরা করতে পারবে।

তথ্যসূত্র :

ঢাকা যানজট রিপোর্ট (২০১৮). (2018). ঢাকা যানজট: বার্ষিক পর্যালোচনা রিপোর্ট. ঢাকা সিটি কর্পোরেশন। https://www.dhakajam.com/report

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা. (2020). বিশ্বের বায়ু দূষণ: ঢাকার পরিস্থিতি ও এর প্রভাব. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO). https://www.who.int/air-quality

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন. (2021). ঢাকা শহরের যানজট ও পরিবহন ব্যবস্থার সংকট: ২০২১ প্রতিবেদন. বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (BRTA). https://www.brta.gov.bd

বাংলাদেশ মনস্তত্ত্ব সোসাইটি. (2019). ঢাকার যানজট ও মানসিক চাপ: শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব. বাংলাদেশ মনস্তত্ত্ব সোসাইটি. https://www.psychologybd.org

ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প. (2022). ঢাকা মেট্রোরেল: একটি বিশ্লেষণ. ঢাকা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ. https://www.dmtcl.gov.bd

বিশ্বব্যাংক. (2021). ঢাকা শহরের পরিবহন সংকট: একটি পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ. বিশ্বব্যাংক। https://www.worldbank.org/bangladesh

বাংলাদেশ পুলিশ. (2020). ঢাকা শহরের যানজট নিয়ন্ত্রণ: ট্রাফিক আইন ও শৃঙ্খলা. বাংলাদেশ পুলিশ। https://www.police.gov.bd

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন. (2022). পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা: উন্নতির পথ. বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন। https://www.brta.gov.bd

ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব: সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং গ্লোবাল কনসালট্যান্ট ডিরেক্টর, অক্সফোর্ড ইমপ্যাক্ট গ্রুপ, যুক্তরাজ্য।

দাউদ ইব্রাহিম হাসান: মার্কেটিং বিভাগের সদস্য, আইডিএলসি ফাইন্যান্স পিএলসি।

(ঢাকাটাইমস/১মে/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
আমাদের মধ্যে মতানৈক্য দেশটাকে খেয়ে ফেলবে: মির্জা আব্বাস 
নৌপথে অসুস্থ শিশুকে দ্রুত চিকিৎসা সহায়তা কোস্টগার্ডের
পরকীয়ার জেরে পুলিশ সদস্য স্বামীকে হত্যা: স্ত্রীসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করল যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ
প্রাণঘাতী গুলি না ব্যবহারের অনুরোধ সায়ানের, পুলিশের কাউন্সিলিংয়ের পরামর্শ নিপুনের
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা