মাদকের ছোবলে বিপর্যস্ত তরুণ সমাজ, বেড়েই চলেছে মাদক কারবার

আজ ২৬ জুন, আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য—‘শৃঙ্খল ভাঙার আহ্বান: সবার জন্য প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও নিরাময়’। দিনটি উপলক্ষে রাজধানীসহ সারাদেশে পালিত হচ্ছে নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচি।
চারিদিকে বাড়ছে মাদকের কারবার, মাদকের ভয়াল থাবায় ধ্বংসের পথে যুবসমাজ। আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে বিচরণ করছে সর্বনাশা মাদক। অভিভাবকরা আতঙ্কিত, উৎকণ্ঠিত। তারা শংকিত কখন মাদকের স্রোতে দিক হারিয়ে নেশার জালে আটকা পড়ে যায়, তাদের প্রিয় সন্তান। কখন ছোবল মেরে নেশাগ্রস্ত করে পাঠিয়ে দেয় মরণকূপে। এ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে নিজের সন্তানকে রক্ষার জন্য মা-বাবার সঙ্গে পুরো জাতি আজ শঙ্কিত, আতঙ্কিত।
ফেনসিডিল, হিরোইন, কোকেন, ক্রিস্টাল মেথ-আইস, সিডাকসিন, ইনোকট্রিন, মরফিন, টেট্রাহাইড্রো ক্যানাবিনল, মেথাডন, বিয়ার, কেনা বিসরেসিন, এ্যাবসলিউট অ্যালকোহল, ভেষজ কেনাবিস, গাঁজা, দেশি-বিদেশি মদ প্রভৃতি ঘুণে পোকার মতো কুরে কুরে খাচ্ছে মানব অস্থিমজ্জাকে। এ ভয়ানক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারীদের অন্যতম রুট ও বাজারে পরিণত হয়েছে। আফ্রিকা, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, ভারত, মিয়ানমার, মালাবি থেকে শুরু করে ইউরোপ ও আমেরিকার মাদক ব্যবসায়ীদের নজর এখন বাংলাদেশের দিকে।
দেশে কোকেন ও হেরোইনের বেশিরভাগ চালান আসে আফ্রিকা ও নাইজেরিয়ার নাগরিকদের মাধ্যমে। ইয়াবা আসে মিয়ানমার থেকে এবং ফেনসিডিল ও গাঁজা ভারত থেকে। সীমান্তের ৯৫টি পয়েন্ট দিয়ে মাদক প্রবেশ করে, যার মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলের ৯টি জেলার ৫১টি পয়েন্ট সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য বলছে, বাংলাদেশকে এখন হেরোইন ও কোকেনের ‘ভিআইপি রুট’ হিসেবে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক চক্র। যদিও দেশে এই মাদকের চাহিদা তুলনামূলক কম, কিন্তু আন্তর্জাতিক পাচারের জন্য এটি নিরাপদ ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে—মাদক কেনাবেচায় ডার্ক ওয়েব ও বিটকয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার। পরিচয় গোপন রেখে ডার্ক ওয়েবে বিক্রি হয় নিষিদ্ধ মাদক, যা শনাক্ত করাও কঠিন। সম্প্রতি এই মাধ্যমে মাদক কিনে দেশে আনা এবং পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এশিয়ার তিনটি প্রধান মাদক উৎপাদন অঞ্চল—গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট এবং গোল্ডেন ওয়েজ—এর কাছাকাছি হওয়ায় মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে বাংলাদেশ নিরাপদ গন্তব্য হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে উন্নত স্ক্যানিং প্রযুক্তির অভাব, এয়ারপোর্টে দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা, প্রভাবশালীদের সংশ্লিষ্টতা ও প্রশাসনের একাংশকে ম্যানেজযোগ্য ভাবায় মাদক চোরাচালানে উৎসাহ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক চক্রকে।
সীমান্ত ও আকাশপথে মাদক প্রবেশ ঠেকাতে প্রশাসনের ব্যর্থতা, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাংশের সংশ্লিষ্টতা, সামাজিক আন্দোলনের দুর্বলতা—সব মিলিয়ে মাদকের বিস্তার থামছে না।
চিকিৎসকদের মতে, শরীর ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব ভয়াবহ।
স্বল্পমেয়াদি প্রভাব: শ্বাস-প্রশ্বাস হ্রাস, স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ হ্রাস, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, চোখ লাল হওয়া, নিদ্রাহীনতা, আচরণে মাতাল ভাব।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: মস্তিষ্কের কোষ নষ্ট, স্মৃতিভ্রংশ, যৌনক্ষমতা হ্রাস, ক্যানসার, যক্ষা, কিডনি ও লিভারের জটিলতা, গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, বিষণ্ণতা, আত্মহত্যার প্রবণতা।
চিহ্নিত করার উপায়: মাদকসেবীদের চিহ্নিত করতে পারিবারিক পর্যবেক্ষণ জরুরি। যেমন—চোখ লাল হওয়া, অপ্রয়োজনে টাকা খরচ, একাকীত্ব, নির্জনে সময় কাটানো, আচরণে পরিবর্তন ইত্যাদি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সরকারি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছেন ১,৬৭,৫১২ জন এবং বেসরকারি কেন্দ্রে ১,৫৩,৩৪১ জন। সবমিলিয়ে ৩,২০,৮৫৩ জন মাদকাসক্ত ব্যক্তি নিরাময়ের চেষ্টা করেছেন।
মাদকাসক্ত ব্যক্তি নিরাময়ের জন্য সমাজ ও পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। ভালোবাসা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। মানসিক চাপে না রাখা। আসক্তির মূল কারণ খুঁজে তা সমাধান করা। পরিবার থেকে দূরে রাখতে না দিয়ে একত্রে সময় কাটানো। পেশাদার চিকিৎসা সহায়তা নেওয়া।
শুধু আইন করলেই চলবে না, দরকার সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা। প্রয়োজন মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষা ও সংস্কারমূলক কার্যক্রম। আসুন, মাদকবিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করি—নিজে বাঁচি, পরিবারকে বাঁচাই, দেশকে রক্ষা করি। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই গড়ে উঠবে একটি সুস্থ, সুন্দর ও মাদকমুক্ত সমাজ।
(ঢাকাটাইমস/২৬ জুন/আরজেড)

মন্তব্য করুন