মানিকগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে দুর্নীতির চিত্র-১
দুধারী দালাল চক্রে জেরবার গ্রাহকরা
সিঙ্গাইরের শাহ আলম (ছদ্মনাম) শনিবার মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে এসেছেন আবেদন জমা দিতে। অফিসে ঢোকার আগে বেশ কয়েকজন তার কাছে জানতে চেয়েছে এখানে আসার উপলক্ষ সম্পর্কে। ফরম জমা দেয়ার কথা শুনে কেউ কেউ তাকে প্রস্তাব দেয় তারা কাজটি করে দিতে পারবে খুব সহজে।
শাহ আলম তাদের এড়িয়ে নিজেই ফরম জমা দিতে গিয়ে ফিরে এলেন। কারণ তার ফরমে নাকি কিছু ভুল আছে। একজন তাকে পাশে সরিয়ে নিয়ে বোঝালেন তাদের দিয়ে পাসপোর্ট করালে লাভই হবে।
এই ‘লাভ’ দেখলেন শিবালয় উপজেলার টেপরা এলাকার শওকত আলী নামের একজন গ্রাহক। দালালদের মাধ্যমে নয় হাজার টাকায় যে পাসপোর্ট পেলেন সেটিতে জন্মতারিখে ভুল। সেটি সংশোধন করতে তার গাঁট থেকে গেছে আরো সাড়ে তিন হাজার।
এভাবেই দুধারী দালাল চক্রে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন মানিকগঞ্জের পাসপোর্ট গ্রাহকরা। আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের ছত্রছায়ায় শহরের বেউথা এলাকায় গড়ে উঠেছে একটি দালাল চক্র (সিন্ডিকেট)। এই চক্রের হাত ছাড়া গ্রাহকদের কাছে পৌঁছায় না ‘সোনার হরিণ’ খ্যাত পাসপোর্ট।
২০১০ সালে মানিকগঞ্জের সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে স্থাপন করা হয় আঞ্চলিক পাসর্পোট অফিস। শুরুর দিকে হাতে লেখা (এনালগ) পদ্ধতির পাসপোর্ট গ্রাহকদের দেয়া হতো। ২০১১ সালে রূপান্তরিত হয় ডিজিটালে। এরপর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পাসপোর্ট অফিসটি বেউথা এলাকার একটি ভাড়া বাসায় স্থানান্তর হয়।
মানিকগঞ্জে পাসপোর্ট কার্যক্রম শুরুর পর সেখানে গড়ে ওঠে একটি দালাল চক্র (সিন্ডিকেট)। পাসপোর্ট অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে তাদের সঙ্গে।
শুরুর দিকে জেলা প্রশাসক (ডিসি) অফিসের কর্তব্যরত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা দালাল সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ডিসি কোর্টের পেশকার সাজ্জাদ হোসেন, অফিস সহকারী শরিফ ও মাসুদুর রহমান, ডিসি অফিসের পিয়ন শামসুল ও শরিফ। এদের বাইরে শহরের বেউথা এলাকার কামরুল ইসলাম ওরফে চেয়ারম্যান কামরুল, শামসুল আলম ওরফে পার্থ, মিঠু, রানা ও মমিন; সিঙ্গাইর উপজেলার দেলোয়ার হোসেন, শফিক, দুলাল ও মোহন; সদর উপজেলার বেতিলা ইউনিয়নের রফিক ও খাজা মাইনুদ্দিন এবং পুটাইলের রফিক মিয়া, কৈতরা এলাকার চিত্ত, ভাড়ারিয়া এলাকার ভাষান। এ ছাড়া পাসপোর্ট অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে জেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে দালাল সিন্ডিকেট।
ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যকেন্দ্রেও রয়েছে এই দালালদের আনাগোনা। এসব দালালের খপ্পরে পড়ে গ্রামের সহজ-সরল মানুষ প্রতারিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, একটি সাধারণ পাসপোর্ট (২১ দিনে) করতে সরকারি ফি বাবদ গ্রাহকদের ব্যাংকে জমা দিতে হয় তিন হাজার ৪৫০ টাকা। আর জরুরি পাসপোর্ট (৯ দিনে) করতে ফ্রি জমা দিতে হয় ৬ হাজার ৯০০ টাকা। নিয়ম অনুযায়ী, একজন গ্রাহক নির্ধারিত ফরমে আবেদন করে ব্যাংকে টাকা জমাদানের রশিদ ফরমে সংযুক্ত করে অফিসে জমা দিলে পাসপোর্ট পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বিষয়টা এত সরল না। আবেদনকারীরা সরাসরি অফিসে গেলে পূরণ করা ফরমে নানা ত্রুটি ধরে তা বাতিল করে দেয়া হয় বেশির ভাগ সময়। যথাযথ নিয়ম মেনে ফরম পূরণ করেও দিনের পর দিন ঘোরাঘুরি করে নিরাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত অফিস থেকে ফিরে আসেন অনেকে। এরপর বাধ্য হয়ে দালাল চক্রের শরণাপন্ন হন তারা।
দালাল প্রক্রিয়ায় নির্ধারিত ফির বাইরে সাধারণ পাসপোর্টের জন্য অতিরিক্ত দুই হাজার টাকা ও জরুরি পাসর্পোটের জন্য চার হাজার টাকা থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত দিতে হয়। দালালদের শর্ত মেনে যারা অতিরিক্ত টাকা দেন তারা সহজেই পাসপোর্ট পেয়ে যান। আর যারা তা দেন না তাদের ভোগান্তির একশেস হয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দালালচক্রের সহযোগিতা না নিয়ে যারা পাসপোর্ট করেছেন, তাদের পাসপোর্টে বড় ধরনের ভুল তথ্য পাওয়া গেছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে দ্বিতীয়বার এমনকি তৃতীয়বার পর্যন্ত পাসপোর্ট করেছেন।
মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের দালালচক্রের অন্যতম এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সাধারণ একটি পাসপোর্টের জন্য আমরা গ্রাহকের কাছ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে থাকি। এর মধ্যে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের ৯০০ টাকা ও পুলিশ তদন্তের (ভেরিফিকেশন) জন্য দিতে হয় ৬০০ টাকা। এই টাকা না দিলে গ্রাহকরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। আর জরুরি পাসপোর্টের জন্য পাসপোর্ট অফিসকে ৯০০ টাকা দিলেও পুলিশকে দিতে হয় ১২০০ টাকা। কখনো কখনো এই টাকার বাইরে আবার সালামি দিতে হয়।’ অন্য দালালদের সঙ্গে কথা বলেও এমন তথ্যই মিলেছে।
মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার টেপরা এলাকার শওকত আলী নামের এক ব্যক্তি দালালচক্রের অন্যতম সদস্য রানার মাধ্যমে পাসপোর্ট করতে গিয়ে খরচ করতে হয় ১২ হাজার ৪৫০ টাকা।
প্রথমে তিনি ১৭ দিনে পাসপোর্ট পেতে রানার সঙ্গে নয় হাজার টাকায় চুক্তি করেন। এরপর শওকত আলী তার পাসপোর্টটি ২৮ দিনে হাতে পান। পরে তিনি দেখতে পান তার পাসপোর্টে জন্মতারিখ ভুল। তা সংশোধন করতে তাকে আরো তিন হাজার ৪৫০ টাকা খোয়াতে হয়। এভাবেই গ্রাহক হয়রানি চলচে মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে।
(ঢাকাটাইমস/১১অক্টোবর/মোআ)
মন্তব্য করুন