বইঃ আমার কথা
ঝুঁকি বনাম সাফল্য
সৈয়দ আবুল হোসেন বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘আমার কথা’। এই বইয়ে তিনি নিজের চিন্তা, কর্মকাণ্ড, মূল্যবোধ, নানা অভিজ্ঞতা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে লিখেছেন। এটি পড়লে তাকে যারা পুরোপুরি চিনেন না তাদের সুবিধা হবে। বইটি ‘ঢাকাটাইমস২৪ডটকম’ ধারাবাহিকভাবে ছাপছে। বইটির আজকের পর্বে থাকছে- ‘ঝুঁকি বনাম সাফল্য’
সম্প্রতি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ও প্রশংসনীয় উন্নয়নের গতি সারাবিশ্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভিধায় পরিচিতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন আজ কেবল কোনো কল্পনা নয়, পরিপূর্ণ বাস্তবতা। যখন মানুষ দেখে আমাদের উচ্চাকাক্সক্ষা এবং বিশাল বিশাল অট্টালিকা, যখন মানুষ দেখে আমরা অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি এবং পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি, এমন সময়ে যখন বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থা সংকটাপন্ন এবং আঞ্চলিক অস্থিরতা বিরাজ করছে, তখন তারা প্রায়ই জিজ্ঞেস করে- কীভাবে তোমরা এত ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো? এবং কেন করো?
আমি বলি : If you are not willing to risk the unusual, you will have to settle for the ordinary. আমাদের অনেক সংকট আছে। অনেক সমস্যা আছে। এত সব সমস্যার মধ্যেও আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় আছে। তাই আমরা এগিয়ে যেতে পারছি। আর এর পেছনে যাঁদের ভূমিকা সবার আগে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়, তাঁরা হচ্ছেন আমাদের দেশের জনগণ- শ্রমিক, গার্মেন্টস কর্মী, শ্রমজীবী আর সব পেশার লোক। উন্নয়ন কর্মকা-ে অনেক ঝুঁকি আছে, আর আমাদের জনগণ ও নেতৃবৃন্দ এ ঝুঁকি নিচ্ছে বলেই আমাদের পক্ষে অনেক অসাধ্য সাধন করা সম্ভব হচ্ছে।
কোনো প্রকল্পই ঝুঁকি ছাড়া বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। যেকোনো কাজের বাস্তবায়নের জন্য নির্দিষ্ট মাত্রার ঝুঁকি নিতে হয়। সুতরাং আমরা কি আমাদের জীবনকে থামিয়ে রাখতে পারি অথবা আমাদের কাজকে? এমনকি ব্যাংকে রাখা জনগণের টাকাও ঝুঁকিপূর্ণ। তাহলে কি আমরা ব্যাংক পরিচালনা করা বন্ধ করে দিতে পারি? কাজে যেতে যে গাড়ি ব্যবহার করি, তার জন্যও ঝুঁকি নিতে হয়। বিমানে ভ্রমণের জন্যও ঝুঁকি নিতে হয়। সুতরাং আমরা কি আমাদের কাজ ও ভ্রমণ বন্ধ করে রাখতে পারব? অবশ্যই নয়। ঝুঁকিই জীবনের গতি এবং সফলতার সোপান।
জীবনটা ঝুঁকিতে পরিপূর্ণ। আমাদের লক্ষ্যসমূহের বাস্তবায়ন কীভাবে সম্ভব হবে, আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী এবং মানুষের সুখ নিশ্চিত হবে কীভাবে, যদি আমরা নতুন নতুন প্রকল্প হাতে না নিই এবং সম্ভাব্য ঝুঁকি গ্রহণ না করি? সব স্থানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে এবং ঝুঁকিও। যারা সামনে এগিয়ে যেতে এবং চূড়ান্ত সফলতা অর্জনের জন্য নিরন্তর কাজ করে যাবে, তারা অবশ্যই সফল হবে। আর যারা অগ্রগতিকে থামিয়ে রাখার জন্য ছুতো খোঁজে, তাদের ছুতোর অভাব হয় না। এমন লোক কখনও সফলতার মুখ দেখে না।
পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্পও সরকার নিজস্ব অর্থায়নে করার মতো ঝুঁকি নিয়েছে। এ ঝুঁকি গ্রহণের মধ্যেও রয়েছে সক্ষমতার স্বাক্ষর। এমন ঝুঁকি অনেকের কাছে অবাক ও অচেনা মনে হলেও আমার কাছে তা একেবারেই না। কারণ বাঙালি জাতি সবসময় ঝুঁকির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে এবং এভাবে সফলতা পেয়েছে। আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা ভাঙতে পারেন কিন্তু মচকাবেন না কখনও। কারণ নিজের ওপর ও নিজের অভিজ্ঞতার ওপর তাঁর প্রচণ্ড বিশ্বাস আছে। তিনি যেটা করতে যান, সেটি করার যোগ্যতা কাজে নামার আগেই অর্জন করে নেন।
মন্ত্রী থাকাকালীন আমি দেখেছি, যখন আমরা নতুন প্রকল্প অথবা ধারণার ঘোষণা দিতাম, তখনই কিছু ঝুঁকির প্রশ্নের সম্মুখীন হতাম, এখনও হয়। আমি বারবার একটি কথাই বলি- সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে, কোনো ধরনের ঝুঁকি না-নেওয়া। এটা সত্য যে, আমরা কোনো প্রকল্প কোনো প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা ছাড়া আরম্ভ করি না, যাতে আমাদের কারও মনে সংশয় বা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। আমরা আমাদের চারপাশে যেসব ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় রয়েছে, তা এড়িয়ে চলি। আমাদের কাজ, নির্মাণ এবং অগ্রগতিকে সকল প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত রাখি। এমনকি আমাদের চারপাশের উত্তেজনা, অশান্তি, বিশৃঙ্খলা এবং যুদ্ধ আমাদের কোনো কার্যক্রমকে স্পর্শ করতে পারে না। গত তিন দশকে আমাদের এ অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংঘর্ষ সংঘটিত হয়েছে। তবু আমরা থেমে থাকিনি। যদি আমরা স্থিতিশীলতার জন্য অপেক্ষা করতাম এবং আমাদের বিশাল বিশাল প্রকল্পগুলো শুরু না করতাম, তাহলে আজ আমাদের অবস্থান কোথায় থাকত?
আঞ্চলিক উত্তেজনা আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে সমস্যা সৃষ্টি করে, আর এ সমস্যার মধ্যেও অপেক্ষাকৃত দ্রুত কাজ এবং আগের থেকেও বড় প্রকল্প সম্পূর্ণ করতে হয়। উন্নয়নের শর্ত হচ্ছে স্থিতিশীলতা। যখন অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা কম থাকে তার মধ্যেও তারা উন্নতিসাধন করতে পারে এবং বড় বড় প্রকল্পকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়, যদি ইচ্ছা ও অধ্যবসায় প্রবল থাকে।
বিশ্বে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের নাগরিকরা হচ্ছে সফলতার মূর্ত প্রতীক। এটা তাদের আত্মবিশ্বাস দেয় এবং প্রমাণ করে- যুদ্ধে নয়, তাদের একমাত্র দৃষ্টি উন্নয়নে। প্রকল্প বাস্তবায়ন রকেট নিক্ষেপের চেয়ে উত্তম এবং সচেতনতা, সমন্বয়সাধন ও টিম স্পিরিট বা দলীয় শক্তি হচ্ছে ভবিষ্যৎ নির্মাণের একমাত্র পথ। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে- এর মাধ্যমে প্রমাণ করেছে, তারা চাইলে যেকোনো কঠিন কাজও অল্প সময়ের মধ্যে করতে পারে। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের যে বিজয় অর্জন হয়েছে তা বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। বাংলাদেশিরা যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের বাধা মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখে।
জাতির শক্তি তার জনগণ। প্রত্যেক জাতি তার জনগণের শক্তি ব্যবহার করে গঠনমূলক কাজে, যার মাধ্যমে তারা আশাবাদী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। আর তা না হলে উত্তেজনা, বিশৃঙ্খলা, অশান্তি এবং যুদ্ধে ব্যবহৃত হয় জনগণের শক্তি। বাংলাদেশিরা হচ্ছে বুদ্ধিমান লোক এবং আমি এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ আশাবাদী। যদিও আমরা কিছু উত্তেজনা, বিশৃঙ্খলা এবং অশান্তি দেখতে পাই, তাহলেও এগুলো কাটিয়ে উঠে আগামী দিনে আরও ভালো অবস্থানে যেতে হবে আমাদের।
যেকোনো কাজের বাস্তবায়নের জন্য নির্দিষ্ট মাত্রার ঝুঁকি নিতে হয়। আমরা কি আমাদের জীবনকে থামিয়ে রাখতে পারি অথবা আমাদের কাজকে- কেবল ঝুঁকির জন্য? পারি না। কারণ জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে ঝুঁকি নিতেই হবে। ঝুঁকিহীন জীবনের কোনো সাফল্যও আসবে না- যা ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও উন্নতির জন্য বারবার ঝুঁকি নিয়েছে। তা না নিয়ে যদি স্থিতিশীলতার জন্য অপেক্ষা করত এবং দেশের বিশাল বিশাল প্রকল্পগুলো শুরু না করত- তা হলে কি হতো? তাহলে আজ আমাদের অবস্থান কোথায় থাকত?
ঝুঁকি ছাড়াও আর একটা জিনিস আছে- যেটি আমাদের নতুন প্রকল্প গ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। সেটি হচ্ছে সমালোচনা। সমালোচনার ভয়ে অনেক কৃতিত্বপূর্ণ কাজ থেমে গেছে, অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি তার সৃজনশীলতা হতে বিরত থেকেছেন। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, সমালোচনা এড়ানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে কোনো কিছু না করে ঘুমিয়ে থাকা। কিন্তু ঘুমন্ত জাতি কি কখনও উন্নতি করতে পারে? যে ঘুমিয়ে থাকে তার ভাগ্যও ঘুমিয়ে থাকে।
ঝুঁকি নেওয়া এবং ব্যর্থ হওয়া- আসলে ব্যর্থতা নয়, বরং ঝুঁকি নিতে ভয় পাওয়াই প্রকৃত ব্যর্থতা। বাংলাদেশ, বাংলাদেশের জনগণ ঝুঁকি নিতে পেরেছে বলেই- আজ এগিয়ে যাচ্ছে, সফলতার মুখ দেখছে।আমি এখন অন্য একটি ঝুঁকি গ্রহণের বিষয়ে কিছু বলতে চাই। এটা হচ্ছে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঝুঁকি গ্রহণ। অসুবিধা, সমস্যা এবং ক্ষতির আশঙ্কা ছাড়া কোনো ব্যক্তি তার জীবনে ঝুঁকি নিতে পারবে না এবং নতুন কোনো কিছু শিখতেও পারবে না। সে কোনো সময় নিজেকে বদলাতেও পারবে না। সে কখনও ভালবাসার সাহসও দেখাতে পারবে না এবং সে কখনও তার জীবনকে পরিপূর্ণ করতে সক্ষম হবে না। আপনি নতুন কোনো সাগর আবিষ্কার করতে পারবেন না, যদি আপনার সাহসের অভাব থাকে এবং আপনার তীর বা কূল হারানোর ভয় থাকে। জীবন হচ্ছে অভিজ্ঞতার সমষ্টি; জনগণ, স্থান ও দুঃসাহস- শক্তি, জয় আর লক্ষ্যভেদের সহায়ক শক্তি। ঝুঁকি গ্রহণ এগুলোকে পুঞ্জীভূত করে। ঝুঁকি এড়াতে চাইলে, এগুলো আপনাকে হারাতে হবে। তাই ঝুঁকি গ্রহণই কেবল ঝুঁকিমুক্ত থাকার উত্তম উপায়।
প্রায়শ আমি দেখি, দুজন লোক, যারা একই পরিবেশে বড় হয়েছে, একই শিক্ষায় শিক্ষিত, সমান মেধাবী কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে একজনের চেয়ে আরেকজন বেশি সফল। এর কারণ কী? বা এমন কেন হয়? কারণ হচ্ছে, একজন তার ধারণা বা চিন্তাকে সত্যে পরিণত করার জন্য ব্যাখ্যা করার সাহস রাখে, উদ্ভাবনকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে এবং তা তার জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। আর অন্যজন এরকম সাহস দেখাতে পারে না। ঝুঁকি নেওয়া এবং ব্যর্থ হওয়া- আসলে ব্যর্থতা নয়, বরং ঝুঁকি নিতে ভয় পাওয়াই প্রকৃত ব্যর্থতা। বাংলাদেশ, বাংলাদেশের জনগণ ঝুঁকি নিতে পেরেছে বলেই- আজ এগিয়ে যাচ্ছে, সফলতার মুখ দেখছে।
আগামীকাল কাল থাকছে - “ক্যারিয়ার গঠনে প্রতিযোগিতা”
আরও পড়ুন - ভিশন-২০২১, ‘সৃজনশীলতা’ ‘বিনিয়োগ’, ‘বাংলার বসন্ত’, ‘সময়, শ্রম ও অধ্যবসায়’ ‘আমার আদর্শ আমার নায়ক’ , ‘ধৈর্য পরীক্ষা’, ‘খেলাধুলা ও বাংলাদেশ’ ‘অধ্যয়ন, লেখালেখি ও নেতৃত্ব’ ‘নারীর ক্ষমতায়ন ও বাংলাদেশ’, ‘সাফল্যের স্বর্ণদ্বার’ , ‘ঐক্যবদ্ধ শক্তি সাফল্যের মেরুদণ্ড’ ‘পদ্মা সেতু’, `বিজয়চিহ্ন 'V' প্রকাশে ভিন্নতা', ‘উন্নয়ন ও অগ্রাধিকার’ , ‘ইতিবাচক ভাবনা সাফল্যের চাবিকাঠি’ , ‘ভবিষ্যতের সরকার কেমন হবে’ ‘মাতৃভাষার প্রতি মমতা’, ‘সুখ ও শান্তি : আমাদের করণীয়’ , ‘নেতৃত্বের শক্তি’, ‘আদর্শ জীবন গঠনে মূল্যবোধ’, ‘আমার প্রাত্যহিক জীবন’, 'আমার অনুভব'।মন্তব্য করুন