বইঃ আমার কথা

‘অধ্যয়ন, লেখালেখি ও নেতৃত্ব’

ঢাকা টাইমস ডেস্ক
  প্রকাশিত : ২৯ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:১০| আপডেট : ২৯ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:২৪
অ- অ+

সৈয়দ আবুল হোসেন বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আমার কথা। এই বইয়ে তিনি নিজের চিন্তা, কর্মকান্ড, মূল্যবোধ, নানা অভিজ্ঞতা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে লিখেছেন। এটি পড়লে তাকে যারা পুরোপুরি চিনেন না তাদের সুবিধা হবে। বইটি ঢাকাটাইমস২৪ডটকম ধারাবাহিকভাবে ছাপছে। আজ পড়ুন বইটির প্রথম অধ্যায় ‘অধ্যয়ন, লেখালেখি ও নেতৃত্ব’

লেখা, পড়া, আলোচনা এবং সমাজকল্যাণ- এই চারটি আমার চলার গতি ও জীবনের ছন্দ। সেসঙ্গে পছন্দ গবেষণা। পড়ার মধ্যে যে বিষয়টি আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে সেটি হচ্ছে- কবিতা। এ চারটি বিষয়ের মধ্যে গভীর একটা সম্পর্ক রয়েছে। আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়- এ চারটির মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক রয়েছে?

উত্তর হবে- একটির সঙ্গে অপরটির অবশ্যই গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

লেখালেখি হচ্ছে গর্ব, সম্মান, শৌর্য, ঐতিহ্য, মর্যাদা এবং আভিজাত্যের প্রতীক। ফ্রান্সিস বেকনের ভাষায়: Reading maketh a full man; conference a ready man; and writing an exact man. নিজের সম্পর্কে লিখতে পারা এবং নিজের কাজ সম্পর্কে লেখা, এমনকি নিজেকে নিয়ে প্রচারিত সমালোচনার জবাবদিহি করতে পারা- একজন ভালো নেতার চরিত্রের জন্য আবশ্যক। আমি লিখতে লিখতে অনেক কিছু শিখেছি এবং লিখতে গিয়ে আমাকে অনেক পড়তেও হয়েছে। আমি আমার সংগ্রহে রাখা অনেকগুলো বই মাঝে মাঝে পৃষ্ঠা উল্টে দেখি, কিছু কিছু একাগ্রতায় পড়ি। বইয়ের সংগ্রহ আমার ভীষণ পছন্দের। নিজে লেখা মানে নিজের একটি সুন্দর পৃথিবীর দেখা পাওয়া, যে এর ভালবাসায় পড়েছে সে কখনও এই ভালবাসার বন্ধন ছিন্ন করতে পারবে না। তাই লেখালেখি করাটাই প্রায় সবার জন্যই প্রয়োজন। বিশেষ করে, যারা নিজেকে সৎ মনে করে, মানবকল্যাণে কাজ করে।

নিজে লেখা মানে নিজের একটি সুন্দর পৃথিবীর দেখা পাওয়া, যে এর ভালবাসায় পড়েছে সে কখনও এই ভালবাসার বন্ধন ছিন্ন করতে পারবে না। তাই লেখালেখি করাটাই প্রায় সবার জন্যই প্রয়োজন।

আমার প্রথম পছন্দ- লেখা। তারপর অন্যদের লেখাসমূহ ভালোভাবে পড়া। এটা আমার শিশুবেলা থেকে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যগত চরিত্র। লেখার জন্য ও পড়ার জন্য প্রয়োজন সঠিক ও যথাযথ পরিকল্পনা, ধৈর্য এবং উচ্চ নিয়ন্ত্রণক্ষমতা। এসব গুণ একজন নেতার বিকাশ ও প্রকাশ এবং নিজের স্থায়িত্বের জন্য অত্যাবশ্যক। পৃথিবীর প্রায় সব বিখ্যাত নেতারাই ছিলেন লেখক এবং একই সঙ্গে একাগ্র পাঠক। এ প্রসঙ্গে প্লেটো, অ্যারিস্টেটল, কার্ল মার্ক্স, জর্জ অরওয়েল, বারাক ওবামা, ম্যাকিয়াভ্যালি, এডল্ফ্ হিটলার, বিল ক্লিনটন, জর্জ বুশ, কেনেডি, আব্রাহাম লিংকন, বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন, স্তালিন, মহাত্মা গান্ধী, উইনস্টন চার্চিল, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, ইন্দিরা গান্ধী, রুজভেল্ট, জওহরলাল নেহেরু, জর্জ ওয়াশিংটনসহ আরও অজস্র বিখ্যাত ব্যক্তির কথা বলা যায়। তাঁরা নেতা ছিলেন, তবে এখন নেতার চেয়ে লেখক হিসাবে অনেক বেশি পরিচিত।

আমি গল্প-উপন্যাস ও প্রবন্ধ পড়তে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তারপরও বলব, কবিতা হচ্ছে একটি ভিন্ন জগৎ। প্রেম আর দ্রোহের অপূর্ব সম্মিলন। একজন কবির চোখ অন্তরের সঙ্গে যুক্ত। কবির চক্ষু এবং হৃদয় অন্যদের থেকে ভিন্ন। একজন কবি যা দেখে, অন্যরা তা দেখতে ব্যর্থ। কবি আকাশ, সাগর এবং প্রকৃতির ভাষা বুঝতে পারেন। তার হৃদয় আবেগে পূর্ণ থাকে, কবি তার আশপাশের দৃশ্য থেকে জীবেনের সৌন্দর্য খুঁজে নিতে পারে। তার হৃদয় খুবই স্পর্শকাতর। কবি তার সমাজকে ভালো করে জানে এবং সমাজের সুখ, আনন্দ ও উদ্বেগ তাকে ছুঁয়ে যায়। এমনকি তার কল্পনা জীবন্ত হয়ে ওঠে, যা কথা বলে মানুষের ও তাদের অন্তরের সঙ্গে ভাববিনিময় করে অভিন্ন হৃদ্যতায়।

আর একটা বিষয় আমার পড়তে খুব ভালো লাগে, সেটি হচ্ছে কোটেশন। এটাকে আমরা জ্ঞানের সারাংশ বলতে পারি। কোটেশন জীবনাভিজ্ঞতার প্রায়োগিক প্রকাশ। এটি আমাদের শক্তি দেয়, সাহস দেয়, উৎসাহ দেয়। অল্পকথায়, বেশি কিছু আহরণের জন্য কোটেশনের বিকল্প নেই।

সফল সব নেতার অবশ্যই প্রবল আবেগ থাকতে হবে, যা তার নেতৃত্বকে করবে স্বতন্ত্র, গভীর এবং অতুলনীয়। আবেগ না-থাকলে সে মানুষ কখনও অন্যকে ভালবাসতে পারে না। যে অন্যকে ভালবাসতে পারে না সে হয় স্বার্থপর। স্বার্থপর মানুষ কখনও জনগণের কল্যাণ করতে পারে না। এই কারণেই স্বার্থহীনভাবেই জনগণের জন্য কাজ করতে হবে। সেখানে আবেগ দিয়ে তাদের কথাগুলো, দুঃখগুলো বুঝতে হবে। জনগণের দুঃখ মুছে দেওয়া একজন সফল নেতার কাজ।

আমার জীবন লেখা, পড়া, কবিতা এবং জনসেবা মিলে একটি চতুর্ভুজে পরিণত হয়েছে। একটির সঙ্গে অপরটির গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। আপনি হতে পারেন ভালো লেখক, ভালো পাঠক, কবি, অশ্বারোহী অথবা নেতা। অবশ্যই আমি এটা মনে করি না যে, প্রত্যেক নেতাকে কবি বা লেখক হতে হবে। তবে প্রত্যেক নেতার অবশ্যই সংবেদনশীল আবেগ থাকতে হবে, যে আবেগ তার নেতৃত্বকে করবে স্বতন্ত্র, গভীর এবং অতুলনীয়। লেখক ও কবির চোখ এবং আত্মা অন্যান্যদের চেয়ে আলাদা। তারা সবকিছুকেই ভিন্নভাবে দেখে। তাদের দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী।

লেখক হিসাবে আমি যত গভীর ও মগ্ন, তত প্রচারবিমুখ। আমি লিখি সৃষ্টির আনন্দে, এখানে পাখির কূজনের মতো সুর আছে, কিন্তু প্রকাশের বাহুল্য নেই। আমার লেখা গ্রন্থের মধ্যে নিচের কয়েকটির কথা উল্লেখ করা যায় :

১. স্বাধীনতার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

২. শেখ হাসিনা সংগ্রামী জননেত্রীর প্রতিকৃতি

৩. গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও উন্নয়ন

৪. গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সংকট

৫. আওয়ামী লীগের নীতি ও কৌশল- শিল্পায়ন ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ সমাবেশ

৬. শেখ হাসিনার অক্ষয় কীর্তি- পার্বত্য শান্তিচুক্তি

৭. বঙ্গজননী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব

৮. শেখ হাসিনার অসামান্য সাফল্য

৯. বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সুবর্ণজয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ

১০. আমি ও জবাবদিহিতা

১১. পবিত্র স্মৃতি অ্যালবাম

অনেকে প্রশ্ন করেন, আমি রাজনীতিবিদ না ব্যবসায়ী, নাকি লেখক? আসলে আমি তিনটাই। আমি রাজনীতি করি- সেজন্য রাজনীতিবিদ। তবে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে আমি শুধু রাজনীতিবিদ নই; সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী এবং একজন দেশপ্রেমিক। তাই আমাকে আমার ভোটার, পরবর্তী নির্বাচন ও পরবর্তী প্রজন্ম- তিনটার দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। একজন রাজনীতিবিদ শুধু পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কথা ভাবে, কিন্তু একজন দেশপ্রেমিক পরবর্তী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে তার কর্মকা-কে বিকশিত করে। আমি শুধু পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য কাজ করি না, আমি পরবর্তী প্রজন্মের কল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করি। আমার রাজনীতি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, বর্তমানের জন্য এবং ভবিষ্যতের জন্য। তাই জনগণকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছি। আমি মনে করি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরীর মতো মহৎ ও কল্যাণের কাজ আর দ্বিতীয়টি নেই।

আগে দেশ, তারপর রাজনীতি। দেশের উন্নতি ঘটলে জনগণের উন্নয়ন আসবে। আমার শিক্ষক, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিবেশ, ইতিহাস এবং অধ্যয়ন হতে আমি এ শিক্ষা পেয়েছি যে, দেশের চেয়ে বড় কিছু নেই। তাই দেশকে গড়ার লক্ষ্যে আমি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছি। আমার রাজনীতিক চেতনাকে বাস্তবায়ন এবং প্রজন্মান্তরে বিস্তারের জন্য আমার লেখক না হয়ে উপায় নেই। আর ব্যবসায়? সে তো আমার পরিবার-পরিজন পরিচালনার জন্য আবশ্যক। রাজনীতি তো কারও আয়ের পেশা হতে পারে না। যারা রাজনীতিকে অর্থ উপার্জনের উপায় হিসাবে দেখেন- তাদের তো আর রাজনীতিবিদ বা নেতা কোনোটাই বলা যাবে না।

ছাত্ররাজনীতি আমি সমর্থন করি, তবে তা কোনো রাজনীতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করতে নয়। রাজনীতি যদি ছাত্রসমাজের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায় ও ভবিষ্যৎনেতা হিসাবে নিজেদের গঠনের জন্য হয়, তাহলে কেবল সেটাই সমর্থনযোগ্য।

রাজনীতি আমার কাছে কোনো পেশা নয়, আকস্মিক ঘটনার ফল মাত্র। তবে আমার রাজনীতি সর্বদা দেশ ও জাতির জন্য, ব্যক্তির জন্য বা আমার জন্য নয়। যদিও রাজনীতি আমার জীবনের কোনো পরিকল্পনায় ছিল না। আমি নিজের জন্য রাজনীতিতে আসিনি, জনগণের দাবিকে সম্মান করে তাদের কল্যাণে রাজনীতিতে এসেছি। সমাজ, সভ্যতা ও প্রগতির নিয়ামক হচ্ছে রাজনীতি। মহত্তর ও উন্নততর জীবনের সন্ধানেই মানুষ রাজনীতি করে থাকে। রাজনীতির পেছনে থাকে সুনির্দিষ্ট আদর্শ। যদি তা না হতো তাহলে মানুষ রাজনীতি করতে গিয়ে জেল-জুলুম সহ্য করত না, বুলেট-বেয়োনেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারত না। তবে রাজনীতি হতে হবে সুশৃঙ্খল, নীতিবদ্ধ- যা সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে পরিবর্তনশীল হবে, হবে কল্যাণমুখী। সবকিছুরই একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা বা ব্যাকরণ থাকে। তেমনি রাজনীতিরও নিজস্ব ব্যাকরণ ও নিয়ম-শৃঙ্খলা রয়েছে। এটা ভঙ্গ করলে রাজনীতি হয় না, দলনীতি হয়। গণতন্ত্র হয় না, হয় দল ও ব্যক্তিতন্ত্র। যে রাজনীতি গণতন্ত্রের বিকাশ, জনকল্যাণ ও নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চায় উৎসাহী নয়, কেবল ক্ষমতামুখী সে রাজনীতিকে চর দখলের রাজনীতি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। আমি এ ধরনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করিনা।

রাজনীতিকে আমি উন্নয়নের হাতিয়ার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মূল মাধ্যম মনে করি। রাজনীতি ক্ষমতা দেয়, এ ক্ষমতা ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতিহত করার জন্য নয় বরং উন্নয়নের জন্য, মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য। যে রাজনীতি ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতিহত করে, অন্যের বাক্স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ও ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়, সেটি রাজনীতি নয়, পশ্বাচার। গণতন্ত্র মানে জনগণের অংশীদারিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেও রাজনীতির কুফল, বিশেষ করে, বাংলাদেশে এর অপব্যবহার নিয়ে আমি মাঝে মাঝে শঙ্কিত হয়ে উঠি। ছাত্ররাজনীতি আমি সমর্থন করি, তবে তা কোনো রাজনীতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করতে নয়। রাজনীতি যদি ছাত্রসমাজের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায় ও ভবিষ্যনেতা হিসাবে নিজেদের গঠনের জন্য হয়, তাহলে কেবল সেটাই সমর্থনযোগ্য।

রাজনীতি করতে হলে দল প্রয়োজন। যে দল জনমুখী ও সাম্প্রদায়িকতা-মুক্ত সেটিই আমার প্রিয় দল। এমন দলই জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্রষ্টা এবং রক্ষক হিসাবে পূর্ণ দায়িত্ব পালন করার সক্ষমতা রাখে। এমন দল হয় জনগণের দল এবং জনগণই থাকে এর সদস্য, কোনো সন্ত্রাসী দলবাজ ব্যক্তি নয়। এ দল বুঝতে পারে জনগণের হৃদয়-স্পন্দন, সহজে বুঝতে পারে জনগণের মনের গভীরে সুপ্ত থাকা অনুভূতির অব্যক্ত কথা।

রাজনীতির চালক- নেতা। তবে নেতা যদি নেতৃত্বের গুণাবলিতে বিভূষিত না-হন, তাহলে সে রাজনীতি দেশের কল্যাণ নয় বরং অকল্যাণই বয়ে আনে। নেতাকে কথা ও কাজে যেমন শালীন তেমন আন্তরিক হতে হয়। নইলে রাজনীতি মিথ্যানীতির জঞ্জালে পরিণত হয়। আমাদের দেশের নেতৃবৃন্দ অনেক সময় অশালীন ও রূঢ় মন্তব্য করে বসেন। একজন নেতা বা নেত্রীকে কথায় ও কাজে কেবল পারফেক্ট হলেই চলবে না, তাঁকে অনুকরণীয় গুণাবলির অধিকারীও হতে হবে।

নেতার আদিরূপ প্রজা। সাধারণ জনগণই ব্যক্তিকে সাধারণ পর্যায় হতে নেতায় রূপান্তর করে। অনেক নেতা ক্ষমতা পেয়ে নিজেকে সর্বাধিনায়ক ভেবে বসেন। মনে করেন, তিনিই সব। যাঁরা তাঁকে নেতা করেছেন, ক্ষমতায় এনেছেন, তাঁদের তুচ্ছ মনে করেন এবং নেতা হয়ে তাঁদের কথা ভুলে যান। আমি এ অপনীতির বিরোধী। আমি মনে করি, যথাসম্ভব সবাইকে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা উত্তম কৌশল। তাহলে কেউ নিজেকে বঞ্চিত ভাবতে পারবে না। রাষ্ট্র সবার জন্য, সবাইকে সংশ্লিষ্ট করতে না-পারলে রাষ্ট্র-পরিচালনায় কাক্সিক্ষত সাফল্য আসে না। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা গণতন্ত্র ও উন্নয়নের প্রতিকূল ধারণা। নেতা মানে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি- যিনি জনগণের কাজ করবেন, জনগণের কাজে দায়বদ্ধ থাকবেন। নেতা হয়ে যিনি সাধারণ জনগণের কথা ভুলে যান, নিজেকে নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়েন- তিনি নেতা নন, মস্ত এক ব্যথা।

দায়িত্ব পাবার আগে প্রত্যেকের উচিত দায়িত্ব বহনের সামর্থ্য অর্জন। সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রজ্ঞা। উপযুক্ত শিক্ষা আর ত্যাগী মনোভাব ছাড়া তা অর্জন করার কোনো উপায় নেই।

অনেকের কাছে নেতৃত্ব ক্ষমতা জৌলুশের বিষয়, গর্বের বিষয়। আমি নেতৃত্ব ও দায়িত্বকে জৌলুশময় কিছু মনে করি না। আমার মতে, একটি কার্য আর একটি বোঝা। এ বোঝা মূলত বাস্তবায়নের, দায়িত্বের এবং প্রতিজ্ঞার। যে-মস্তকে শোভিত হয় মুকুট, সে-মস্তক কখনও নিশ্চিন্ত থাকে না; হাজারও চিন্তা-ভাবনা, শত সমস্যার কণ্টকে সে মুকুট থাকে সর্বদা আকুল। রাতের ঘুম, দিনের আরাম তখন বিলকুল হারাম হয়ে যায়। বাংলাদেশের মতো হতদরিদ্র দেশ হলে তো কথাই নেই। তাই দায়িত্ব পাবার আগে প্রত্যেকের উচিত দায়িত্ব বহনের সামর্থ্য অর্জন। সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রজ্ঞা। উপযুক্ত শিক্ষা আর ত্যাগী মনোভাব ছাড়া তা অর্জন করার কোনো উপায় নেই। এজন্য আদর্শ নেতা হলে প্রয়োজন আদর্শ পাঠক হওয়ার এবং আদর্শ লেখক হওয়ার। লেখনীর মাধ্যমে তিনি মননশীল জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করে বাংলাদেশের রাজনীতির সহিংস ক্ষেত্রকে সহনশীলতার উর্বর ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত করতে পারেন।

বাংলাদেশের সমস্যা- গুড গভর্নেন্স এবং সুষ্ঠু ও সৎ শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা। সমকালীন রাজনীতি গণতন্ত্রের শ্লোগানে মূখর হলেও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, দূর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে হবে। আমি সুশাসন বলতে ১. সৎ ও প্রত্যয়দীপ্ত নেতৃত্ব, ২. সুষ্ঠু নির্বাচন বা অংশীদারিত্বমূলক গণতন্ত্র এবং ৩. উপযোগী নীতিমালা গ্রহণকে বুঝে থাকি। এ তিনটি বিষয়কে সমন্বিত করার জন্য আমাদের নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া উচিত। এ কাজ করতে গিয়ে আমাদের অনেক বাধাবিঘেœর মুখোমুখি হতে হয়েছে। রাজনীতিক সদিচ্ছার অভাবের কারণে মাঝে মাঝে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হয়েছে। আমাদের জেনে রাখা উচিত, একটি সৎ ও সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারই কেবল এ সব সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম। সন্ত্রাস, স্বৈরশাসন ও দূর্নীতি বিরোধী বাংলাদেশ গড়তে পারে।

‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সুশাসনের অন্যতম পূর্বশর্ত।’ আমি মনে করি, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সুশিক্ষিত ও প্রজ্ঞাময় মানুষ এবং দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন। এজন্য একজন নেতাকে একই সঙ্গে পাঠক ও লেখক হওয়া আবশ্যক।

পৃথিবীতে কয়টি কর্ম আছে?

এ প্রশ্নের উত্তর কোনো সমাজবিজ্ঞানী দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। ষোল কোটি মানুষের ষোল কোটি কর্ম। তবে কিছু কর্ম সবার জন্য, এটি সর্বজনীন অনুভূতির অনিবার্য স্মারক। অনিবার্য স্মারকটা কী?

সাহিত্যকর্ম। হতে পারে গান, কবিতা, লেখা, নৃত্য...। গুনগুন করে গায় না- এমন মানুষ নেই। কলম পেয়ে লেখেনি, লেখার চেষ্টা করেনি- এমন মানুষও নেই। আপন মনে ঘটনার কাঠামো গড়েনি এমন মানুষের সংখ্যাও কম। জীবনের জন্য শ্বাস, চেতনার জন্য প্রকাশ। এ প্রকাশটা লেখার মাধ্যমে সবচেয়ে উত্তমরূপে স্থায়ীভাবে করা যায়। তাই যাঁরা লিখতে পারেন তাঁরা সবাই লেখেন, লিখতে চান, লেখক হতে চান। যাঁরা লিখতে পারেন না তাঁরা নিজের মনের কালি দিয়ে মস্তিষ্কে প্লট এঁকে যান, যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কথার মাধ্যমে স্থানান্তর করা হয়। লেখনসামগ্রী বা কৌশল আবিষ্কার হওয়ার পূর্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রজন্মান্তরের এটিই ছিল একমাত্র উপায়।

নইলে কীভাবে প্লেটো-সক্রেটিস-অ্যারিস্টেটল-আর্কিমিডিস- আমাদের কাছে এখনও বর্তমান!

লেখার ফল বই; বই জ্ঞানের সংরক্ষণাগার। বই প্রাগৈতিহাসিক কালের সঙ্গে বর্তমান এবং সুদূর ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন। এমন অবিচ্ছিন্ন সেতুবন্ধন আর হয় না। পৃথিবীর সব সেতু হয়তো ধ্বংস হয়ে যাবে, সব সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেতে পারে, কিন্তু বই, বইয়ের মাধ্যমে রচিত যুগ-পরম্পরা সেতুটি কখনও নষ্ট হবে না, ধ্বংস করার কোনো সাধ্য কারও নেই। চেঙ্গিস খান চীন জয় করে সমস্ত গ্রন্থ ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। বই এত সহজে এত বেশিমাত্রায় বিস্তৃত হয়ে পড়ে যে, কোনো মানুষের পক্ষে আর তাকে করায়ত্তে নিয়ে আসা সম্ভব হয় না। তাই বইকে মানবসভ্যতার চিরন্তন উৎস বলা হয়।

বই বাদ দিলে মানুষ আর পশুতে কি কোনো তফাত থাকে?

না।

মানুষ আর পশুর তফাত- মানুষের বই আছে, পশুর নেই।

মহাকবি আলাওলের পদ্মাবতী রচনাকালীন একটি ঘটনা। মহামন্ত্রী মাগন ঠাকুর আলাওলকে ডেকে বললেন :

তোমার পুঁথির এক কোণায়,

আমার নামটা রেখ ভাই।

এ আমার মিনতি,

আলাওল মহামতি।

হতবাক আলাওল মহামন্ত্রীর আকুতি শুনে হতবাক : প্রভু, আপনি কত মসজিদ করেছেন, মন্দির করেছেন, ভবন করেছেন, রাজ্যের প্রতিটি আকাশচুম্বী ভবনে আপনার নাম। বিশাল আরাকানের অপ্রতিরোধ্য মহামন্ত্রী আপনি, গাছপালা হতে পশুপাখি, নদী হতে সাগর- সবকিছু আপনার গুণগানে রত। এসব আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে চিরকাল। আপনার কর্ম সমুদ্র, আমার নগণ্য গ্রন্থ শিশির মাত্র। আমার গ্রন্থে আপনার নাম রাখার আকুতি সমুদ্রের কাছে শিশির প্রার্থনার মতো।

হতাশ কণ্ঠে উদাস সুর তুলে মাগন ঠাকুর বলেছিলেন :

মসজিদ মন্দির নিজ দেশে রহে

গ্রন্থ কথা যথা তথা সর্বত্র বহে।

আলাওল মহামন্ত্রী মাগন ঠাকুরের অনুরোধ রেখেছিলেন। পদ্মাবতী পুঁথির মাধ্যমে মাগন ঠাকুর আজও জীবিত। আরাকানে কত মন্ত্রী এলেন গেলেন; কত ভবন হলো কে-বা মনে রাখে। কিন্তু আলাওলের গ্রন্থের একটা ক্ষুদ্র কোণায় লিখে রাখা নামের জন্য মাগন ঠাকুর চিরজীবী হয়ে আছেন।

আমার লেখা আমার হয়ে সবার। আমার চেতনার শৈশব, অভিজ্ঞতার বিনিময়, চিন্তার ফল। এখানে আমার চিন্তা-ভাবনা প্রতিফলিত। প্রতিফলিত আমার অনুভূতি, রাজনীতি ও ধর্মীয় দর্শন। আমার লেখা নিয়ে আমি কখনও তেমন ভাবিনি, আমার অস্তিত্বের সাথে এগুলো লীন হয়ে ছিল নিজের হৃৎস্পন্দনের মতো। তবে কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তি আমার কয়েকটি বই নিয়ে আলোচনা করেছেন। তন্মধ্যে এশিয়ার বিখ্যাত ইতিহাসবেত্তা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. আবদুল করিম, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী প্রমুখ অন্যতম।

আমার লেখা গ্রন্থসমগ্রের কোনো ঐতিহাসিক মূল্য কিংবা সাহিত্যিক তাৎপর্য আছে কিনা জানি না। এ নিয়ে আমি কখনও ভাবিনি, এখনও ভাবি না। এখানে আমি উৎসব, প্রকৃতির ন্যায়, পাখির কাকলীর মতো সৃষ্টির উল্লাসে অনুরণিত- যা সাহিত্য বা ঐতিহাসিক মূল্যের চেয়ে অনেক বড়। সৃষ্টির আনন্দ যেখানে উদ্বেল, প্রকাশ সেখানে নির্মোহ; সৃষ্টি যেখানে পার্থিবতাকে অতিক্রম করে, সফলতা-অসফলতা নামক ঠুনকো বিষয় সেখানে তুচ্ছই বটে।

মসজিদ মন্দির নিজ দেশে রহে গ্রন্থ কথা যথা তথা সর্বত্র বহে। আমার লেখা আমার চেতনার বিকাশ। এখানে এত আনন্দ যে, অন্য সব নগণ্য। কতটুকু সফল হয়েছি জানি না। তবে, অনেক বোদ্ধাজন আমার লেখার প্রশংসা করেছেন, অনেকে চিঠিও লিখেছেন, এখনও আলোচনা করেন। হতে পারে অতিরঞ্জিত অথবা আমাকে খুশি করার কৌশল। যেটিই হোক তাতে আমি উৎসাহিত হয়েছি। কিন্তু ব্যবসায়, রাজনীতি ও সামাজিক কর্মকা-ে অতি ব্যস্ততার কারণে লেখক হওয়ার সাধ পূরণ হয়নি। এভাবে মানুষের অনেক ইচ্ছা বৃক্ষের অসংখ্য পাতার মতো ধীরে ধীরে ঝরে পড়ে। প্রাপ্ত প্রশংসা কতটুকু যৌক্তিক তাও ভেবে দেখিনি। তবু আমি লিখে যাই, পাখি যেমন গান গেয়ে যায়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়:

কেউ ভোলে না ভোলে

অতীত দিনের স্মৃতি

কেউ দুঃখলয়ে কাঁদে

কেউ ভুলিতে গায় গীত।

আগামীকাল কাল থাকছে - 'খেলাধুলা ও বাংলাদেশ'

আরও পড়ুন - ‘নারীর ক্ষমতায়ন ও বাংলাদেশ’, ‘সাফল্যের স্বর্ণদ্বার’ , ‘ঐক্যবদ্ধ শক্তি সাফল্যের মেরুদণ্ড’ ‘পদ্মা সেতু’, `বিজয়চিহ্ন 'V' প্রকাশে ভিন্নতা', ‘উন্নয়ন ও অগ্রাধিকার’ , ​‘ইতিবাচক ভাবনা সাফল্যের চাবিকাঠি’ , ‘ভবিষ্যতের সরকার কেমন হবে’ ‘মাতৃভাষার প্রতি মমতা’, ‘সুখ ও শান্তি : আমাদের করণীয়’ , ‘নেতৃত্বের শক্তি’, ‘আদর্শ জীবন গঠনে মূল্যবোধ’, ‘আমার প্রাত্যহিক জীবন’​, 'আমার অনুভব'

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
সারা দেশে জুন মাসে ৬৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭১১ জন নিহত হয়েছে: যাত্রী কল্যাণ সমিতি
হাত-পা ছাড়াই জন্ম নেওয়া সেই লিতুন জিরা এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে নজর কাড়লো
বিজিবি'র ১০৩তম রিক্রুট ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপ্তি, শপথ নিল ৬৯৪ নবীন সৈনিক
এসএসসিতে জিপিএ-পাঁচ পেয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার শিক্ষার্থী
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা