ক্যাম্পাস বেইজড গণসচেতনতামূলক আন্দোলনের পথিকৃৎ আনোয়ার হোসেন

ড. সুশান্ত কুমার
  প্রকাশিত : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫:৪০| আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:৪১
অ- অ+

পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশ ছাত্রছাত্রী। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণে অনেকেই ছাত্রত্ব হতে বঞ্চিত। তাদের সবাইকে একত্রে কোমলমতি বলা হয়। বর্তমান পৃথিবীতে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অধিকাংশ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অভীষ্ট লক্ষ্যে আরোহণ করতে অভ্যস্ত। এতে হিতে বিপরীত হচ্ছে। কারণ মানুষ চায় তাকে মূল্যায়ন করুক। মূল্যায়ন করলে সে কথা শুনে। বলপ্রয়োগ করলে কাছের মানুষও দূরে চলে যায়। বলপ্রয়োগকারীকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। মানুষ বিষয়টিকে ইগোতে নেয়। কোমলমতিদের সঙ্গে সকল মানুষই কোনো না কোনো বন্ধনে জড়িয়ে রয়েছেন। কাজেই এ কোমলমতিদের সচেতন করে তাদের মাধ্যমে অন্য কোমলমতিদের, অতঃপর কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে অন্য ছাত্রছাত্রীদেরকে, অবশেষে এ কোমলমতিদের মাধ্যমে পৃথিবীর সকল মানুষকে সচেতন করা সম্ভব। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাতে হাত রেখে কোমলমতিদের মাধ্যমে সচেতন করা হলে তাদের কোমল হৃদয়ে বিষয়টি স্থায়ীভাবে গেঁথে যাবে। কোমলমতিদের ভুল বুঝিয়ে খারাপ কাজও সহজে করে নেওয়া যায়। যেমন ক্ষতিকর নেশাজাতীয় দ্রব্য তাদেরকে দিয়ে বিক্রয় করা হয়, এমনকি তাদেরকে সহজে জঙ্গিতে পরিণত করা যায়। কাজটি যদি ক্ষতিকর নেশা, ইভটিজিং, যৌতুক ও নারী নির্যাতনবিরোধী কাজের মতো বিষয় হয় তবে তো আরো সহজতর। সচেতনতার শক্তি পারমাণবিক বোমা হতে অনেক শক্তিশালী। কারণ বোমা দিয়ে কেবল ধ্বংস করা যায়। সচেতনতার মাধ্যমে সবকিছুই করা যায়। এ কথাগুলো ২০১০ সালে ডিসেম্বর মাসে দিল্লি ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে এক যুবক বক্তব্যে বলেছিলাম। যুবক কাগজে লেখা না দেখে অন্তরের অন্তস্থল থেকে এ কথাগুলো বলে গেছেন। ইংরেজিতে দেওয়া তাদের বক্তব্যে হিন্দি অনুবাদক ছিলাম আমি। ১৫ মিনিটের তার বক্তব্যে আরো অনেক জ্ঞানগর্ভযুক্ত কথা ছিল, যা সকলের হৃদয়ে গেঁথে যায়। যেটুকু আমার মনে পড়ছে ওটুকুই উপরে লেখা হলো। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষাভাষী ছেলে হিসেবে বিষয়টিতে আমি খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলাম। সে যুবকটি আজকের ড. মো. আনোয়ার হোসেন।

ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ২০০৩ ব্যাচ এমবিবিএস প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আমি। আমি স্কলারশিপের জন্য আবেদন করেছিলাম। তিনটি স্কলারশিপ হয়েছিল। দুটি ভারতবর্ষ থেকে পেয়েছিল। একটি বাংলাদেশ ভাগিয়ে নেয়। বাংলাদেশের একজন, তার নাম মো. আনোয়ার হোসেন। প্রায় ৭০ লাখ টাকার স্কলারশিপ বলে কথা। আমার খুব রাগ হয়েছিল যে, একজন বাংলাদেশিকে স্কলারশিপটি দিয়েছিল বলে। তার সাথে জেলাস ফিল করতে করতে সম্পর্কটা বন্ধুত্বে গড়ায়। ডিবেটিং সোসাইটি অব ইন্ডিয়ায়ও জড়ালাম তার সাথে। আমাদের নিজ দেশ হলেও আমরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ভেবেচিন্তে সমীহ করে বিতর্কে জড়াতাম। আমরা কেবলমাত্র সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলতাম। আমাদের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি বিতর্কে সদা সর্বদা ক্ষমতাকে টার্গেট করতেন, তিনি কখনো প্রাইম মিনিস্টার, কখনো চিফ মিনিস্টার, কখনো বিদেশ মন্ত্রী, কখনো হোম মিনিস্টারের বিরুদ্ধে বিতর্কে জড়াতেন। সকলকেই একেবারে তুলোধুনা ও নাস্তানাবুদ করে ছাড়তেন। আমরা অনেক সময় ভয় পেয়ে বলতাম দাদা তোমার স্কলারশিপ যদি বাতিল করে দেয় বা তোমার স্টুডেন্টশিপ যদি বাতিল করে দেয়? আনোয়ার উত্তর দিতেন, আমি এ বিষয়ে এমনিতেই প্র্যাকটিস করবো না। তাকে প্রশ্ন করা হলো তাহলে এত কষ্ট করে পড়াশোনা করছ কেন এ বিষয়ে। সে উত্তর দিত যেকোনো বিষয়ে গ্যাজুয়েট হলে সব কাজ করা সম্ভব। একদিন আনোয়ার বলেন, আমাকে পাগলা কুকুরে কামড়াইছে যে আমি ডাক্তারি করব। একজন রোগীকে কমপক্ষে ১৫ মিনিট সার্ভিস দিতে হয়। এ ১৫ মিনিটে আমি ১৫ হাজার লোককে সার্ভিস দিব। এ কাজকে সেবা বলে অনেকে, আমি বলি মানুষকে চ্যাপ্টা করা। আনোয়ার কিছুক্ষণ পর আমাদেরকে প্রফেসর ডক্টর মাধুর যাদবের কক্ষে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। চেম্বারটি সামনে কিছু হতদরিদ্র ব্যক্তি ছিল। সে বলল তোমরা বলছো এখানে সেবা দেওয়া হয়, আমি বললাম অবশ্যই। এবার বললো দেখো কি ধরনের সেবা দেয়, এই রোগীর কাপড়ের একাংশ ছেঁড়া। এবার আমরা দেখতে পেলাম রোগীটি ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে ঢোকার পূর্ব মুহূর্তে কালেক্টর তাকে বলল আগে ৮০০ টাকা দাও তারপর ঢোকো। রোগী উত্তর দিল আমি গরিব মানুষ এত টাকা দিতে পারব না। এ রোগী অনেক কাকুতি-মিনতি করলেও কালেক্টর টাকা আদায় না করে ছাড়লো না। আনোয়ার চেম্বারে ঢোকে প্রফেসর স্যারকে বললেন স্যার গরিব রোগী তাকে টাকা পয়সা মাফ করা যায় না? প্রফেসর উত্তর দিলেন তুমি তাদেরকে চেনো না। পয়সা থাকলেও বলবে নাই। অবশ্যই এই যাত্রায় প্রফেসর স্যার ৪০০ টাকা মওকুফ করে দিলেন।

ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহলের সর্বভারতীয় আলোচনা অনুষ্ঠিত হলো। বিষয়বস্তু ছিল কিভাবে অল্প সময়ে বেশি কাজ ও এ কাজগুলো আরো বেশি কার্যকর করা যায়। তখন আমরা চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। বয়স ২২ বছরের শেষের দিকে। প্রায় সকল বক্তার বক্তব্যে মূল বিষয় ছিল চলমান কর্মসূচি যেভাবে হচ্ছে তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানগণকে মোটিভেট করে আরো বেশি ও কার্যকর সচেতনতামূলক কর্মসূচি করতে হবে। অন্যদিকে আনোয়ার মাইক হাতে নিয়ে বললেন, আমি এ বিষয়ে একটা পরিকল্পনা করেছি। আমার পরিকল্পনার মূল বিষয় হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও সুপারিশ গ্রহণ করতে হবে। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান কি কারণে আমাদের নির্দেশনা মেনে কার্যক্রমে যথাযথভাবে সহযোগিতা করবে, আমি এর যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না। আমরা তাদের কর্তৃপক্ষ নয়। তারা যেটুকু সহযোগিতা করে ওটা অনেক বেশি। তাদের যে চাকরি চলে যায় না এটাও বেশি। আমরা তো সরকার না। এ কথা শুনে অনেকে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। কেউবা বললেন আনোয়ার প্রতিষ্ঠানের শত্রু, এ কথা শুনলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর কখনো সহযোগিতা করবে না। কেউবা বলে উঠলেন ভয়ংকর একটা কথা, সে বাংলাদেশি লোক সেজন্য ভারতবর্ষে ক্যাম্পাস মাদকমুক্ত হোক এটা চায় না। কেউবা যুক্তি দিলেন পৃথিবীর কোথাও গভর্নমেন্ট কোনো নির্দিষ্ট অর্গানাইজেশনের জন্য এ ধরনের অনুমোদন বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে চাপ সৃষ্টি করেন না। ভারতবর্ষে এটা কল্পনাও করা যায় না। আনোয়ার চিৎকার দিয়ে বললেন এ বিষয়ে আমার আরো কথা আছে। সে মাইক হাতে নিয়ে বলল আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি বর্তমান পৃথিবীর বড় সমস্যা মাদক, ইভটিজিং, যৌতুক ও নারী নির্যাতনের মতো সমস্যা। সে আরো বলল আমরা যেহেতু ভালো কাজ করি, সরকারি দপ্তরে আমাদের একটা সুনাম আছে, কাজেই আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি আমরা যদি বিষয়টিকে যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারি তবে অবশ্যই একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন ও রিকমেন্ডেশন পাবোই। সে আরো যোগ করল এ দায়িত্ব প্রয়োজনে আমি নেব। ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহলের তৎকালীন সর্বভারতীয় প্রেসিডেন্ট, যিনি ৫০-ঊর্ধ্ব বয়সি, চিৎকার করে বলল তুমি যদি এটা করে দেখাতে পারো আমি পদত্যাগ করব এবং তুমি প্রেসিডেন্ট হবে। সেন্ট্রাল প্রেসিডেন্টও বলল, এ নজিরবিহীন ঘটনা যদি তুমি ঘটাতে পারো, তবে আমিও পদত্যাগ করব, তুমি আমার স্থলাভিষিক্ত হবে। আনোয়ার সেদিন বললেন আপনাদের চ্যালেঞ্জ আমি গ্রহণ করলাম, আমাকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি এক্ষুনি দিয়ে দেন, যাতে আমি দ্রুত আবেদনপত্র জমা দিতে পারি। এ যেন ৫০-ঊর্ধ্ব সিনিয়র লিডারদের সঙ্গে মাত্র ২৩ বছর বয়সি এক টগবগে নবীনের যুদ্ধ। হাজারো সংগঠক সেদিন চিৎকার দিয়ে চ্যালেঞ্জ চ্যালেঞ্জ স্লোগানে মুখরিত করে ফেলল। এরপর প্রস্তুতির পালা। আনোয়ার ভারতবর্ষের আইন, শিক্ষা আইন, প্রশাসনিক আইন পড়া শুরু করলো, বিভিন্ন যুক্তি উল্লেখপূর্বক মাত্র দুই পাতার একখানা আবেদন লেখা হলো। যা রাজ্য শিক্ষা সচিব বরাবর লেখা হলো। আবেদন জমা হওয়ার এক সপ্তাহ পর কল করে বলল এমন আবেদন অতীতে কখনো দেখি নাই, আবেদনটি উইথড্র করে নিতে পারেন অথবা নথিজাত করা হবে। আনোয়ার বলল এ বিষয়ে আমার কিছু কথা বলার ছিল, আপনি আমার জন্য অল্প কিছু সময় বরাদ্দ করলে আমি ওই সময় উপস্থিত হয়ে যাব। তিনি পরবর্তী সোমবার সকাল ১০টার সময় আনোয়ারকে কথা বলার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিলেন, আনোয়ার বললেন আমি জুনিয়র মানুষ, সাথে দুইজন নিয়ে আসতে পারি কি, দুজনের অনুমতি মিলল, একজন আমি এবং আরেকজন সৌগত দাদা। সচিব মহোদয় আমাদের টিম লিডার আনোয়ারকে বললেন তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিলাম তোমার কথা বল। আনোয়ার বললেন আমরা তিনজন অর্থাৎ ১৫ মিনিট। সচিব মহোদয় যুক্তির মারপ্যাঁচে পড়ে বাধ্য হয়ে ১৫ মিনিটের সময় দিলেন। আনোয়ার একাই ১২ মিনিটে বর্তমান ভারতবর্ষে মাদক, যৌতুক, ইভটিজিং এবং নারী নির্যাতন সমস্যা উল্লেখপূর্বক এর প্রতিকারের জন্য কোমলমতিদের সচেতন করে তাদের মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করা যাবে বলে বিশদ যুক্তি দাঁড় করাল। সচিব মহোদয় এবং তার টিম যুক্তি শুনে মুচকি হাসতে লাগলেন। সচিব মহোদয় একটা জটিল প্রশ্ন করলেন। প্রশ্নটি হলো ধরে নিলাম আপনি যে সমস্যাগুলোর কথা বললেন তা সত্যি, কিন্তু আমাদের সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট এ ধরনের কোনো সার্কুলার জারি করেনি যে, এ বিষয়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন প্রদান করা যাবে, কাজেই বিষয়টি আমার এখতিয়ারবহির্ভূত। অতএব আপনার আবেদন উইথড্র করেন, অথবা নথিজাত করার নির্দেশনা দিতে হবে আমাকে। আনোয়ার বললেন এ বিষয়ে আমার কথা আছে, আপনি অনুমতি দিলে এক লাইনে বলবো, সচিব বললেন ঠিক আছে বলুন। আনোয়ার বললেন ভারতবর্ষে নির্বাহী বিভাগের প্রদত্ত ক্ষমতা বলে ৩৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রের মৌলিক প্রয়োজনে এবং সৃজনশীল কাজকে উৎসাহিত করার স্বার্থে আপনি অনুমোদন প্রদান করতে পারেন। এবার সচিব বললেন এই এখতিয়ার সাধারণত সচিব ব্যবহার করে না, আমি সুপারিশসহ কেন্দ্রীয় শিক্ষা সচিবকে আগামীকাল ফরওয়ার্ড করবো। যদি তারা প্রয়োজন মনে করে আপনারা অনুমতি পেতে পারেন। ধন্যবাদ ইয়ং লিডার।

এরপর আমাদের যেন তর সইছে না। প্রতিদিন সকাল বিকাল দুপুর আমরা আলোচনা করি, সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায়, কবে আসবে ফলাফল। প্রায় এক মাস পর রাজ্য শিক্ষা সচিবের দপ্তর হতে কল আসলো, ইয়ং লিডার কনগ্রাচুলেশন, চিঠি নিয়ে যেও। এরপর ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহলের ভারতবর্ষের প্রেসিডেন্ট এবং সেন্ট্রাল প্রেসিডেন্ট দুইজনেই পদত্যাগ করতে চাইলেন। আনোয়ার দুজনকেই ফুল হাতে নিয়ে গিয়ে দেখা করে বললেন আপনারা আমার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। আপনাদেরকে খাটো করা মানায় না, আপনারা এ কাজকে অনেকদূর নিয়ে আসছেন। দায়িত্ব অব্যাহত রাখুন। কিছুদিন পর পরবর্তী কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলো, আনোয়ার এবং আমরা তখন ইন্টার্নি ডাক্তার। কাউন্সিলে ৩৩টি দেশের সংগঠনগণ ভোট দিলাম, আনোয়ার একাই পেলেন ১৬ হাজার ছত্রিশ ভোট। নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী মাত্র ৫৬১ ভোটে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করল। রাজ্য বা ভারতবর্ষ নয় আনোয়ার সেন্ট্রাল প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলো। এ যেন এক ইতিহাস রচনা হলো। আমরা সবাই উচ্ছ্বসিত এক বাংলাদেশিকে নিয়ে, এক সততার অনন্য নজিরকে নিয়ে, এক অকুতোভয় অতন্দ্র প্রহরীকে নিয়ে, এক হার না মানা টগবগে যুবককে নিয়ে।

তিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে ঘোষণা দিলেন আজ হতে গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানো যাবে না। এমনকি সস্তা জনপ্রিয়তার মাধ্যম ব্যবহার করে কার্যক্রম করা যাবে না। ব্যক্তিগত প্রচার বন্ধ করতে হবে।

আমার স্মৃতিতে যেন জ্বলজ্বল করছে মার্কো স্ট্রিট হতে শিয়ালদা রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রাপথে প্রাইভেট গাড়ির চাকা বিকল হওয়ার ঘটনা। রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেন আমরা ফেল করলাম। আমি তো নিশ্চিত দিল্লি প্রোগ্রাম মিস হবে। কারণ আনোয়ার কখনো কি ফ্লাইটে দিল্লি যাবে? কিন্তু সে নির্দেশ দিলেন এয়ার ইন্ডিয়া টিকিট কনফার্ম করতে। পকেট হতে ক্রেডিট কার্ড বের করে দিলেন, বলল দ্রুত কর। আমরা মোট তিনজন ছিলাম। আমি ইকোনমি ক্লাসের তিনটি টিকিট পেলাম। কিন্তু ভাবলাম এই সুযোগে বিজনেস ক্লাসের টিকিট করে নেব। আমি বললাম ইকোনমি শ্রেণিতে সিট খালি নেই। তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন ওকে, আমাকে আগে দেখাও। আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। আনোয়ার এবার আমার থেকে ল্যাপটপ কেড়ে নিলেন এবং নিজেই চেক করলেন। ইকোনমি ক্লাস হতে তৎক্ষণাত তিনটি টিকিট নিয়ে নিলেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন গন্তব্যে আনোয়ারের সঙ্গে আমি অসংখ্যবার বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করেছি। বিশেষ করে দিল্লি হতে কলকাতা অধিকাংশ ট্রেনে আমরা যাতায়াত করেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যাতায়াত করেছি রাজধানী এক্সপ্রেস এবং দুরন্ত এক্সপ্রেসে। ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহোল হতে আমাদের জন্য স্লিপার ১ টিকিট করার পারমিশন ছিল, যা সবচেয়ে বেশি মূল্যের টিকিট। কিন্তু আনোয়ার প্রতিবার স্লিপার থ্রি টিকিট করতেন। আমাদের হোটেল ভাড়া এবং কনভেন্সের জন্য অনেক টাকা বরাদ্দ থাকতো। মাঝেমধ্যে তার প্রতিদ্বন্দ্বী দু-একজন আমাদের মাথায় ঢুকাত, তোমাদের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা হতে আনোয়ার নিশ্চয়ই কম খরচ করে বাকি টাকা মেরে দেয়। কিন্তু প্রতিবার শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ডক্টর আনোয়ার আমাদেরকে নির্দেশ দিতেন, পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে হিসাব করে অবশিষ্ট টাকা কোষাগারে জমা প্রদান করতে হবে। আরো বলতেন তোমাদের দেশের টাকা তোমরা সাশ্রয় কর, আমি আর কতদিন। অবশিষ্ট টাকা সব কার্যক্রম শেষ করে কোষাগারে জমা প্রদান করা হতো। তার সততা নিয়ে কখনো প্রশ্ন দেখা দেয়নি। সততার নজির স্থাপন করে তিনি আজও উজ্জ্বল।

ডক্টর আনোয়ারের জীবন ইতিহাস যে কাউকে চমকিত করবে। ২০০৯ সালে আমরা সবাই ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলাম। আমরা সবাই যার যার রিলেশন পছন্দ-অপছন্দ এগুলো নিয়ে কথা বলছিলাম। সে এখানেও ব্যতিক্রম। আনোয়ার বলল আমি অদৃশ্য এক মায়াবতীর অপেক্ষায় রয়েছি। আমার ফ্রেন্ড প্রশ্ন করলো সে কি পরী? আনোয়ার বলল সে মানবী। আবার প্রশ্ন করল তাহলে অদৃশ্য হবে কেন? উত্তর দিল তাকে খুঁজে পায় না এজন্য অদৃশ্য। আবার বলল বেশি খুঁজতে গেলে ইভটিজিং হবে, সে মাত্র হাই স্কুলে পড়ে। ২০১১ সালে বলল মায়াবতী এখন কলেজে। ২০১৬ সালে বলল সে এখন সিলেটে। আরো বললো এখনো কথা বলা হয়নি। দাদা আনোয়ার তার প্রবন্ধে ১৩ বছর লিখলেও আসলে কমপক্ষে ১৫ বছর হবে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম মায়াবতীর বাড়ি কই? বলল প্রথম দেখা ময়মনসিংহ। দাদা আনোয়ার আমার লেখা পড়ে রাগ করবেন না।

শুনেছি আমার দাদা মানসিকভাবে খুব চাপে আছে। মানসিক চাপ থেকে শারীরিকভাবে ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। দাদা আপনার অনেক প্রাণশক্তি। অল্পতে আপনি দুমড়ে-মুচড়ে ও ভেঙে পড়ার পাত্র নন। নিশ্চয়ই বড় কিছু হয়েছে। যদি পাখি হতাম ডানা মেলে আগেই চলে আসতাম। দাদা মন খারাপ করে থাকবেন না। শুনেছি নাকি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আবার আসিব ফিরে বাংলার মাঠঘাট ভালোবেসে। হয়তোবা শঙ্ক চিল শালিকের বেশে।

বর্তমান বিশ্বে যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম করতে হলে অনেক সেন্সরের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অথচ আমাদের ওই একজনই আনোয়ার পৃথিবীর ৫৩টা দেশের যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম করার রাষ্ট্রীয় অনুমোদন পেয়েছে। জাতিসংঘও প্রোফাইল অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা সত্যি গর্ব করার মতো ইতিহাস। বিশ্বে অবাক দৃষ্টান্ত।

আসলে সততা, নিষ্ঠা, মেধা ও সৎ সাহস থাকলে সবই সম্ভব। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া মাত্রই দাদা আনোয়ারকে বললাম, এবার তোমার পথ এবং আমার ভিন্ন হয়ে গেছে। তুমি অর্গানাইজেশনের সেন্ট্রাল প্রেসিডেন্ট। ৫৬ দেশ ভ্রমণ করবে। যদি পাখি হতাম তোমার সঙ্গে উড়ে যেতাম। দাদা আনোয়ার বলল মন খারাপ করছ কেন আমি আছি না। অতঃপর আমাকে নিজের পিএস করার জন্য অর্গানাইজেশনকে প্রস্তাব দিল। আমি পার্সোনাল সেক্রেটারি হলাম। তার সঙ্গে ৩৩টি দেশ ভ্রমণ করলাম। তার কাজের সাক্ষী হলাম। দাদা নিয়মিত কোরআন পড়তেন অর্থসহ। আমি একবার না বুঝে জিজ্ঞেস করলাম তোমাদের ওখানে কয়টা শ্লোক রয়েছে। আনোয়ার বলল শ্লোক নয় আয়াত। আনোয়ার ভ্রমণ করার সময় সকালে নামাজ পড়ে এসে, আমার মাথায় হাত দিয়ে বলে সুশান্ত উঠ, নাস্তা করবে। আমি পিএস হলেও আমাকে কখনো খাটো করে কোথাও পরিচয় দিতে, অথবা ছোট করে কোনো কথা বলতে কখনো শুনিনি। এবং এমনকি অন্য মানুষকে ছোট করে কথা বলতে দেখিনি। কিছুদিন পরেই ডক্টর আনোয়ারকে মাদক চোরাকারবারি বাংলাদেশ হতে অপহরণ করে, ভাগ্যিস ভারতে নিয়ে যায়। হয়তো সৃষ্টিকর্তা তাদের মাথায় গোবর ঢুকিয়ে দিয়েছে, তাই এটাও বুঝে না, ভারত নিয়ে ওকে আটকে রাখা কিভাবে সম্ভব? ভারত নিয়ে আসার পর দল-মত নির্বিশেষে তার প্রতি আশীর্বাদ এবং সহযোগিতার হাত বাড়ায়। বাংলাদেশ সরকারকে বলব ড. আনোয়ারের মতো ব্যক্তিদের যথাযথ নিরাপত্তা প্রদান করুন, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ করে। এ ধরনের অদম্য মেধাবীদের কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ সরকার উপকৃত হতে পারে।

দাদা তোমার দেওয়া সচেতনতামূলক সিক্স ইন ওয়ান থিওরি ভারতবর্ষে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে পড়ানো শুরু করেছে।

দাদা কতদিন দেখিনি তোমায়। মাঝেমধ্যে মনে হয় কিসের বর্ডার, কিসের বিএসএফ, কিসের বিজিবি, কিসের পাসপোর্ট, কিসের ভিসা। দুই বাংলা যদি এক হতো তবে একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাতে হাত রেখে, বলপ্রয়োগ নয়, সচেতন নির্ভর বিশ্ব গড়ে তুলতে পারতাম।

পরিশেষে বলা যায়, দ্য ক্যাম্পাস লিডার ড. আনোয়ারের নেতৃত্বে এগিয়ে যাক কোমলমতিদের দা হলি লাইপ। এসো নেশা থেকে কলম ধরি, মাদকমুক্ত সমাজ গড়ি।

লেখক: ড. সুশান্ত কুমার, কনসালটেন্ট, লেডি হার্ডিংস মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জেনারেল সেক্রেটারি, পশ্চিমবঙ্গ শাখা, ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহল

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
নারী সংস্কার কমিশন মানি না, বাধ্য করলে আন্দোলন: জামায়াত আমির
এবার চিন্ময়ের জামিন স্থগিতের আদেশ প্রত্যাহার, শুনানি রবিবার
গুলশানে নসরুল হামিদের ২০০ কোটি টাকা মূল্যের জমি ক্রোক
খুলনায় ট্যাংক লরি উল্টে দুই নারী নিহত
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা