ঐহিত্য পুরুষ জহির রায়হান

শামসুল আলম বাবু
| আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:৪৮ | প্রকাশিত : ৩০ জানুয়ারি ২০১৭, ০৮:১৬

জহির রায়হান। আমাদের পরিচিত এক ঐতিহ্য পুরুষ। সংস্কৃতি ও রাজনীতি অঙ্গনের এই কৃতি পুরুষের মূল পরিচয় সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার হিসাবে। এছাড়াও তিনি - চলচ্চিত্র প্রযোজক, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, চিত্রগ্রাহক, চিত্র সম্পাদক, চলচ্চিত্র সংগঠক। রাজনৈতিক আদর্শে বিপ্লবে বিশ্বাসী একজন মানুষ। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন ভাষাসৈনিক, সাংবাদিক, মাসিকপত্রের লেখক- সর্বোপরি একজন প্রতিবাদী মানুষ; যিনি ঐতিহ্যকে লালন করেছিলেন নিজের বিশ্বাসে বলিয়ান থেকে।

জহির রায়হানের প্রকৃত নাম মোহাম্মদ জহিরউল্লাহ। ১৯৩৪ সালের ১৯ আগস্ট নোয়াখালিতে তাঁর জন্ম।তার বাবা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ ছিলেন একজন পরহেজগার ব্যক্তি। কলকাতার পর ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন হাবিবুল্লাহ। এ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন।

ছোটবেলা থেকেই জহির রায়হান রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। বড়ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার ও বড়বোন নাফিসা কবির বাম ধারার রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। তাদের কাছ থেকেই জহির রায়হানের বামপন্থী চিন্তাচেতনার হাতেখড়ি হয়। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হন। এ সময় ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা হয়। তিনি সচেতনভাবে ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন।

২১ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক যে ১০ জন প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে গ্রেপ্তার হন, জহির রায়হান ছিলেন তাদের অন্যতম। সেটিই তার জীবনের প্রথম কারাবরণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাঙলা সাহিত্যে অনার্স করে এম.এ ক্লাসে ভর্তি হন। এর পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা ও চলচ্চিত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৫৬ সালের শেষদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত বিখ্যাত চিত্রপরিচালক এ. জে. কারদার (আখতার জং কারদার) তখন পূর্ব পাকিস্তানের পটভূমিকায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের উর্দু সংস্করণ জাগো হুয়া সাভেরা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন। জহির রায়হান এই চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক রূপে যোগ দিলেন। মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রের প্রধান পাত্র-পাত্রী ছিলেন আনিস (খান আতাউর রহমান) ও ভারতের প্রখ্যাত অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র।

জাগো হুয়া সাভেরা’র পরে তিনি এহতেশামের সহকারী রূপে এদেশ তোমার আমার ও সালাউদ্দিনের যে নদী মরু পথে চলচ্চিত্রে কাজ করেন। এসময় তিনি সুমিতা দেবীকে বিয়ে করেন।

এরপর নিজেই চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্রতী হন; ১৯৬১ সালে মুক্তি পায় তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’। সেটি ব্যবসাসফল হয়ে উঠতে পারেনি, তবে সমালোচকদের দৃষ্টি কাড়তে পেরেছিল। এরপর এক এক মুক্তিলাভ করে কাঁচের দেয়াল (পাঁচটি প্রেসিডেন্ট পুরস্কারপ্রাপ্ত), সোনার কাজল, সঙ্গম (পাকিস্তানের প্রথম রঙ্গীন চলচ্চিত্র), বাহানা (পাকিস্তানের প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র), বেহুলা, আনোয়ারা, জীবন থেকে নেয়া (প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র) প্রভৃতি। পাশাপাশি প্রযোজনা করেন জুলেখা, দুইভাই, সংসার, সুয়োরাণী-দুয়োরাণী, কুচবরণ কন্যা, মনের মতো বউ, শেষপর্যন্ত প্রতিশোধ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে।

প্রায় সমাপ্ত করেছিলেন বহুভাষিক আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী চলচ্চিত্র “লেট দেয়ার বি লাইট”। উদ্যোগ নিয়েছিলেন ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রিক চলচ্চিত্র একুশে ফেব্রুয়ারি নির্মাণের। চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে সাহিত্য জগতে তাঁর আবির্ভাব ঘটে। সূর্য সংগ্রাম, তৃষ্ণা, বরফ গলা নদী, হাজার বছর ধরে, আরেক ফাল্গুন, কতগুলো মৃত্যু প্রভৃতি তাঁর সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্ম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি সচেতনভাবে চলে যান ভারতে। যুদ্ধে তুলে নেন তাঁর প্রিয় অস্ত্র ক্যামেরা। দেশমাতৃকার সেবায় আত্মনিয়োগ করেন চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার তথা আওয়ামী লীগের বিরাগভাজন হন। তাঁর কালজয়ী সৃষ্টিকর্ম স্টপ জেনোসাইড এর নির্মাণ ব্যাহত করার চেষ্টা করা হয়। অনেক সেক্টরে স্যুটিং এর জন্য প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও ইচ্ছায় প্রামাণ্যচিত্রটি সমাপ্ত হলেও সেন্সর বোর্ডে আটকে দেবার চেষ্টা করা হয়। এমনকি আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতা এজন্য অনশন ধর্মঘট পর্যন্ত করেছিলেন। সব বাধাকে অতিক্রম করে জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড মুক্তিলাভ করে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে স্টপ জেনোসাইড- ই সবচেয়ে শৈল্পিক ও মানবীয় আবেগ সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র হিসাবে স্বীকৃত।

এছাড়াও তিনি এসময়ে নির্মাণ করেন এ স্টেট ইজ বর্ন প্রামাণ্য চিত্রটি। মুজিবনগর সরকারের আদর্শ উদ্দেশ্যের সাথে বাংলাদেশের সংগ্রামের ধারাবাহিকতা সংযুক্ত করে নির্মিত চলচ্চিত্রটি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের রোষানলে পড়েছিল। এসময় তিনি প্রযোজনা করেন আরো দুটি প্রামাণ্যচিত্র- লিবারেসন ফাইটার্স ও ইনোসেন্ট মিলিয়ন্স।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের মাটিতে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন বিলাস বহুল হোটেলে আমোদ-ফূর্তিময় জীবন যাপন, রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষ আওয়ামী আদর্শে বিশ্বাসহীন বাঙালিদের নির্মূল করার ষড়যন্ত্র- প্রভৃতির প্রামাণ্য দলিল জহির রায়হান সংগ্রহ করতে থাকেন। দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত অধিকার হতে বঞ্চিত হওয়া, যুদ্ধের কৃতিত্ব পুরোটই ভারতের অধিকারে চলে যাওয়া, ভারতীয় বাহিনীর স্বেচ্ছাচারিতা, এবং বেশ কয়েকদিন ভারতীয় বাহিনীর শাসন চলা প্রভৃতি ঘটনাবলী জহির রায়হানকে বেশ ক্ষুব্ধ করে তোলে। তাছাড়া আদর্শস্থানীয় বড়ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার দেশ স্বাধীন হবার ঠিক পূর্বে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা তাকে বিচলিত করে তোলে। এসব ঘটনা তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেয়।

তিনি নিয়মিত নামাজ রোযা পালন করা শুরু করেন। পীর আউলিয়ারর মাজারে যাতায়াত করতে থাকেন। এমনকি আজমির শরীফ পর্যন্ত গমন করেন। পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের উপর বেসরকারি তদন্ত কমিটি গঠন করে নানারকম প্রমাণ সংগ্রহ করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন বাংলাদেশের সর্বময় ক্ষমতায় আসীন। এমন সময় ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি ঘোষণা করেন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পেছনের নীল নকশা উদঘাটনসহ মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক ঘটনার নথিপত্র ও প্রামাণ্যদলিল তাঁর কাছে আছে, যা প্রকাশ করলে সদ্য স্বাধীন দেশের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই নেয়া অনেক নেতৃবৃন্দের কুকীর্তি ফাঁস হয়ে পড়বে।

এই ঘটনার কয়েকদিন পরে ৩০ জানুয়ারি এক অজ্ঞাত টেলিফোন আসে জহির রায়হানের কায়েতটুলির বাসায়। শহীদুল্লাহ কায়সার মিরপুরে এক বাড়িতে আটক অবস্থায় আছেন- এই খবর পেয়ে জহির রায়হান- জাকারিয়া হাবিব, চাচাত ভাই শাহরিয়ার কবিরসহ কয়েকজনের সাথে, তখনও অবরুদ্ধ, মিরপুরে যান। মিরপুর ২ নং সেকশনে অবস্থিত মিরপুর থানায় পৌঁছনোর পর ভারতীয় ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসাররা গাড়ীসহ জহির রায়হানকে একা রেখে অন্য সঙ্গী সাথীদের চলে যেতে বলেন। সেই থেকেই জহির রায়হান নিখোঁজ হয়ে যান। তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। একই সাথে হারিয়ে যায় জহির রায়হানের ডায়েরি, নোটবুক,মূল্যবান ফিল্মসহ দলিলপত্র। জহির রায়হানের খোঁজ খবর বেশি না করার জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাঁর পরিবারবর্গকে হুমকি দেয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় নামকাওয়াস্তে তদন্ত কমিটি। সেই থেকে জহির রায়হান নিখোঁজ রয়েছেন আজও...।

মাউন্টেনার, ফটোগ্রাফার ও চলচ্চিত্রকর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :