ভালোমন্দের বইমেলা
একুশের বইমেলা নিয়ে আমাদের উৎসাহ আর প্রত্যাশার শেষ নেই। সৃজনশীল বই প্রকাশের এটা যেন একটা মৌসুম। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ- দেশের বেশির ভাগ বই প্রকাশিত হয় এই মেলাকে সামনে রেখেই। সে হিসেবে লেখক, প্রকাশক আর পাঠকরা সারা বছরের অপেক্ষায় থাকেন এই বইমেলার জন্যই।
কিন্তু বাস্তবে এই মেলা কতটুকু লেখকের, কতটুকু পাঠকদের জন্য? নাকি সবটুকুই কেবল প্রকাশকদের জন্য? পাঠকরা কি সহজেই তাদের প্রত্যাশিত বইটি খুঁজে পান মেলায় গিয়ে? নাকি হাজারো আবর্জনার মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় বইটি খুঁজে পেতে গলদঘর্ম হতে হয়? আবার লেখকরা কি পায় তাদের মেধাশ্রমের যথাযথ মূল্য?
বেশ কয়েক বছর আগে আমার একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। আমি তখন দৈনিক জনকণ্ঠের রিপোর্টার। রিপোর্টিং করি, আর অবসরে স্পোর্টস নিয়ে লেখালেখি করি। জনকণ্ঠের ক্রীড়াবিষয়ক সাপ্তাহিক ফিচার পাতায় আমি রেসলিং নিয়ে লিখতাম। ওই লেখাগুলো তখন এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে, অনেকে আমাকে রিপোর্টারের চেয়ে রেসলিংয়ের লেখক হিসেবে বেশি চিনতো। লেখাগুলোর পাঠকপ্রিয়তার আরও একটি প্রমাণ পেলাম যখন দেখলাম আলমগীর ভাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। উনি প্রতীক ও অবসর নামে দুটি প্রকাশনীর মালিক। বললেন, প্রকাশিত ফিচারগুলো দিন, একটা বই বের করে ফেলি। বই হয়ে গেল।
বইয়ের কাজে সহযোগিতা করতে বেশ কয়েকবার পুরান ঢাকায় তার প্রেসে গেলাম, প্রুফ দেখায় সাহায্য করলাম। মেলার একেবারে প্রথম দিন থেকেই বই বাজারে এলো। সাবজেক্ট হিসেবে সেটি তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই ছিল না। কিন্তু তরুণদের অনেকেই বইটি কিনলো। প্রকাশনা সংস্থার একজনের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় ছিল, তিনি জানালেন বইটি নাকি বেশ ভালোই যাচ্ছে। দিন পনের পরে ১৫-২০ কপি বই আমাকে দেওয়া হলো সৌজন্য হিসেবে। প্রকাশনার কিছুই তখন আমি জানি না, তাই একদিন জানতে চাইলামÑ লেখক হিসেবে আর কিছুই কি আমি পাবো না? আলমগীর ভাই বললেন, মেলা শেষ হোক, তারপর হিসাব করে আপনার রয়্যালটি দেওয়া হবে। মেলা শেষ হলো, রয়্যালটি বলে কিছু আর পেলাম না। দু-একবার ফোন করেছিলাম। কখনোই বলেনি যে দেবে না, কিন্তু একটি পয়সাও দেয়নি।
এটা সম্ভবত ২০০১ সালের কথা। এরপর পুরো দেড় দশকেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। পরিস্থিতির কিছুমাত্র উন্নতি হয়নি, বরং খারাপ হয়েছে বহুগুণ। রয়্যালটি বলে কোনো শব্দ যে প্রকাশনা শিল্পে আছে, সেটাই যেন সবাই ভুলতে বসেছে। প্রতি বছর বইমেলায় হাজার হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয়, কত টাকার বই বিক্রি হয় তার হিসাব আর চুলচেরা বিশ্লেষণ পাওয়া যায় না।
লেখকরা কত টাকার রয়্যালটি পেলেন- এ প্রশ্ন কেউ করলে প্রকাশকরা তাকে মারধরও করতে পারেন। কিন্তু প্রতিটি বইয়ের সঙ্গে তো একজন লেখকের মেধাশ্রম জড়িত আছে। সেই শ্রমের কি তাহলে কোনো মূল্যই থাকবে না? লেখকের শ্রমের মূল্য দূরে থাক, এখন বরং শোনা যায় উল্টো কথা। বই ছাপতে গেলে উল্টো লেখককেই অর্থের জোগান দিতে হয়। কোনো কোনো প্রকাশক দাবি করেন, লেখক যেন একশ- দেড়শ বই নিজে কিনে নেন! কেউ কেউ লেখককে বলেন, বইয়ের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে।
তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? আপনি কষ্ট করে লিখবেন, মেধা খাটাবেন, শ্রম দেবেন, সময় দেবেন। পান্ডুলিপির পাশাপাশি অর্থ দেবেন। সব ঠিকঠাক মতো অগ্রসর হচ্ছে কি না, বানান কোনো ভুল হচ্ছে কি না, সে সব দেখতে শ্রম দেবেন। বই প্রকাশের পর বিক্রি বাড়াতে বিজ্ঞাপন দেবেন। নিজে শতাধিক বই কিনবেন। আর আমি প্রকাশক বইটি প্রকাশ করবো। আপনার বই দিয়ে প্রকাশনার সংখ্যা বাড়াবো।
এমন একটা ভাব দেখাবো যে, আপনার মতো এলেবেলে লোকের বই প্রকাশ করতে গিয়ে আমি ফতুর হয়ে যাচ্ছি, তারপরও কেবল দেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রকাশনা শিল্পে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছি। নতুন নতুন লেখককে উৎসাহ যোগাচ্ছি। এই যে আমি এত ত্যাগ করছি, কোথায় আপনাদের দায়িত্ব আমাকে নিত্যদিন প্রশংসা করা, তা নয় কেবলই বলছেন রয়্যালটির কথা!
এবার বইমেলার একেবারে শুরুর দিকে, একাত্তর টেলিভিশনে একটা টক শোতে গিয়েছিলাম। সেখানে একজন প্রকাশকও ছিলেন। আলোচনার এক পর্যায়ে আমি বললাম, আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ লেখকই কোনো রয়্যালটি পান না। প্রকাশক ভদ্রলোক (সম্ভবত ওনার নাম ফরিদ আহমেদ) বেশ জোরের সঙ্গেই বললেন আমার দেওয়া তথ্য সত্য নয়। লেখকরা যদি রয়্যালটি নাই পেতেন, তাহলে প্রতিবছর এত এত বই প্রকাশিত হতো না।
আসলে প্রতি বছর এত এত বই কিভাবে প্রকাশিত হয়, কাদের লেখা বই প্রকাশিত হয়, সে আলোচনায় যাওয়ার আগে বরং রয়্যালটি বা লেখক সম্মানী নিয়ে আর দু-একটা ঘটনা বলি। আমি একজন অধ্যাপক ভদ্রলোককে চিনতাম। খুবই বিখ্যাত লোক। খুবই নামকরা কবি, গীতিকার। তার গদ্যও চমৎকার, আমার খুবই প্রিয়। এ পর্যন্ত ওনার অর্ধশতাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। অনেক কয়টি বইয়ের একাধিক সংস্করণও হয়েছে। একবার একান্ত এক আলোচনায় ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই যে এত বই আপনার, রয়্যালটি কেমন পান? উনি হাত নেড়ে বললেন, আর ধুর রয়্যালটি কোথায়। ওরা কোনো টাকাই দেয় না। বই প্রকাশের পর কয়েক কপি বই দেয়, আর কিছু না! এবার রানা ভাইয়ের কথা বলি। ওনার আসল নামটা বললে সবাই চিনবেন- ফেরদৌস হাসান। উনি আমাদের মতো এলেবেলে কোনো লোক নন। লেখালেখির জগতে অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত। কয়েকশ নাটক ওনার প্রচার হয়েছে বিভিন্ন টেলিভিশনে। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন থেকেই ওনার নাটক দেখেছি। গত বইমেলায় রানা ভাইয়ের একটা উপন্যাস প্রকাশিত হয় অন্যপ্রকাশ থেকে। ‘মায়া’ নামের সেই উপন্যাসটি অবলম্বনে এনটিভিতে ধারাবাহিক নাটকও প্রচারিত হচ্ছে এখন। উপন্যাসটি বেশ চলেছে। আমি নিজেও কিনেছি।
এই ফেব্রুয়ারির শুরুতে রানা ভাইয়ের সঙ্গে কথা। জানতে চাইলাম, এবার নতুন কোনো বই প্রকাশ হচ্ছে কি না। উনি খুব দুঃখ করলেন। বললেন, অনেক কথা। প্রকাশকরা সব খারাপ, বাটপার। এত কষ্ট করে লিখবো, কিন্তু কোনো টাকা পাবো না, তাহলে কেন লিখবো? বই প্রকাশের দরকার নেই, তার চেয়ে টিভির জন্য নাটক লিখবো। জানালেন, গতবার মায়া উপন্যাসটি তিনি নিজেই কিনেছেন তিনশ কপি। বিভিন্ন জনকে উপহার হিসাবে দিয়েছেন। এছাড়া তার পরিচিত অনেকেই বইটি কিনে এনে তার অটোগ্রাফ নিয়েছেন। অথচ পরে যখন হিসাব নিতে গেলেন প্রকাশনা সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হলো তার বই নাকি মাত্র ২৫২ কপি বিক্রি হয়েছে! তাই ঠিক করেছেন, আর লিখবেনই না, বই প্রকাশ দরকার নেই।
সম্মানী না পেলে প্রকৃত লেখকদের এ ধরনের অভিমান তো হতেই পারে। অভিমান থেকে, হতাশা থেকে লেখকরা হাত গুটিয়ে নেবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। তাহলে আবার সেই ফরিদ আহমেদের কথায় ফিরে যেতে হয়, এত লেখক প্রতি বছর আসে কোথা থেকে? আসলে এটি কিন্তু মোটেই কোনো কঠিন প্রশ্ন নয়। এই যে এত লেখক, এরা আসলে কোনো লেখকই নয়। সব নতুন লেখককেই আমি অবহেলা করছি না, কারণ এটা তো জানি- সব বড় লেখকই একদিন নতুন লেখক ছিলেন। তবে পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করে জানি যে, নতুন লেখকের যে জোয়ার এখন বইছে, এদের সিংহভাগই কোনোদিন মাঝারি মানের লেখকও হতে পারবে না। তারপরও এদের বইয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। সেদিন প্রখ্যাত লেখক মইনুল আহসান সাবের ভাইয়ের একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়লাম। তিনি লিখেছেন :
‘মেলা থেকে ফেরার পথে পেশায় চিকিৎসক মহিলার সঙ্গে দেখা, সাবের ভাই, চিনতে পারছেন?
: হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়। কেমন আছেন? এবার বই বেরুল?
: চারটা। চারটাই কবিতার।
: এক বছরে চারটা কবিতার বই!
: জি। আমি আসলে খুব তাড়াতাড়ি লিখতে পারি। আমার ভাবও তাড়াতাড়ি আসে। আবার আমার কোনো অভাব নেই।’
এই চিকিৎসক কাম কবি মহিলার একটি কথা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘আমার কোনো অভাব নেই।’ কাজী নজরুল ইসলামের মতো অনেকে ছিলেন, অভাবই যাদেরকে কবি বানিয়েছে। অভাব, দারিদ্র্য, ক্রাইসিস- এসব অনেকের মধ্যে ভাবের জন্ম দেয়, তারা লেখক বা কবি হয়ে ওঠেন। তবে এসব আগে হতো, এখন সম্ভবত হয় না। এখন কেবল প্রতিভা থাকলেই হয় না, সেই সঙ্গে অর্থও থাকতে হয়। অর্থ থাকলে দ্রুতই গ্রন্থ প্রকাশ করা সম্ভব হয়। প্রকাশকরা আগ্রহী হয়ে ওঠেন। দামি কাগজে, উন্নত মুদ্রণে, ঝকঝকে বই প্রকাশিত হয়।প্রকাশনা শিল্পে লেখকের বিনিয়োগের এই প্রবণতার সবচেয়ে উৎকট পরিণতি হচ্ছে জোয়ারের পানির মতো প্রবাসী কবি-লেখকদের গ্রন্থ প্রকাশ। আগে যখন পত্রিকায় কাজ করতাম, শুনতাম সাহিত্যিক নাকি দু ধরনের হয়। সাধারণ সাহিত্যিক এবং কাস্টমস সাহিত্যিক। বিষয়টা বুঝতে আমার বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। পরে একজন নবীন কবি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি ছয়-সাতজনের নাম উল্লেখ করে বললেন- আচ্ছা, বলুন তো এরা কোন মানের সাহিত্যিক। বললাম- মোটামুটি। মাঝারির চেয়ে একটু নিম্নমানের। এরপর তিনি বললেন, অথচ দেখবেন এরা অফিসে এলে আপনাদের সাহিত্য সম্পাদক কেমন ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন। দেখবেন প্রতি সপ্তাহেই এদের কারও না কারও লেখা ছাপা হচ্ছে। বিষয়টা আর কিছুই নয়, কাস্টমসে চাকরি করার কারণে এদের পক্ষে এমন কিছু উপঢৌকন দেওয়া সম্ভব, যা সাধারণ সাহিত্যিকদের পক্ষে সম্ভব নয়।
কথাগুলো শুনতে ভালো লাগেনি। তবে এরপর বিষয়টা আমি গভীর মনোযোগের সঙ্গেই লক্ষ্য করেছি। খেয়াল করেছি, সত্যতা মিলেছে এবং হতাশ হয়েছি। সেই হতাশা নতুন এক মাত্রা নিয়ে দেখা দিয়েছে এখন প্রকাশনা শিল্পে। আগে পত্রিকার সাহিত্য পাতায় দেখেছি কাস্টমস সাহিত্যিকদের দাপট, আর এখন বইমেলায় দেখছি প্রবাসী সাহিত্যিকদের প্রতাপ। ভাবখানা এমন যেন, দেশের বাইরে গেলে, হাতে দুটো পয়সা এলেই সবাই সাহিত্যিক হয়ে ওঠেন।
তবে প্রবাসীদের এই সাহিত্যিক হয়ে ওঠার পিছনে প্রকাশকদের ভূমিকাও কিন্তু কম নয়। শুনেছি, বছরের মাঝামাঝি সময়েই অনেক প্রকাশকই নাকি সাহিত্যিক খুঁজে বের করতে বিদেশে অভিযান চালান। তিন-চারজন মালদার আদম পেলে আর কোনো সমস্যা হয় না। তাদেরকে তো সাহিত্যিক বানিয়ে দেনই, এমনকি তাদের স্ত্রীদের কাব্য প্রতিভাকেও তারা মাটি খুঁড়ে বের করে নিয়ে আসেন।
কেউ কেউ হয়ত বলবেন, কে সাহিত্যিক হলো আর কে হতে পারলো না, তা নিয়ে আমার এত মাথাব্যথা কেন? আসলে মাথাব্যথা না হলে ভালো হতো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের পরবর্তী জেনারেশন নিয়ে। এরা ইন্টারনেট যুগের প্রজন্ম, বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে এদের পরিচয় হয়ে যায় সহজেই। দুনিয়ার বইপত্র ঘেটে বেড়ায় নিজ দায়িত্বে, নিজ উদ্যোগে। এরা আবার বাঙালিও থাকতে চায়। বৈশাখী মেলা, বইমেলাকে নিজের ঐতিহ্যের অংশ মনে করে। ভাবতে চায়Ñ আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বড় বেশি সমৃদ্ধ। বড় উৎসাহ নিয়ে মেলায় যায়। তারপর একটি গ্রন্থের কয়েক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে যখন হতাশা প্রকাশ করে, তখন তাদেরকে বোঝাতে কষ্ট হয় যে, এটাই আমাদের সাহিত্যের মূল ধারা নয়। এটা সম্পূর্ণই পরগাছা সাহিত্য। এই আগাছা পরগাছাকে বেড়ে ওঠতে দিচ্ছে প্রকাশক নামের মুনাফালোভী দায়িত্বহীন ব্যক্তিরা। এ দুরবস্থা থেকে কবে মুক্তি মিলবে কে জানে।
মাসুদ কামাল : লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
মন্তব্য করুন