পলাশে ৪৫ টার্কি খামার
নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় টার্কি ব্যবসায়ী রউফ, জাবেদ, বিষ্ণুসহ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে- টার্কি পালনে সফল পলাশের খামারিরা। টার্কি এক সময়ের বন্য পাখি হলেও এখন একটি গৃহ পালিত বড় আকারের পাখি। এটি গৃহে পালন শুরু হয় উত্তর আমেরিকায়। কিন্তু বর্তমানে ইউরোপসহ পৃথিবীর সবদেশে টার্কি পালন করা হয় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খাদ্য তালিকায় অন্যতম উপাদান।
টার্কি পালনের সুবিধা হলো- এটা ঝামেলাহীনভাবে দেশি মুরগির মত পালন করা যায়। টার্কির মাংস উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাপক। টার্কি ব্রয়লার মুরগি থেকেও দ্রুত বাড়ে।
টার্কি পালনে তুলনামূলক খরচ কম। কারণ এরা দানাদার খাদ্যের পাশাপাশি ঘাস, লতাপাতা খেতেও পছন্দ করে।
টার্কির ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে ওঠার ছয় মাসের মধ্যে টার্কি ডিম দেয়। ছয় মাসের মেয়ে টার্কির ওজন হয় পাঁচ থেকে ছয় কেজি। আর পুরুষগুলো প্রায় আট কেজি।
আমেরিকায় টার্কির রোস্ট অভিজাত খাবার। আমাদের দেশে মুরগির মাংসের মতো করেই টার্কি রান্না করা হয়। রোস্ট ও কাবাব করা যায়।
আবদুল রউফ মিয়া জানান, পলাশে বাণিজ্যিকভাবে এত বড় পরিসরে আর কোনো টার্কির খামার নেই। এই খামার থেকে পাইকারি ক্রেতারা কিনে নিয়ে দোকানে দোকানে বিক্রি করেন। সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকায় এখনো দাম একটু বেশি। সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে টার্কি খাওয়ার প্রচার শুরু হয়নি।
পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল পৌরসভার বালুচর পাড়ার কয়েকজন টার্কি মুরগি ক্রেতা বলেন, আবদুল রউফ মিয়া এলাকার মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
তারা বলেন, তার কাছ থেকে বাচ্চা নিয়ে অনেক শৌখিন খামারি ছোট আকারে টার্কি পালন শুরু করেছেন। মাংস খেতে সুস্বাদু।
টার্কির একজন পাইকারি ক্রেতা সাঈদ বলেন, পলাশের আবদুল রউফের খামার সবচেয়ে বড়। তার কাছ থেকে সাশ্রয়ী দামে কেনা যায়। এই টার্কি তিনি ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করেন। খাসির মাংসের মতো স্বাদ।
আবদুল রউফ এইচএসসি পাস করে এক সময় সিঙ্গাপুরে চাকরি করতেন। ২০১৩ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। গ্রামে এসে তিনি ৩৩ শতাংশ জমি কিনে বর্তমান খামারটি শুরু করেন। বিদেশ থাকার সময় টার্কির মাংসসহ কাবাব, রোস্ট খেয়েছেন, তখনই ভাব ছিলেন- আমাদের দেশে কীভাবে এ খামার করা যায়? সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়। টার্কিতে রয়েছে, রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা। টার্কির মাংসে অধিক পরিমাণ জিংক, লৌহ, পটাশিয়াম, বি৬ ও ফসফরাস থাকে। এ উপাদানগুলো মানব শরীরের জন্য ভীষণ উপকারী এবং টার্কির মাংসে এমাইনো এসিড ও ট্রিপটোফেন অধিক পরিমাণে থাকায় এর মাংস খেলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
টার্কির মাংসে ভিটামিনও অধিক পরিমাণে থাকে। চর্বি কম, প্রচুর পরিমাণে কেলোরি আছে। যারা গরুর মাংস খেতে পারেন না, তাদের জন্য টার্কির মাংস উপকারী। ডায়েবেটিস রোগীদের জন্য সহায়ক। সকল পশুর মাংস থেকে দামে কম এবং স্বাদ বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের আবহাওয়ায় টার্কি বাঁচে কিনা, তার ধারণা ছিল না। খোঁজ নিতে থাকেন।
পরে জানতে পারেন পাশের দেশ ভারতেই বাণিজ্যিকভাবে টার্কির চাষ হয়ে থাকে। যার প্রতি জোড়ার দাম পড়ে ৫ হাজার ৫০০ টাকা। তিনি ৮টি টার্কি সংগ্রহ করেন। এই ৮টি টার্কির মধ্যে মোরগ ৪টি এবং মুরগি ৪টি। তিনি টার্কি পালনের পদ্ধতি সম্পর্কে খোঁজ নেন। সেভাবেই কাজ শুরু করলেন।
রউফ দেখলেন, টার্কির খাবার নিয়ে মুরগির চেয়ে দুর্ভাবনা কম। এরা ঠান্ডা-গরম সব সহ্য করতে পারে। দানাদার খাবারের চেয়ে কলমির শাক, বাঁধাকপি, ঘাস বেশি পছন্দ করে। এগুলো জোগাড় করা সহজ। টার্কিগুলো শুরু থেকেই ডিম দিতে থাকে। ডিম ফোটানোর জন্য রউফ ৪০টি দেশি মুরগি জোগাড় করলেন। পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি টার্কি এই মুরগির মধ্যে ছেড়ে দিলেন। পাশাপাশি তিনি তিথী পাখিও পুষতে শুরু করেছিলেন। তিথীর ও টার্কি পালন নিয়ে একটা আস্থা তৈরি হলো তার।
গত কয়েক বছরে তিনি ৮টি টার্কি থেকে প্রায় ৫০০ টার্কি বিক্রি করেছেন। বর্তমানে খামারে রয়েছে প্রায় শতাধিকের উপরে টার্কি। এখন ডিম দেয়ার উপযোগী প্রতি জোড়া টার্কি বিক্রি করছেন আট হাজার টাকায়।
রউফ বলেন, প্রথমে তিনি ডিম ফোটানো নিয়ে একটু বিপাকে পড়েন। যন্ত্রের সাহায্যে ২৭ দিনে টার্কির ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। আর তিথীর ২৪ দিন লাগে।
রউফ আরো বলেন, যারা অল্প পুঁজি এবং ঝুঁকি নেই এমন ব্যবসা খুঁজছেন টার্কির খামার তাদের জন্য আয়ের উৎস হতে পারে। কারণ একটি টার্কির খামার করতে বেশি পুঁজির প্রয়োজন হয় না। অন্যান্য পাখির তুলনায় এর রোগ বালাই কম এবং কিছু নিয়ম মেনে চললে খামারে ঝুঁকি অনেক কমে যাবে।
খামারের খরচ কম। এক মাসে ১শ টার্কির পেছনে ৩০ হাজার টাকা খরচ হবে এবং বিক্রি করা যায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। টার্কি মুরগি পালনকারীরা শুধু সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন একটি টার্কি মুরগির জন্য ৪-৫ বর্গ ফুট জায়গা নিশ্চিত করতে হবে। ঘরে পর্যাপ্ত আলো ও বাতাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, একটি মোরগের সঙ্গে ৩ বা ৪টি মুরগি রাখা যেতে পারে। ডিম প্রদানকালীন সময়ে টার্কিকে আদর্শ খাবার এবং বেশি পানি দিতে হবে।
সরেজমিনে রউফের খামারে দেখা গেছে, সাত রঙের টার্কি আছে- কালো, সাদা কালো, সিলভার লাইট, প্রেস সাদা, রয়েল, টাইগার, স্প্রাইট। আবদুল রউফের মতো এত রঙের টার্কি পলাশে আর কোথাও নেই। তিথী পাখি রেখেছেন মানুষকে আকর্ষণের জন্য।
পলাশ উপজেলার পশু হাসপাতালের কর্মকর্তা সাজহান খান বলেন, টার্কির উপর আমরা সব সময় নজর রাখছি। খামারিদের নিয়ে এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌর মেয়রসহ ট্রেনিং সেমিনার করেছি। কর্মসংস্থার জন্য ব্যবসায়িকভাবে সফল এবং লাভজনক ব্যবসা।
বর্তমানে সারাদেশের মধ্যে পলাশে টার্কির খামার বেশি। পলাশে প্রায ছোট, বড়, মাঝারি ধরনের ৪৫টি খামার আছে।
(ঢাকাটাইমস/৫মার্চ/প্রতিনিধি/এলএ)
মন্তব্য করুন