নড়াইলের সড়ক-মহাসড়কগুলো যেন উঠোনবাড়ি

ফরহাদ খান, নড়াইল
| আপডেট : ২৫ মার্চ ২০১৭, ১৬:১০ | প্রকাশিত : ২৫ মার্চ ২০১৭, ০৯:৪৫

মুশুরিসহ ডাল জাতীয় ফসলের দখলে নড়াইলের সড়ক-মহাসড়ক ও গ্রামীণ রাস্তাগুলো। সড়ক ও জনপথের ১৭০ কিলোমিটার এবং এলজিইডির দুই হাজার ২৯৫ কিলোমিটার পাকা ও কাঁচা সড়কের বেশির ভাগে বিভিন্ন মৌসুমি ফসল শুকানো হচ্ছে। প্রায় ছয় মাস ধরে এসব সড়কে ফসল শুকানো এবং মাড়াইসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখা হয়। এতে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে। চাকাসহ যন্ত্রাংশে ফসল জড়িয়ে নষ্ট হচ্ছে ছোট যানবাহনগুলো।

এদিকে, ২০১৫ সালের ৯ এপ্রিল দুপুরে লোহাগড়া উপজেলার জয়পুর এলাকায় সড়কে গম শুকানোর সময় মোটরসাইকেল পেছলে পড়ে দুর্ঘটনায় এক আরোহী নিহত হন। এ ঘটনায় অপর আরোহী আহত হন। এছাড়া সড়কে ফসল শুকানোসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে দুর্ঘটনায় গত তিন বছরে শতাধিক যাত্রী ও পথচারী আহত এবং অন্তত পাঁচজন পঙ্গুত্ববরণ করেছেন বলে জানিয়েছেন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) নড়াইল জেলা শাখার সভাপতি সৈয়দ খায়রুল আলম।

বিভিন্ন যানবাহনের চালক, যাত্রী ও পথচারীরা জানান, চাকায় এবং বিভিন্ন যন্ত্রাংশে ফসল জড়িয়ে যানবাহনগুলোর যেমন ধীরগতি হচ্ছে, তেমনি দুর্ঘটনাও ঘটছে। বিশেষ করে বাইসাইকেল, ভ্যান, মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ও অটোরিকশা চলাচলের ক্ষেত্রে বেশি সমস্যা হচ্ছে। পাশাপাশি সময়ের অপচয় হচ্ছে।

তারা আরো জানান, সড়কে ফসল শুকানোর প্রতিবাদ করলে স্থানীয় কৃষকরা তাদের লাঞ্ছিত করেন। এমনকি মারধরের শিকার হতে হয়।

নড়াইল-কালিয়া সড়কের অটোরিকশাচালক নাসির বলেন, সড়কগুলোতে অনেক উঁচু করে কলাইসহ বিভিন্ন ফসল মাড়াই করা হচ্ছে। এতে গাড়ির চাকা ও মোটরসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশে ফসল জড়িয়ে চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বেশির ভাগ যানবাহনের ক্ষতি হচ্ছে।

বাসচালক জমির আহম্মদ বলেন, জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কেও ফসল শুকানো হচ্ছে। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়েই পথ চলতে হয়। পাশ (সাইড) কাটতে গেলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরো বেড়ে যাচ্ছে।

ট্রাকচালক ফসিয়ার জানান, সড়কে কলাই বা গম জাতীয় ফসল রাখার কারণে যানবাহনের চাকা এলোমেলোভাবে চলতে থাকে, ঠিকমত নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। দুই বা তিন চাকার যানবাহনের ক্ষেত্রে আরো বেশি সমস্যা হয়।

নড়াইল-কালিয়া সড়কের দিঘলিয়া এলাকার আক্কাস মোল্যা বলেন, সড়ক-মহাসড়কসহ সব ধরনের রাস্তায় ফসল শুকানো এবং মাড়াই বন্ধে সরকারি হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

একই গ্রামের নয়ন মোল্যা জানান, সড়কগুলোতে ফসল শুকানোর কারণে মোটরসাইকেল চালাতে বেশি সমস্যা হচ্ছে। হঠাৎ গতি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হলে ফসলের ওপর চাকা দাঁড়াতে পারে না। এতে মোটরসাইকেল পিছলে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে।

বগুড়ার মোস্তফা কামাল বলেন, প্রায় ছয়মাস যাবত সড়কের ওপর বিভিন্ন ফসল শুকানো এবং মাড়াই করা হয়। বর্তমানে সড়ক-মহাসড়কসহ গ্রামীণ রাস্তাগুলো ফসলের দখলে বলা যায়। আইন প্রয়োগ করে রাস্তায় ফসল শুকানো একেবারে বন্ধ করা উচিত।

বাসসহ অন্য যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীরা জানান, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত যাতায়াত করতে হয়। সড়কে ফসল মাড়াইয়ের কারণে গাড়ির চাকা যেমন এলোমেলো চলছে, তেমনি প্রচণ্ড ধূলো ও ময়লা-অাবর্জনায় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

লোহাগড়া উপজেলার আমাদা আদর্শ কলেজের প্রভাষক মঞ্জুয়ারা পারভীন বলেন, বর্তমানে সড়কগুলোতে চলাচল করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ফসল শুকানো, মাড়াই, অবশিষ্ট অংশ ফেলা, বস্তায় প্রক্রিয়াজাতকরণসহ সবকিছুই সড়কের ওপর করা হচ্ছে। এমনকি ফসলের অবশিষ্ট অংশ সড়কের ওপর এবং পাশে ফেলে রাখায় হেঁটে চলাচলও দায় হয়ে পড়েছে। হঠাৎ বৃষ্টি হলে ফসলের অবশিষ্ট অংশ পচে সড়কগুলো আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়।

এদিকে সদর উপজেলার সারকেলডাঙ্গার কোহিনুর বেগম জানান, পাকা রাস্তায় ফসল শুকাতে সুবিধা হয়। তাই বাড়ির উঠানে না শুকিয়ে সড়কে ফসল মাড়াই করেন।

দিঘলিয়ার জিয়া-পলিনা দম্পতি দাবি করে বলেন, রাস্তায় ফসল শুকানোর ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় না। গাড়ির চাকার চাপে ফসল দ্রুত মাড়াই হয়ে যায়। এ সুবিধার জন্য সড়কে ফসল শুকিয়ে থাকেন তারা।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) নড়াইল জেলা শাখার সভাপতি সৈয়দ খায়রুল আলম বলেন, বিভিন্ন মৌসুমে স্থানীয় কৃষকেরা সড়ক, মহাসড়ক ও গ্রামীণ সড়কগুলো ফসল মাড়াইয়ের কাজে ব্যবহার করেন। ডাল, গম, ধান, খড়, সরিষা, ধনে, তিল থেকে শুরু করে সব ধরনের ফসল শুকানো হয়। প্রায় ছয় মাস সড়কে ফসল শুকানোর কাজ চলে। এ অবস্থা দেখে মনে হয় না, এটি কোনো সড়ক বা মহাসড়ক! সড়কগুলো একেবারে উঠোনবাড়ির মতো করে ফেলেন স্থানীয় কৃষকেরা। জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি আইন প্রয়োগ করে সড়কে ফসল মাড়াই এখনই বন্ধ করা প্রয়োজন।

তিনি আরো জানান, সপ্তাহখানেকের মধ্যে ডাল জাতীয় ফসল ঘরে তোলা শেষ হবে। এরপর সড়কগুলোতে গম মাড়াই করবেন কৃষকেরা। সড়কের ওপর গম শুকানো যানবাহনের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কয়েক বছর ধরে সড়কগুলোতে ফসল মাড়াইয়ের এ দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। এ কারণে ২০১৫ সালের ৯ এপ্রিল লোহাগড়ার জয়পুর এলাকায় সড়কে গম শুকানোর সময় মোটরসাইকেল আরোহী লিটন সরদার পিছলে পড়ে যায়। এ সময় ট্রাকচাপায় প্রাণ হারান লিটন। এ ঘটনায় অপর আরোহী নির্মল পোদ্দার আহত হন।

ব্যবসায়ীরা জানান, সড়কে খেসারি, মুশুরি, ধান, গম, সরিষা, ধনে, তিলসহ অন্যান্য ফসল মাড়াইয়ের কারণে এসব ফসলের মধ্যে ছোট ছোট পিস, খোয়া, মাটি, বালিসহ বিভিন্ন ময়লা-অাবর্জনা মিশে যাচ্ছে। এতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি যেমন বাড়ছে, তেমনি ব্যবসায়িক ক্ষতি হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক হেলাল মাহমুদ শরীফ বলেন, ইদানিং দেখতে পাচ্ছি- জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়কগুলোর ওপর স্থানীয় কৃষকেরা কলাই (ডাল জাতীয়), জব ও গম শুকাতে দিচ্ছে। এতে কৃষকদের ফসল শুকানোর কাজ হলেও, আমাদের স্বাভাবিক যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনারও কারণ হয়ে থাকে। আমরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের নির্দেশনা দিয়েছি, যাতে সড়কে ফসল শুকানো থেকে কৃষকদের প্রতিহত করতে পারেন।

প্রসঙ্গত, নড়াইল-কালনা-যশোর, নড়াইল-মাগুরা, নড়াইল-তুলারামপুর-মাইজপাড়া, নড়াইল-মাইজপাড়া-গঙ্গারামপুর, লোহাগড়া-নহাটা-কালিশংকরপুর-মহম্মদপুর,লোহাগড়া-মহাজন-নড়াগাতি, নড়াইল-কালিয়া, নড়াইল-গোবরা-নওয়াপাড়া, নড়াইল-গোবরা-ফুলতলা, তেরখাদা-বড়নাল-কালিয়া সড়ক, এড়েন্দা-আমাদা-লুটিয়া, দিঘলিয়া-কুমড়ি-তালবাড়িয়া সড়কসহ প্রায় প্রতিটি সড়ক-মহাসড়কের ওপর বিভিন্ন মৌসুমি ফসল শুকানো এবং মাড়াই করা হচ্ছে। এছাড়া গ্রামীণ সড়কের পাশে গরু, ছাগলসহ গবাদি পশু বেঁধে রাখায় স্বাভাবিক যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে।

(ঢাকাটাইমস/২৫মার্চ/প্রতিনিধি/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :