জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আলেম বা ধর্মীয় নেতাদের সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল
সিলেটে জঙ্গি হামলা চলমান অবস্থায় সিলেটবাসীর মনে যে আতঙ্ক বিরাজ করছে সেই আতঙ্ক যদি প্রকৌশলী, ব্লগার রাজীব হায়দারের নির্মম বর্বরোচিত হত্যার পর দেশবাসীর মনকে কিছুটা হলেও স্পর্শ করতো তাহলে আমাদের অভিজিৎ রায়কে হারাতে হতো না, হারাতে হতো না অনন্ত বিজয় কিংবা নিলয় নীল-কে। জীবন বাঁচাতে লেখকদের দেশ ছাড়তে হতো না।
যদি রাজীব হায়দারের হত্যার পর দেশের পরিচিত ধর্মীয় নেতারা যেমনঃ বাইতুল মোকারমের খতিব, চরমোনাই পীর কিংবা হেফাজতের আমির প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতেন এই বলে যে- এভাবে মানুষ হত্যা করাকে ইসলাম সমর্থন করে না।
যদি সেইসব খুনিদের ধর্মদ্রোহী ঘোষণা করতেন, যদি জাতীয়ভাবে বর্জনের আহ্বান জানাতেন, যদি প্রচারণা চালাতেন আপনার ওয়াজে ব্যাবহৃত মাইক্রোফোন গুলোকে, তাহলে হলি আর্টিজানে হামলা করে বিদেশি সন্তানসম্ভবা নারীকে যন্ত্রণা হত্যা করে বেহেস্ত কনফার্মের মত উদ্ভট বর্বর চিন্তা এদেশের যুবকের মাথায় আসতো না।
কিন্তু আপনারা তা করলেন না, কেউ কেউ নাস্তিক হত্যাকে জায়েজ ঘোষণা করে ফতোয়া জারি করলেন। অনুসারীদের মতিঝিলে, চট্টগ্রাম, সিলেটে তাণ্ডব করার সুযোগ দিয়ে উগ্রদের আরও উগ্র করে তুললেন।
আপনারা কি ভাবেন আপনাদের ঘর নিরাপদ?
আপনারা কি দেখেন না উগ্র সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী আল-কায়দার বর্তমান আমির যে আই এস এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে আছে? (মিরর, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সংখ্যা দ্রষ্টব্য)। আপনারা কি জানেন না পাকিস্তানি উগ্রবাদী জিহাদি ছোটছোট গ্রুপ গুলো একে-অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে রেখেছে?
আপনারা কি ভাবেন এই উগ্রবাদিদের হাতে আপনারা নিরাপদ?
আপনাদের ইতিহাস কি এদের অজানা নয়? নারী নেতাকে মেনে নিয়ে যে ক্ষমতার মসনদের বসেছিলেন, ভেবেছেন সেটা এরা দেখে নাই? নারী নেতৃত্বের ওপর আস্থা রেখে বক্তব্য দিয়েছেন দিনের পর দিন, ভেবেছেন সেটা ওরা মেনে নেবে? রেলের জমি ভাগ বাটোয়ারার কথা বলেন, আর ফরহাদ মাজহারদের সাথে নিয়ে নাস্তিক নিধনের আন্দোলনের কথাই বলেন, যখন ভাগ-বাটোয়ারা পছন্দ হবে না তখন এসব ইস্যু তুলে আপনাদের কল্লাও পড়বে।
ধর্মের করাত খুব ভয়াবহ জিনিস। এই করাত আসতে কাটে যাইতেও কাটে। এটা নিয়ে যারা খেলা করে তারাও এই করাতের হাত থেকে নিরাপদ নয়। উগ্র মৌলবাদী পাকিস্তান সরকার কাদিয়ানি ইস্যু নিয়ে কিন্তু তাদেরই অনুগত জামাতের তাত্ত্বিক পুরোধা মওদুদীকে (জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা) হালাল হারামের ভাগ বাটোয়ারার বনিবনায় ফাঁসির মঞ্চ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলো (যদিও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় নাই), আবার পরে দেখা যায় মওদুদীর বিরোধিতা করে যেই হুজুরেরা তাকে ফাঁসির মঞ্চ পর্যন্ত তুলেছিলো তারাও অন্য মৌলবাদীদের কোপ থেকে মুক্তি পায় নাই।
দুই.
আমাদের ভাইরা যেদিন থেকে মরতে শুরু করেছে সেদিন থেকে জানি যে আমরা মরবো। আমরা মরবো জেনেই এসব বলতে বলতে আর ভয় লাগে না। বরং গোটা ব্যাপারটা দেখে এখন আমাদের হাসি পায়। উদ্ভটভাবে হাসতে হাসতে আমরা চেয়ার থেকে পড়ে যাই। কারণ আমরা এই দৃশ্যকল্পটা আগে থেকে দেখেছি, বলেছি। বারবার বারবার সাবধান করেছি। দিনের পর দিন সতর্ক করেছি। আপনারা আমলে নেন নাই।
অভিজিৎ রায়ের মগজ, বন্যা আহমেদের আঙুল, নীলয়ের রক্তে ভেসে যাওয়া ড্রইং রুম, অনন্ত বিজয়ের বিকৃত লাশ আমাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো দিনের পর দিন। আমরা আমাদের বুকের হাহাকারটুকু বুকে চাপা দিয়েই বারবার বারবার করে আবৃত্তি করেছি মার্টিন নাইমোলার কবিতা। বলছি-
যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিল,
আমি কোনো কথা বলিনি,
কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল,
আমি নীরব ছিলাম,
কারণ আমি শ্রমিক নই।তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে,
আমি তখনও চুপ করে ছিলাম,
কারণ আমি ইহুদি নই।আবারও আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে,
আমি টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,
কারণ আমি ক্যাথলিক নই।শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোন কথা বলল না,
কারণ, কথা বলার মত তখন আর কেউ বেঁচে ছিল না।তিন.
প্রিয় বন্ধুগণ। আজ ওরা আপনাদের ধরতে এসেছে। ওরা আমাদের বহু আগেই ধরে নিয়ে গেছে। আজ আমরা আর খুব বেশি অবশিষ্ট নেই। আমাদের লাইফ বোনাস লাইফ। আমাদের জীবন নিয়ে এখন আর খুব বেশি আশা আকাঙ্ক্ষা নেই। আমাদের দল থেকে আরেকজন হারিয়ে যাওয়া নিয়ে আপনাদের মত ততটুকু দুঃখবোধও সম্ভবত নাই। আমাদের ভাইদের লাশ মর্গে পচেছে, একজন মানুষ আসে নাই। ভয়ে আতঙ্কে। আমাদের পরিবার সমাজে একঘরা হয়েছে। আমাদের জীবন কি আর মরণ কি বলেন?
তবে আজ ওরা আপনাদের ধরতে এসেছে।
পালান। পালান।
নিজেকে বাঁচান।
পরিবারকে বাঁচান।স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির আগেই দেশটাকে পাকিস্তান বানাবেন না, তিরিশ লাখ শহীদের রক্ত আপনাদের ছেড়ে দেবে না...
লেখক: অনলাইন এক্টিভিস্ট