ভয়ংকর অপরাধী মিল্টন সমাদ্দার: প্রসঙ্গ অপরাধবিজ্ঞানের ভাষা

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
 | প্রকাশিত : ০৪ মে ২০২৪, ১০:১২

সম্প্রতি মানবতার ফেরিওয়ালা খ্যাত (!) ভাইরাল ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ আশ্রম-এর প্রতিষ্ঠাতা মানবিক পুরুষ (!) মিল্টন সমাদ্দারকে পুলিশ প্রতারণাসহ কয়েকটি গুরুতর অপরাধে আটক করেছে। পুলিশ শুধু আটক করেই ক্ষান্ত হয়নি তাকে ভয়ংকর অপরাধী হিসেবেও সাব্যস্ত করেছে। ডিবি পুলিশের প্রধান সাংবাদিকদের সাথে তার আটকের পরে ব্রিফিংয়ে বলেছেন যে- ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে মানবপাচার, কিডনি কেটে বিক্রি, রাতের আঁধারে মরদেহ দাফন ও টর্চার সেলসহ মৃত্যু সনদে জালিয়াতির মতো ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে। উক্ত অভিযোগ তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশ। এক সময় মিল্টন সমাদ্দার তার বাবাকে পেটালে এলাকাবাসী তাকে এলাকাছাড়া করে। সেখান থেকেই মূলত তার অপরাধের উত্থান হয়। পরে শাহবাগে এসে একটা ফার্মেসিতে চাকরি করেন। সেখান থেকে ওষুধ চুরি করার কারণে তাকে বের করে দেওয়া হয়। পরে মিটু হালদার নামে এক নার্সকে সে বিয়ে করেন। বিয়ে করার পর তিনি একটা ‘ওল্ড অ্যান্ড কেয়ার’ স্থাপন করেন। তারপর সে তার স্ত্রীকে নিয়ে মিরপুরে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। এককথায় মিল্টন সমাদ্দার মানবতার মুখোশ পরে একজন ভয়ংকর অপরাধীর মতো দিনের পর দিন ভয়াবহ সব অপরাধ করে যাচ্ছিলেন। এখন মিল্টন সমাদ্দার-এর পরিচয় তুলে ধরে তাকে কেন ভয়ংকর অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা যায় সে বিষয়ে অপরাধবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা করতে চাই।

শুরুতে অপরাধ, অপরাধী এবং ভয়ংকর অপরাধ বিষয়ে কিছু জানার চেষ্টা করবো। বিচ্যুত আচরণ সমাজ ব্যবস্থারই অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিটি সমাজে কোনো-না-কোনো ধরনের বিচ্যুত আচরণ লক্ষ করা যায়। বিচ্যুত আচরণ থেকেই অপরাধের সূচনা হয়। সাধারণ অর্থে সমাজের প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ কিংবা রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য করলে তাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। অপরাধের সংজ্ঞায় বিশেষজ্ঞ বি. ভূষণ (১৯৮৯) বলেছেন- অপরাধ বলতে বুঝায় গোষ্ঠীগত রীতিনীতির পরিপন্থি কোনো আচার-আচরণ। এসব আচরণ প্রতিষ্ঠিত কোনো গোষ্ঠী কিংবা তাদের আইন কর্তৃক অনুমোদিত নয়। এটি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য কষ্টদায়ক সমাজবিরোধী আচরণ। (Crime refers to any behaviour contrary to the groups of moral codes for which there are formalized group sanctions whether they are laws or not. It is anti-social behaviour harmful to individuals or groups). বস্তুত অপরাধ হচ্ছে এমন আচরণ বা কৃতকর্ম যা সমাজে আপত্তিকর এবং আইন ও রাষ্ট্র কর্তৃক নিষিদ্ধ। অপরাধ সমাজে নিন্দনীয় এবং আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত। সমাজে এক ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয় লোকচক্ষুর অন্তরালে, অত্যন্ত প্রচ্ছন্নভাবে। এসব অপরাধ করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধী শাস্তি এড়িয়ে যেতে পারে। এটি মূলত দুর্নীতি বা ভদ্রবেশী অপরাধ (White-collar crime)। কর ফাঁকি দেওয়া, ঘুষ নেওয়া, তহবিল তছরুপ করা ইত্যাদি এ শ্রেণির অপরাধ।

অপরাধের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Crime): অপরাধ সামাজিক আচরণবিধি ও মূল্যবোধের পরিপন্থি একটি প্রত্যয়। এর কতগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন: মানুষের সামাজিক আচরণের একটি অস্বাভাবিক রূপ হচ্ছে অপরাধ। এটি সামাজিক, ব্যক্তিগত এবং আদর্শগতভাবে ক্ষতিকর। অপরাধ মূলত আপেক্ষিক; সময় ও সমাজভেদে এর রূপ ও মাত্রাগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সামাজিক সংহতি ও স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি হচ্ছে অপরাধ। অপরাধ সমাজ কাঠামোর সাথে সম্পৃক্ত। যেমন: শিল্প সমাজের অপরাধপ্রবণতা কৃষি সমাজ অপেক্ষা ভিন্নতর। অপরাধ সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া এবং সামাজিকীকরণের ফল। অপরাধ আইনগতভাবে শাস্তিযোগ্য। বয়স অনুযায়ী অপরাধের মাত্রা ও গুরুত্ব নিরূপণ করা হয়। অপরাধ নিন্দনীয় এবং বর্জনীয়।

অনেক সময় মহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে কোনো কোনো মানুষ অপরাধে লিপ্ত হয়। যেমন: ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্য সেন প্রমুখ মহান স্বাধীনতার আদর্শে নিবেদিত হয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। অপরাধ সমাজের অপরিহার্য এবং অবিচ্ছেদ্য বিষয়। টি. এরিকসন (T. Erikson) বলেছেন, সন্ন্যাসীদের সমাজে বসবাসকারী সদস্যদের মধ্যেও অপরাধ প্রবণতা বিদ্যমান। মিল্টন সমাদ্দার ভদ্রতা ও মানবিকতার মুখোশ পরে অপরাধ করছিলেন। ডুর্খেইম অপরাধকে সামাজিক দিক থেকে স্বাভাবিক কার্যকলাপ এবং সুস্থ সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ষড়যন্ত্র, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য উস্কানি, শর্তভঙ্গ, উন্মুক্ত অপরাধ সংঘটন ইত্যাদি সমাজের ক্ষতি সাধন করে। মাদকাসক্তি, ডাকাতি, আত্মহত্যা ইত্যাদি ব্যক্তিগত এবং বেশ্যাবৃত্তি, সমকামিতা, গর্ভপাত প্রভৃতি কোনো কোনো রক্ষণশীল সমাজের আদর্শগত ক্ষতি সাধন করে থাকে।

অপরাধের ধরনসমূহ (Types of Crime): সমাজে নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়। সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধবিজ্ঞানীরা পাঁচ ধরনের অপরাধের উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে- ০১) ভদ্রবেশী অপরাধ (White-collar crime) ০২) সংগঠিত অপরাধ (Organised crime) এবং ০৩) ফৌজদারি অপরাধ (Criminal crime)।

ভদ্রবেশী অপরাধ কী? সাধারণত ‘ভদ্রলোকেরা’ যে অপরাধ করে তাকে ভদ্রবেশী অপরাধ বলে। শিক্ষিত, পেশাজীবী এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গই এ ধরনের অপরাধের সাথে বেশি যুক্ত থাকেন। দায়িত্বে অবহেলা, কাজে ফাঁকি, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, আয়কর ফাঁকি, জালিয়াতি, প্রতারণা, তহবিল তছরুপ, মিথ্যা সাক্ষ্যদান, ট্রেডমার্ক বা বইয়ের পাণ্ডুলিপি চুরি বা নকল করা ইত্যাদি ভদ্রবেশী অপরাধ বলে পরিগণিত। বাংলাদেশে একজন ভদ্রবেশী অপরাধী হিসেবে মিল্টন সমাদ্দার চিহ্নিত, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। হোয়াইট কলার অপরাধের কোনো আইনগত সংজ্ঞা নেই। বাংলা শব্দে এটা ‘ভদ্রবেশী অপরাধ।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর উৎপত্তি হলেও ক্রমে তা বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের অপরাধকর্মে লিপ্ত ব্যক্তিদের অভিহিত করা হচ্ছে ‘হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল’ রূপে। হোয়াইট কলার অপরাধ সর্বাপেক্ষা সংঘটিত হচ্ছে বিভিন্ন দেশের করপোরেট বা করপোরেশনে। অভিযোগ থেকে মুক্ত নয় বাংলাদেশও। অপরাধবিজ্ঞানীদের মতে, করপোরেট অপরাধের প্রধানতম উদ্দেশ্যই হলো, অধিকতর মুনাফা অর্জন।

ব্যবসাক্ষেত্রে ব্যাপক অপরাধমূলক আচরণ সংঘটিত হওয়ার ফলে প্রখ্যাত অপরাধ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাদারল্যান্ড-এর গবেষণায় সর্বপ্রথম হোয়াইট কলার অপরাধ বা ‘ভদ্রবেশী অপরাধ’ তত্ত্বের প্রকাশ ঘটে ১৯৩৯ সালে। প্রখ্যাত মার্কিন অপরাধ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাদারল্যান্ড ‘হোয়াইট কলার অপরাধ’ তত্ত্বের উদ্ভাবক। সাদারল্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতে হোয়াইট কলার অপরাধ ধারণার একটি রূপরেখা প্রণয়নের প্রয়াস পান। অন্য অপরাধবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ব্যবসায় অধিক মুনাফা লাভ এবং স্বীয় শক্তি বৃদ্ধির লালসাকে কেন্দ্র করেই হোয়াইট কলার অপরাধের উৎপত্তি ঘটেছে।

১৯৩৯ সালে সর্বপ্রথম ভদ্রবেশী অপরাধী বা হোয়াইট কলার ক্রিমিনালদের আসল অপরাধী এবং অপরাধকে দণ্ডবিধি আইনের শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। হোয়াইট কলার ক্রিমিনালরা সাধারণ অপরাধীদের তুলনায় অধিকতর বুদ্ধিমান, আচরণে ভারসাম্যপূর্ণ, কর্মজীবনে কৃতকার্য এবং সমাজে উঁচু পদমর্যাদার অধিকারী হয়ে থাকে। মিল্টন সমাদ্দার-এর কথা এরই মধ্যে নিশ্চয়ই আমরা জেনে গেছি। এ ধরনের অপরাধীদের অপরাধ অপ্রত্যক্ষ, নৈর্ব্যক্তিক এবং ছদ্মনামে সংঘটিত হয়। এসব ভদ্রবেশী অপরাধীর কৃতকর্ম সহজে সাধারণের দৃষ্টিগোচর হয় না। অথচ, হোয়াইট কলার ক্রিমিনালদের অপরাধের অর্থনৈতিক ফলাফল অন্যান্য সাধারণ অপরাধের অপেক্ষা অনেক গুণ বেশি। অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর প্রভাব আরও ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী। কারণ এরা বিশ্বাস ভঙ্গ করে। ফলে অবিশ্বাসের জন্ম হয়। এতে করে বিস্তৃত পরিসরে সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। যা রাষ্ট্রের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

সমাজতাত্ত্বিক ও মানসিক বৈকল্যের কারণে মানুষ অপরাধ করে- এই গতানুগতিক ব্যাখ্যা পক্ষপাতদুষ্ট নমুনার ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে অকার্যকর অভিহিত করে হোয়াইট কলার অপরাধের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়। আর্থসামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগণ অপরাধের ঊর্ধ্বে- এমন ভ্রান্ত ধারণাকে অস্বীকার করেন অপরাধ বিজ্ঞানীরা। গতানুগতিক ব্যাখ্যায় কেবলমাত্র নিম্নশ্রেণির লোকেরাই অপরাধ করে- এমন ধারণাকে তিরস্কৃত করা হয়। উচ্চ আর্থসামাজিক শ্রেণিভুক্ত কোনো ব্যক্তি যদি পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে দণ্ডবিধি আইনের পরিপন্থি কর্ম করেন, তবে তাকে হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল বলা যায়। যেহেতু এসব অপরাধ প্রতারণার শামিল এবং জনস্বার্থের পরিপন্থি। এ জন্য আইনে শাস্তির ব্যবস্থা থাকলেও হোয়াইট কলার ক্রিমিনালরা আইনের প্রতিই প্রকারান্তরে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে চলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে সরকারি রেশনিং ব্যবস্থাসহ মূল্যনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে প্রতারণামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিভিন্ন চিত্র ‘The Black Market’ নামক গ্রন্থে উপস্থাপন করেন মার্শাল বি ক্লিনার্ড। হার্বাট ইডেলহার্জ হোয়াইট কলার অপরাধ বলতে এমন সব বেআইনি কর্মের উল্লেখ করেন, যা কেবল কূটবুদ্ধির দ্বারা সংঘটিত হয়। ফ্রাংক হারটুংগ ডেট্রয়েট শহরে পাইকারি মাংস বিক্রয় সম্পর্কে এক সমীক্ষায় প্রমাণ করেন ১৯৪২ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত ৮২টি প্রতিষ্ঠিত মাংস ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ১৯৫টি আইন ভঙ্গের দায়ে অপরাধী সাব্যস্ত হয়। অধিক মুনাফা লাভের জন্যই তাদের বিরুদ্ধে আইন ভঙ্গের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।

বুদ্ধির দ্বারা সংঘটিত অপরাধের ব্যাখ্যা হার্বাট ইডেলহার্জের মতে, হোয়াইট কলার ক্রিমিনালরা নানাভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে বা পর্দার অন্তরালে থেকে অপরাধের আশ্রয় নেন। অসতর্কতার সুযোগ হাতিয়ে নিয়ে সাধারণত তারা অপরাধকর্মটি হাসিল করেন। শিক্ষিত ব্যক্তি এসব ভদ্রবেশী অপরাধীর কার্যাবলী সম্পর্কে প্রশ্নে জড়াতে চান না। অপরাধী শিক্ষিত ব্যক্তিকে বুঝতে দিতে চায় না যে, তিনি প্রকৃতই ক্ষতির শিকার হয়েছেন। জনসাধারণের স্বার্থের পরিপন্থি এমনতর কাজ করার অভিপ্রায়কে চলমান রাখতে হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রাখে। অপরাধ চাপা দিতে তারা প্রতারণামূলক দলিলাদি বা প্রমাণপত্র তৈরি করেন। এই দেশকেও হোয়াইট কলার অপরাধ গ্রাস করেছে- যেমন: চিকিৎসা শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতারণা, করপোরেট অপরাধ, সরকারি উচ্চপদস্থের দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক প্রতারণা ও দুর্নীতি।

মিল্টন সমাদ্দার যে অপরাধটি করেছেন তা সংগঠিত অপরাধও হয়। সংগঠিত অপরাধ হচ্ছে দলগত অপরাধ। ‘চেইন অব কমান্ড’ অনুসরণ করে ‘সিন্ডিকেট’ পদ্ধতিতে বেশকিছু মানুষ সমন্বিতভাবে এ ধরনের অপরাধ সংঘটন করে। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক মাফিয়াচক্র, সন্ত্রাসীগোষ্ঠী সংগঠিত অপরাধে যুক্ত থাকে। চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, নারী ও মানবপাচার, জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড, পতিতাবৃত্তি ইত্যাদি অপরাধ দলগতভাবে সংঘটিত অপরাধ। বিভিন্ন সরকারি সেবা যেমন: ভিসা-পাসপোর্ট, স্বাস্থ্যসেবা, ভূমি অফিস বিভিন্ন ক্ষেত্রেও ‘সিন্ডিকেট’ভিত্তিক অপরাধ পরিলক্ষিত হয়। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যারা ব্যবহার করেন তাদের নিকট এই অপরাধ অত্যন্ত সুপরিচিত। ১৬ মিলিয়ন অনুসারীসহ (ফলোয়ার) প্রায় ২ কোটি মানুষ ভয়ংকর অপরাধী মিল্টন সমাদ্দারকে মানবতার সেবক হিসেবে জানে। অনুসারীর সংখ্যাটা নেয়াহেত কম নয়। তিনি ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামের বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলেছেন অসহায় মানুষের জন্য। অসুস্থ কিংবা ভবঘুরেদের রাস্তা থেকে কুড়িয়ে সেখানে আশ্রয় দেন। সেসব অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশুকে নিয়ে ভিডিও কনটেন্ট প্রস্তুত করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন এবং মানুষের অসহায়ত্ব তুলে ধরে তাদের জন্য বিত্তবানদের কাছে মানবিক সাহায্য চান। মানুষ উক্ত আবেদনে সাড়াও দেন প্রচুর। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ১৬টির বেশি নম্বর এবং তিনটি ব্যাংক হিসাবে প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকা জমা হয়। এর বাইরে অনেকেই তার প্রতিষ্ঠানে সরাসরি অনুদান দিয়ে আসেন। মিল্টন সমাদ্দার মানবিক কাজের জন্য এখন পর্যন্ত তিনটি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও পেয়েছেন ।

ইতোমধ্যে মিল্টনের আসল চেহারা জনগণ টের পেয়ে গেছে। মানবিকতার আড়ালে তিনি যা এতদিন করেছেন তাতে যে কারোরই গা শিউরে ওঠার মতো বিষয়। ভদ্রবেশে তিনি ‘সিন্ডিকেট’ভিত্তিক অপরাধ করেই চলছিলেন। ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ আশ্রম ঘিরেই ভয়াবহ প্রতারণার জাল বিস্তার করেন মিল্টন। প্রকৃতপক্ষে মিল্টন যা প্রচার করেছিলেন তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সিন্ডিকেটভিত্তিক ভদ্রবেশেী অপরাধ তিনি করেছেন। লাশ দাফন করার যে হিসাব দিচ্ছেন, তাতেও আছে বিরাট গরমিল। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো, মিল্টনের বিরুদ্ধে রয়েছে অসহায় মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার নামে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন কিডনী বিক্রির অভিযোগ। মিল্টন সমাদ্দারের ব্যক্তিজীবনেও নৈতিকতা বা মানবিকতার বালাই নেই। কিশোর বয়স থেকেই ছিল অর্থের লোভ। প্রতিবেশী, চিকিৎসক কিংবা সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময় তার কাছে শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। এমনকি নিজের জন্মদাতা পিতাকেও বেধড়ক মারধরের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জনগণের প্রত্যাশা- ভদ্রবেশে ও সুসংঘটিতভাবে যে ফৌজদারী অপরাধ মিল্টন করেছেন তার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে সঠিক বিচার হোক যাতে ভবিষ্যতে এ রকম ভয়াবহ অপরাধ আর কেউ না করে। মিল্টনের শাস্তি হোক অন্য অপরাধীরদের জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ।

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম: আইন ও অপরাধ বিষয়ক গবেষক, কলামিস্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :