হাওরের ছায়ারানী কেমন আছে? বেঁচে আছে কি?

মোঃ মেহেদি হাসান খাঁন
 | প্রকাশিত : ২৯ এপ্রিল ২০১৭, ২০:৫১

ছায়ারানীকে আপনারা চিনবেন না। সে এক লড়াকু গরীব নারী। হাওর অঞ্চলে তার বসবাস। তার সাথে আমার পরিচয় ২০০৭ সালে। বেসরকারি একটি ক্ষুদ্র ঋণ-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে চাকরী করার সুবাদে ছায়ারানীর সাথে আমার যোগাযোগ হয়। সুনামগঞ্জের যে শাখায় আমার পোস্টিং ছিল, সেখানে রান্না ঘরে কাজ করত ছায়ারানী। আতপ চালের ভাত আমার কখনোই সহ্য হত না। এই ছায়ারানী আমাকে আতপ চালের ভাত খাওয়া শিখিয়েছিলেন।

হাওরে বানের পানির তাণ্ডব দেখে আজ কেন যেন আমার বারবার হাওর অঞ্চলের এই ছায়ারানীর কথা মনে পড়ছে। বহুবছর ছায়ারানীর সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। জানিনা সে বেঁচে আছে কি না? বছরখানেক সেই এনজিওতে চাকরি করে প্রতিষ্ঠানের নীতি এবং আদর্শের সাথে আমার নীতি এবং আদর্শের মিল না হওয়ায় চাকরি ছেড়ে চলে আসি। যদি ছায়ারানী বেঁচে থাকে তাহলে হাওর অঞ্চলের এই দূর্যোগ অবশ্যই তাকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন এই এক ছায়ারানীকে দিয়েই বোঝানো যাবে।

ছায়ারানীর কেউ ছিলোনা। দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় মাঝে মাঝে তার সাথে দেখা করতে আসতো। একদিন দেখি, ছায়ারানীর চোখের কোনে জল। আমি তার কাছে কারণ জানতে চাইলে চোখের কোনের জল মুছে আমাকে বলল, গতরাত্রের (তারিখ মনে নেই আজ) অল্পসময়ের শিলা বৃষ্টিতে তার কাছে যে আত্মীয় আসত তার জমির সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু সেই অল্প সময়ের শিলা বৃষ্টিতে যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে আজ হাওর অঞ্চলের বোরো ফসলের হাজার হাজার একর জমি পাহাড়ী ঢলের পানিতে তলিয়ে গিয়ে কী পরিমাণ সর্বনাশ হয়েছে তা ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে।

শহরের মানুষের কাছে হাওর একটি রোমান্টিক শব্দ হলেও হাওর অঞ্চলের মানুষের কাছে এই হাওরই জীবিকার একমাত্র আধার। বাংলাদেশের হাওরের মানুষগুলো যেন আলোর নিচে অন্ধকারের মতো সবার চোখের আড়ালে। সামনে রমজান মাস। জানিনা মুনাফালোভীরা হাওর অঞ্চলের দূর্যোগের দোহায় দিয়ে গরীব মানুষগুলোকে কতটা জিম্মি করবে ! হাওর অঞ্চলের মানুষদের হাসি-কান্না আমার চোখে ভাসে। ফসল যদি একবার ঘরে উঠাতে পারে এদের আনন্দ দেখে ক; সে আনন্দ আমাদের ঈদকেও হার মানায়। ফসল ঘরে উঠানোর সাথে সাথে হাওর অঞ্চলে নানান ধরনের মেলা বসে। আখের মেলা, বেলের মেলা, এক কোপ দিয়ে মহিষ বলির উৎসবের মেলা, এগুলো সবই আমি নিজ চোখে অবলোকন করেছি । এবার হয়তো এই মেলা আর বসবে না, মেলার আনন্দ উৎসব আর হবে না। মেলা ফেলে, উৎসব ফেলে এরা এখন ছুটছে ত্রাণের আশায়।

নিঃস্ব হয়ে গেছেন অবস্থাপন্ন কৃষক থেকে হাওর পাড়ের দরিদ্র মানুষ। বোরো ধান ডুবে পচে গেছে। মাছ, গরু-ছাগল, হাঁস মুরগীসহ জলজ নানা প্রাণী মারা গেছে। অথচ দেশের হাওর অঞ্চলের মানুষকে পানিতে ফেলে হাওর উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক সাহেব গিয়েছেন বিদেশে ঘুরতে। আরো বড় বড় সরকারি কর্মকর্তা আছেন যারা, হাওর অঞ্চলের ছায়ারানীর মত মানুষের কাছে বড় অফিসার। এই অফিসারগুলো বাধ রক্ষার নামে পুকুর চুরিতে ব্যস্ত থাকে। আমার নিজের চোখে দেখা সব। বাধ রক্ষার নামে এরা প্রতিবছর হাওর অঞ্চলের ছায়ারানীর মত মানুষের সাথে তামাশা করে। বাধ রক্ষার জন্য সরকারি বরাদ্দ সঠিকভাবে কাজে না লাগিয়ে পুকুর চুরির মাধ্যমে নিজেদের পরিবার পরিজনদের উন্নত জীবন-যাপন নিশ্চিত করে। যতই বলা হোক, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, জলবায়ূ পরিবর্তন, আসলে এগুলো মূল কারণ নয়। কিছু মানুষ দ্বারা (এনজিও, মধ্যস্বত্বভোগী এবং ইজারাদার) সৃষ্ট এই সমস্যা প্রাকৃতিক দূর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তোনের চেয়েও বেশি মারাত্মক। যার ছোবল থেকে হাওর অঞ্চলের ছায়ারানীর মত লাখ লাখ দরিদ্র মানুষের মুক্তি কি আদৌ আমরা অর্জন করতে পারব?

হাওর এলাকাগুলোতে সরকারি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চেয়েও ভয়ংকর কাজ করে এনজিওগুলো। সরকার সেখানে ত্রান তৎপরতা চালাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ঋণআদায় কর্মসূচি স্থগিত রাখতে নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এনজিওগুলো আমার অভিজ্ঞতায় বলে খুব কষ্ট দেবে এইসব গরীব মানুষদের। এরা ঋণের টাকা আদায় করার জন্য হেন কোনো উপায় নেই যার আশ্রয় নিবেনা। ধান হারিয়ে, মাছ হারিয়ে গরীব মানুষগুলো কীভাবে ক্ষুদ্র ঋণের সুদ দেবে তার চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটাবে। হয়তো গ্রামের কোনো সুদি-মহাজন থেকে ঋণ নিয়ে, কিংবা একমাত্র গরু বা ছাগল বেঁচে এনজিওর ঋণ শোধ করতে চাইবে। কিন্তু পারবেনা। এক ঋণ চক্র থেকে বের হয়ে আরেক ঋণ চক্রে আটকে যাবে। সরকারকে তাই অনুরোধ করব, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মত এনজিওগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করুন।

লেখকঃ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :