বিয়েবাড়িতে ভূরিভোজ লাদেন মামুনের, পায় না পুলিশ
ডজন মামলার পলাতক আসামি তিনি। কিন্তু প্রকাশ্যে বিয়েবাড়িতে দাওয়াত খেতে যান। পোলাও, খাসির মাংসের সঙ্গে পাকিস্তানি মোরগের কচি হাঁড় চিবুনোর দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেন তার কর্মীরা। সেই ছবি ফেসবুকেও দেয়া হয় আবেগঘন বক্তব্যসহ। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, আসা-যাওয়ার পথে কত পুলিশের সঙ্গে তার দেখা হলো। কিন্তু তার ভাবে মনে হলো, তিনি যেন পুলিশ প্রহরাতেই রয়েছেন।
এই ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি আব্দুল্লাহ আল মামুন। গাজীপুর মহানগরের মানুষ তাকে চেনে মামুন বিন লাদেন নামে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের এই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে জয়দেবপুর থানায় খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজিসহ ডজনের বেশি মামলা। বেশ কয়েকটি মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামি হলেও তার প্রকাশ্য আগমন পুলিশ দেখতে পায় না।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক বছরের বেশি সময় ধরে নিজ এলাকার বাইরে থাকছেন মামুন লাদেন। তার অতীত নির্যাতন ও ভয়ংকর সন্ত্রাসী কর্মকা-ের কথা ভেবে আজও বুক কেঁপে ওঠে মহানগরের সাধারণ মানুষের। তাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে বিগত দিনে মহানগরে বহুবার বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন হয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো নড়াচড়া মেলেনি পুলিশের।
তবে জয়দেবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আমিনুল ইসলামের দাবি, মামুন মন্ডলকে গ্রেপ্তারে নিয়মিত অভিযান চলছে। মামুন মন্ডলের এলাকাসহ এর আশপাশের এলাকাগুলোতে পুলিশের গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে।
মামুন মন্ডল তার এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করলেও পুলিশ কেন তাকে আটক করছে না- এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি জানান, এ ধরনের কোনো তথ্য তার কাছে নেই। জানলে তিনি অবশ্যই দ্রুত ব্যবস্থা নিতেন।
জয়দেবপুর থানা সূত্রে জানা গেছে, ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামি মামুন ম-লের বিরুদ্ধে থানায় ডজনের বেশি মামলা রয়েছে।
এসব মামলা থোড়াই কেয়ার করে গাজীপুর মহানগরে অবাধে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করছেন মামুন ম-ল। সম্প্রতি এক বিয়ের অনুষ্ঠানে তার যোগদানের ছবি তোলেন এক কর্মী। পরে সেই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে একজন লিখেছেন, ‘দীর্ঘদিন পর আমার ভালোবাসার, আস্থার, নির্ভরতার মানুষ জনাব আব্দুল্লাহ আল মামুন মন্ডল ভাইয়ের সাথে একটি অনুষ্ঠানে।’ ছবিতে জয়দেবপুর থানার বেশ কয়েকটি মামলার আসামি মোশাররফসহ মামুন মন্ডলের বেশ কয়েকজন সহযোগীকেও দেখা যায়। অথচ দীর্ঘ এক বছর ধরে জেলা পুলিশ মামুন মন্ডলকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালালেও তাকে খুঁজে পাচ্ছে না।
এদিকে মামুন মন্ডলের বিরুদ্ধে করা বেশ কয়েকটি মামলার বাদীদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, মামুন মন্ডলের ভয়ে তাদের নিত্যদিন অতিবাহিত হচ্ছে। তারা দ্রুত মামুন মন্ডল ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
মহানগরের ওঝাড়পাড়া এলাকার গিয়াস উদ্দিন মিয়ার একমাত্র ছেলে মো.সাজেদুল ইসলাম ওরফে রানাকে মামুন ম-ল ও তার সহযোগীরা কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে বলে থানায় মামলা রয়েছে। গিয়াস উদ্দিন বলেন, মৃত্যুর আগে তার ছেলে হত্যাকারীদের নাম বলেছে। তিনিও শুনেছেন। এ ঘটনায় তিনি জয়দেবপুর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এরপর থেকে তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে মামুন মন্ডল ও তার বাহিনীর সদস্যরা। হত্যা মামলার বয়স ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও আজও হত্যাকারীকে আটক করতে পারেনি পুলিশ।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, মামুন মন্ডল কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার আগেই মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় ক্লাব গড়ে তুলেছিলেন। এসব ক্লাবে গাজীপুর ও এর আশপাশের জেলাগুলোর চিহ্নিত সন্ত্রাসী, মাদকাসক্ত ও বখাটে যুবকদের অবাধ আনাগোনা ছিল। মহানগরে বহু শিল্প-কারখানায় চাঁদাবাজি, ভাঙচুর, নতুন বাসাবাড়ি ও শিল্প-কারখানা নির্মাণে চাঁদা দাবি, অবৈধ গ্যাস সংযোগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের নির্মাণকাজে লাদেন বাহিনীকে চাঁদা দিতে হতো। অন্যথায় নির্মাণকাজ বন্ধ।
এ ছাড়া ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকায় মহাসড়ক দখল করে গাড়ির স্ট্যান্ড বানানো, ফুটপাত দখল করে দোকানঘর নির্মাণসহ লাদেন বাহিনীর বিরুদ্ধে চুরি-ছিনতাইয়েরও অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় থাকা মামুন মন্ডলের হাত থেকে রক্ষা পায়নি জয়দেবপুর থানার পুলিশ থেকে শুরু করে নির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরাও।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, নগরের সাইনবোর্ড এলাকায় এলিট আয়রন স্টিল মিলের প্যাকিং শ্রমিক মোমতাজ উদ্দিনের ছেলে মামুন মন্ডল। কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি স্বল্প সময়ে তার অপরাধের স¤্রাজ্য বিস্তার করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। চলাচল করতেন বিলাসবহুল পাজেরো গাড়িতে। তার গাড়ির সামনে ও পেছনে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসসহ অন্তত ৩০-৪০ জনের মোটরসাইকেলের বহর থাকত। তিনি নগরের যেই এলাকাতেই যেতেন, আতঙ্কে থাকত সাধারণ মানুষ। গাজীপুরের মালেকের বাড়ি, ভুসির মিল, হাজীর পুকুর, সাইনবোর্ড, বোর্ডবাজার, বড়বাড়ি, এরশাদ নগরসহ মহানগরের লাখো মানুষ লাদেন বাহিনীর কাছে জিম্মি ছিল।
মামুন মন্ডলের বেপরোয়া চলাফেরা ও সন্ত্রাসীমূলক কর্মকা-ে মহানগরের পরীক্ষিত ও ত্যাগী আওয়ামী লীগের নেতারাও চরম বিরক্ত বলে জানা গেছে। তবে মহানগরের এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে মামুন মন্ডলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় দলীয় নেতাকর্মীরা কিছু বলতে সাহস পান না।
জানা গেছে, মামুন মন্ডলের বিশাল স¤্রাজ্য, সন্ত্রাসী বাহিনী ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ রক্ষা করতে বর্তমানে লাদেন বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করছেন ইকবাল মোল্লা। ইকবাল মোল্লা মহানগরের ওজারপাড়া এলাকার মৃত ছামাদ মোল্লার ছেলে। পেশায় ইকবাল মোল্লা একজন জমির দালাল।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের গত নির্বাচনে ইকবাল মোল্লা বিএনপির মেয়র প্রার্থী অধ্যাপক এম এ মান্নানের পক্ষে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন বলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়। তবে তিনি বর্তমানে আওয়ামী লীগে যোগদানের জন্য মরিয়া। সেই লক্ষ্যে সম্প্রতি ইকবাল মোল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের এক ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতার বাড়িতে তার ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করে তিরস্কৃত হয়েছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা গেছে। মহানগরে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ইদানীং মামুন মন্ডলের সঙ্গে ইকবাল মোল্লাকেও প্রায়ই দেখা যাচ্ছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়।
এ ব্যাপারে জানতে ইকবাল মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, মামুন মন্ডল ও তিনি একই এলাকায় থাকেন। তবে কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানের মামুন মন্ডলের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। ছবিও তোলেননি। ওই ছবি অন্য ইকবাল মোল্লার বলে দাবি করেন তিনি।
একসময় বিএনপি করতেন উল্লেখ করে ইকবাল বলেন, ‘এখন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছি। মামুন মন্ডল ও তার কর্মীদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। আমি ব্যক্তির রাজনীতি করি না। আমি আওয়ামী লীগে যোগদান করেই স্থানীয় এমপি জাহিদ আহসান রাসেল ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান এবং সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি আমার ইমেজেই চলি।’
এসব বিষয়ে জানতে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি এক ঘণ্টা পর কথা বলতে রাজি হন। কিন্তু পরে তার মোবাইল ফোনে নম্বরে বহুবার কল ও এসএমএস করলেও তিনি সাড়া দেননি। গাজীপুর পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ জানান, কাউন্সিলর আব্দুল্লাহ আল মামুন মন্ডলের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হবে।
(ঢাকাটাইমস/৮মে/মোআ)
মন্তব্য করুন