ভেজালমুক্ত ফলের নিশ্চয়তায় খাগড়াছড়ির ‘গ্রীন টাচ এগ্রো’
শুরুটা হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার জালিয়াপাড়ায় প্রায় ৪০ একর জায়গার ওপর শাহাজ উদ্দিন শখের বশে কিছু বনজ গাছের সাথে লাগিয়েছিলেন আমের কিছু গাছ। এরপর ২০০১ সালে যখন বাংলাদেশে আম্রপালি যুগের সূচনা হলো তখন তিনি বাগানে ৬০০ আমগাছ লাগালেন। আমের ফলন এল ২০০৪ সালে। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একসময় রাজনীতি ও ঠিকাদারি ব্যবসা করলেও এখন পুরোপুরি বনে গেছেন কৃষক। শখ থেকে শুরু করলেও এখন পুরোদস্তুর পেশাদার আধুনিক বাগান গড়ে তুলেছেন শাহাজ উদ্দিন।
ভেজালের এই যুগে বাজার থেকে কোনো ফল কিনেই যেন স্বস্তি নেই। আম, জাম, লিচু, কলা- সবকিছুতে ফরমালিন, কার্বাইডের মতো বিষাক্ত সব রাসায়নিকের ব্যাবহার হচ্ছে অবাধে। অথচ বাজারের কেনা ফল যেখানে ১৫-২০ দিনেও নষ্ট হয় না সেখানে একেবারেই ব্যতিক্রম খাগড়াছড়ির ‘গ্রীন টাচ এগ্রো’। তাদের ফল-ফলাদিতে ওষুধ কিংবা কেমিকেলের সংশ্রব যে একেবারেই নেই। ফল কিনে নিয়ে বাড়িতে ফেলে রাখলে দুই/তিন দিনেই পচন ধরে যাবে তাতে।
শাহাজ উদ্দিন এবং তার ‘গ্রীন টাচ এগ্রো’ একেবারে প্রমাণ সহকারে ভোক্তাদের ভেজালমুক্ত ফলের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে। শুধু লাভ নয়, ভোক্তাদের সুস্থতার দিকে লক্ষ তাদের দায়িত্ব বলে জানান কৃষি উদ্যোক্তা শাহাজ উদ্দিন। তাই উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো অবধি সবকিছুই ঘটে তার ও তার সন্তানদের তত্ত্বাবধানে।
বর্তমানে গ্রীন টাচ এগ্রোর বাগানে আম, লিচু, ড্রাগন, মালটা, আনারস, লটকন, পেয়ারা বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ফল বাগানে থাকলেও মূলত আমই বাগানের প্রধান ফল। আম্রপালি আমের পাশাপাশি তার বাগানে আরও উৎপাদিত হচ্ছে মল্লিকা, রত্না, নিলাম্বরী, হিমসাগর, আশ্বিনি, শ্রাবণী, হাড়িভাঙ্গা, ল্যাংড়া এবং মাহালিশা প্রজাতির আম। মাহালিশা আমটি থাইল্যান্ডের জাত হলেও ‘গ্রীন টাচ এগ্রো’তেই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয় বলে জানান শাহাজ উদ্দিনের বড় ছেলে মো. মাহমুদুল হাসান। বরাবরের মতো এ বছরও তাদের বাগানে আমের ফলন ভালো হয়েছে। জুনের মাঝামাঝি সময় বাজারে আসবে তাদের আম। এ বছর বাগান থেকে প্রায় ৩০ মেট্রিক টন আম বাজারজাত করতে পারবেন বলে আশা করেন তিনি।
এই বাগানে দেশি ফলের পাশাপাশি বিদেশি ফল গ্রীন মাল্টা ও ড্রাগন ফ্রুটের চাষ হচ্ছে বেশ জোরেশোরে। বছর তিনেক আগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরীক্ষামূলক কার্যক্রমে মাল্টা এবং ড্রাগন চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রায় ৫০০ মাল্টা এবং ৬০টি ড্রাগন গাছ লাগান। গত বছর এই দুটি বিদেশি ফলেরই ফলন আসে। এ ছাড়া লিচু, কলা, আনারস, কাঁঠাল, লটকন, থাই পেয়ারা, বরই, কামরাঙা, জলপাই, থাই নারিকেল, সুপারি এবং বিভিন্ন প্রজাতির ঔষধি গাছসহ প্রায় ৬ হাজার ফলগাছ দিয়ে সমৃদ্ধ শাহাজ উদ্দিনের ‘গ্রীন টাচ এগ্রো’। বর্তমানে এখানে প্রায় সারা বছরই বিভিন্ন ফল পাওয়া যায়।
প্রথম দিকে স্থানীয় বাজারে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আম বিক্রয় শুরু করলেও বাগানের ফলের সুনাম এখন দেশের সর্বত্র। স্থানীয় বাজার ছাড়াও ঢাকায় মিরপুর ও পল্টনে নিজস্ব স্টলসহ তিনটি স্টলে বিক্রি হয় তাদের আম। ফোনে কেউ অর্ডার করলে কুরিয়ারের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া হয় দেশের যেকোনো প্রান্তে। জাতীয় ফল মেলায়ও প্রতিবছর স্টল থাকে। যেখানে ‘গ্রীন টাচ এগ্রো’র উৎপাদিত বিভিন্ন ফল পাওয়া যায়।
শাহাজ উদ্দিনের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন মানুষকে অনুপ্রাণিত করে পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিটি পাহাড়ের উর্বর জমিতে ফলদ বাগান গড়ে তোলা। তিনি বলেন, ‘পাহাড়ে যদি ঠিকভাবে ফল উৎপাদন করা যায় তাহলে দেশের মানুষের ফলের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরেও রপ্তানি করা যাবে। আর আমার এই স্বপ্ন সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতেই আমি ২০১৫ সাল থেকে ‘গ্রীন টাচ নার্সারী’ শুরু করেছি। এখান থেকে নতুন নতুন উদ্যোক্তারা উন্নত জাতের চারা গাছ সংগ্রহ করে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী বাগান গড়তে পারবে।’
‘গ্রীন টাচ এগ্রো’ ২০০৮ সালে পেয়েছে জাতীয় পুরস্কার। আর ২০১৫ সালে কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে শাহাজ উদ্দিন পেয়েছেন ইউডিসিসি পুরস্কার। এ ছাড়া ছোট-বড় পর্যায়ের নানা পুরস্কার আছে শাহাজ উদ্দিন এবং তার বাগানের ঝুড়িতে। নিজের আর্থিক চাহিদা মেটানো ছাড়াও বর্তমানে বাগানের আশপাশের প্রায় ৩০টি পরিবারের কর্মসংস্থানের উৎস ‘গ্রীন টাচ এগ্রো’।
শাহাজ উদ্দিন অবশ্য ফল চাষ করেই থেমে নেই। নির্ভেজাল মাংস দিয়ে আমিষের চাহিদা মেটাতে জৈবিক উপায়ে দেশি গরু মোটা-তাজাকরণ প্রকল্প শুরু করেছেন। জানালেন গুরুর পাশপাশি উন্নত জাতের টার্কি খামারও করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন শাহাজ উদ্দিন।
বছর জুড়ে বাগানটি দেখতে এবং প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে নতুন নতুন উদ্যোক্তা ও দরশনার্থীরা ভিড় জমান ‘গ্রীন টাচ এগ্রো’তে। শাহাজ উদ্দিন সব সময় দর্শনার্থীদের স্বাগত জানান।
ঢাকাটাইম্স/৪জুন/টিজেটি/কেএস
মন্তব্য করুন