কেকা আপা কেন ‘কেকাপ্পা’?
ইংরেজিতে বলে ‘ট্রল’, চালু বাংলায় বলা হয় ‘পঁচানো’। তার শুরুটা যদ্দুর মনে পড়ে গত বছরের রমজান থেকে। দেশ টিভির এক রান্নার অনুষ্ঠানে নুডুলসের আচার রাধা হলো ইফতারের আগের এক রান্নার রেসিপির অনুষ্ঠানে। সেই নিয়েই বাধলো বিপত্তি। কেকা ফেরদৌসি আর নুডুলস, ফেসবুক টুইটারের কড়াইতে ভাজা হয়ে মিলেমিশে সেই যে একাকার হয়ে গেলো, তার ঘ্রাণ আজ অব্দি সোশ্যাল মিডিয়ায় ম ম করছে।
অথচ এমন কিন্তু হবার কথা ছিল না। কেকা ফেরদৌসী সেই আশির দশক থেকে রান্নার অনুষ্ঠান করেন, যখন ছিল বিটিভির রাজত্বের যুগ। ‘ঘরে বাইরে’ নামে এক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের নানান রকম রান্নার রেসিপি দেখাতেন তিনি। বহু বছর ধরে স্কুল খুলে তিনি রীতিমত রান্না শেখাচ্ছেন। শুনে অবাক হবেন সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন কেকা ফেরদৌসী।
বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘প্রেসিডেন্ট’ এর কেন্দ্রীয় দুই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি এবং তার ভাই ফরিদুর রেজা সাগর। তো হঠাৎ এমন কি ঘটলো যাতে করে খ্যাতির চূড়া থেকে একেবারে তামাশায় পাল্টে গেলেন কেকা ফেরদৌসী? কেকা আপা থেকে কেন কেকাপ্পা হয়ে গেলেন?
এর পেছনে একটা কারণ আছে। তাকে বলে প্রোডাক্ট প্লেসমেন্ট। পণ্যের সরাসরি বিজ্ঞাপন না করেও গ্রাহককে একটা কোনো পণ্য সম্পর্কে জানানোর এ কৌশলকে মার্কেটিংয়ের ভাষায় বলে প্রোডাক্ট প্লেসমেন্ট। বলা যায় এর ভিষণ রকম অপব্যবহার হওয়াতেই ধরা খেলেন কেকা ফেরদৌসী।
কোন পণ্যের বিজ্ঞাপন না করেও তাকে গ্রাহকের মাথায় ঠুকে দেয়ার এই কৌশল সারা পৃথিবীর বিপণন বিশেষজ্ঞরা ব্যবহার করছেন। হলিউড বলিউডের সিনেমা থেকে শুরু করে আপনার প্রিয় সাস বাহু হিন্দী সিরিয়াল,সবাই কমবেশি প্রোডাক্ট প্লেসমেন্ট করে। রান্নার অনুষ্ঠান তার হাত থেকে রেহাই পাবে না এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে জনপ্রিয় বহু অনুষ্ঠানের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎসই হলো প্রোডাক্ট প্লেসমেন্ট।
তার কৌশলটা অনেকটা এরকম। আপনার প্রিয় সিনেমা প্রিয় নায়ক কিংবা নায়িকা, নাটক সিরিয়ালের পছন্দের চরিত্র, কিংবা এক্ষেত্রে রান্নার অনুষ্ঠানের তারকা শেফ, এরা সিনেমা, নাটকে কিংবা রান্নার অনুষ্ঠানের মধ্যেই কিছু বিশেষ পণ্য ব্যবহার করবে, কিংবা সেই পণ্যের গুণগান করবে। যেমন সিনেমার নায়ক হয়তো কব্জি উল্টে কোনো একটা বিখ্যাত ব্র্যান্ডের ঘড়িতে সময় দেখলো, কিংবা নাটকের নায়িকা বিশেষ কোনো এক কোম্পানির কদুর তেল মাখতে বসলো, অথবা আপনার প্রিয় রান্নার অনুষ্ঠানের শেফ কোন একটা বিশেষ ব্র্যান্ডের গুঁড়া মসলার প্যাকেট থেকে তরকারিতে মসলা ছেড়ে দিলো। এই যে সিগারেট, কদুর তেল কিংবা মসলা যারা বানায়, তারাই সিনেমা, নাটক কিংবা টিভিওয়ালাদের পয়সা দেয় এগুলো তাদের অভিনেতা, অভিনেত্রী এবং উপস্থাপককে দিয়ে ব্যবহার করানোর জন্য। কেননা পণ্যের প্রচারণায় সরাসরি বিজ্ঞাপনের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি কার্যকরী এই প্রোডাক্ট প্লেসমেন্টের কৌশল।
একটা উদাহরণ দেই, পরিষ্কার হবে। হলিউডের বিখ্যাত জেমস বন্ড সিরিজের কথাই ধরুন।
জেমস বন্ডের ঘড়ির নাম কি?
রোলেক্স, ওমেগা।
গাড়ি কোনটা?
বিএমডব্লিউ, অ্যাস্টন মার্টিন।
আপনি কেমনে জানেন?
সিনেমায় দেখি।
এটাকেই বলেপ্রোডাক্ট প্লেসমেন্ট। আর পৃথিবীর নামকরা সব কোম্পানি সিনেমায়, নাটকে, টিভির অনুষ্ঠানে এ ধরনের লুকোনো বিজ্ঞাপনের জন্য লাখ লাখ নয়, কোটি কোটি ডলার খরচ করতেও রাজি হয়ে যায়। এমনকি প্রোডাক্ট প্লেসমেন্টের এক জাত ভাইও আছে, যাকে বলে সাবলিমিনাল ম্যাসেজিং। সেটা আরও জটিল এবং কঠিন এক বিষয়। মানুষের মনস্তত্ব নিয়ে খেলারসে এমন এক কৌশল, যেটা মানুষের অবচেতনে গিয়ে সরাসরি কোনো একটা পণ্যের নাম গেঁথে দেয়। মানে তখন আপনি মনের ভুলেও অন্য কোনো কোম্পানির পণ্য ব্যবহার করতে চাইবেন না, কেনাকাটা করার সময় শুধু সুক্ষ্ম কৌশলে আপনার মনের মধ্যে গেঁথে দেয়া পণ্যটাকেই খুঁজে পেতে নেবেন।
আপনি ভাবছেন, এ লেখক বলে কি? কই শাকিব খান আর কই সিঙ্গেল পান, জেমস বন্ডের সঙ্গে কেকা ফেরদৌসীর সম্পর্ক কি? সম্পর্ক অবশ্যই আছে। আর সেটা হলো তারা দুইজনই প্রোডাক্ট প্লেসমেন্টের মাধ্যম। তবে প্রোডাক্ট প্লেসমেন্ট কিন্তু খুবই উচ্চমার্গের শিল্প। অনেকটা পেইন্টিং এর মতন। কিন্তু ঠিকঠাক শিল্পী আর উপকরণ না পেলে চুনকাম আর পেইন্টিং এর ভেতরে যেমন কোনো পার্থক্য থাকে না, ঠিক সেরকম ঠিকঠাক মতন করা না গেলে প্রোডাক্ট প্লেসমেন্ট হয়ে যায় স্বস্তা নোংরামি। সেইটাই কেকা ফেরদৌসীর সঙ্গে ঘটেছে। সে কারণেই কেকা আপা আজ ‘কেকাপ্পা’।
বাংলাদেশের রান্নার অনুষ্ঠানগুলো যদি একটু খেয়াল করেন তাহলেই দেখবেন এ ধরনের প্রোগ্রামের একজন টাইটেল স্পন্সর থাকে। মানে ‘ওমুক মসলা রান্নাঘর’, ‘তমুক তেল পুষ্টিকর রান্না’ ইত্যাদি। যেহেতু তাদের পণ্যই হচ্ছে খাদ্য, তাই স্বাভাবিকভাবেই অনুষ্ঠানের নামের মধ্যেই সেটা আর সীমাবদ্ধ থাকে না চলে আসে রান্নার মধ্যেও। অর্থাৎ ‘ওমুক মসলা রান্নাঘর’ অনুষ্ঠানে আপনি যা রাধতে দেখবেন তার সবটাই রান্না করা হবে ‘ওমুক কোম্পানির’ মসলা দিয়েই। ‘তমুক তেল পুষ্টিকর রান্নায়’ যতই পুষ্টিকর রান্না দেখানো হোক, সেখানে গল গল করে বোতল থেকে তেল পড়বে তমুক কোম্পানিরই। এ থেকে আপনার নিস্তার নাই। কেননা চ্যানেলের কাছ থেকে অনুষ্ঠানের পুরো স্বত্ত্ব কিনে নিয়েছে তারা। সুতরাং সেখানে যেটা যেভাবে করতে মন চায়, সেটা সেভাবে করার অধিকারও কেবল তাদের হাতেই থাকে। আর টিভি চ্যানেলেরতো পকেটে পয়সা ঢোকা নিয়ে কথা। দর্শককে কি দেখানো হলো, তার মান কি হলো না হলো এগুলো নিয়ে তাদের মাথাব্যথা একদমই নেই। এসব ব্যাপারে ‘ক্রিয়েটিভিটি’র কথা বললে খুব সম্ভবত উনারা আকাশ থেকে পড়বেন। কেনন সে বস্তু যে কি, ওটা খায় নাকি মাথায় দেয়, টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ ওগুলো পাত্তা দেয়া ছেড়েছেন বহু আগেই। তাদের একমাত্র দায়বদ্ধতা এবং বিশ্বস্ততা থাকার কথা ছিলো দর্শকদের প্রতি। অথচ টিভি চ্যানেলগুলোর শতভাগ বিশ্বস্ততা স্রেফ এবং স্রেফ বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রতি।
যে অনুষ্ঠান বানানো হচ্ছে তাতে দর্শক বিনোদন পেলো কি পেলো না, সেখানে আদৌ দর্শকের দেখার মতো কিছু আছে কি নেই, এসব তারা ভাবেন না। তাদের কাছে দর্শক মানেই ভেড়ার পাল, তাদের আবার ভালো মন্দের বোধ থাকে নাকি? তারা টিভির সামনে বসে থাকবে, যা দেখাবো তাই দেখবে। ব্যাস, হয়ে গেলো।
আর তখনই নুডুলসের আচার, নুডুলস দিয়ে বেগুনের কোপ্তা- ইত্যাদি উদ্ভট বস্তুর আমদানি শুরু হয় এবং সেসব আমাদের গিলতে বাধ্য করা হয়। কেননা কেকা ফেরদৌসীর সেইদিনের অনুষ্ঠানের টাইটেল স্পন্সর নুডুলস কোম্পানির লক্ষ্য ছিলো একটাই, অনুষ্ঠানের পুরোটা জুড়ে তার নুডুলস দেখাতে হবে। টিভিওয়ালারা জ্বি হুজুর বলে সেটাই মেনে নিয়েছে। আর কেকা ফেরদৌসীও অনুরোধে ঢেঁকি গিলেছেন। নুডুলস দিয়ে যা নয় তা বানিয়ে দেখিয়েছেন তার অনুষ্ঠানে। এদিকে নুডুলস কোম্পানি তার বিজ্ঞাপন করে নিয়েছে, টিভি চ্যানেল লাভের গুঁড় খেয়ে হজম করে ফেলেছে, আর মাঝখান দিয়ে নিজেকে চূড়ান্ত রকমের হাস্যকর প্রমাণ করে আজও ক্রমাগত ট্রলের শিকার হয়ে চলেছেন কেকা ফেরদৌসী।
মূলধারার গণমাধ্যমের লোকজন একটা জায়গায় বার বার ভুল করছেন। এখন আর একচেটিয়া তাদের দিন নেই। সোশ্যাল মিডিয়ার যোগযোগ সারা পৃথিবীকে এনে দিচ্ছে এক ছাদের তলায়। সেখানে মামুলি একটা বোকা বাক্সের সামনে আটকে থাকার যথেষ্ট কারন যোগাতে না পারলে দর্শক ওখানে আটকে থাকবে না। আর তাদের বিশ্বস্ততা যদি দর্শকের প্রতি না ফিরে কেবলমাত্র বিজ্ঞাপনদাতা আর তাদের পণ্যের উপরেই লেপ্টে থাকে তাহলে সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন চ্যানেলে তালা ঝুলিয়ে, বাড়িতে গিয়ে নুডুলসের আচারই রেধে খেতে হবে।
লেখক: জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ
মন্তব্য করুন