৪৬ বছর পর বীরঙ্গনার স্বীকৃতি জামালপুরের পাঁচ নারীর

দুলাল হোসাইন, জামালপুর
 | প্রকাশিত : ০৭ আগস্ট ২০১৭, ২১:৩৮

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে রেকি করে পাক বাহিনীর অবস্থানের সংবাদ সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার পাঁচ নারী। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর পৌঁছে দিতে গিয়ে পাক বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে নির্যাতন ও সম্ভ্রম হারানোর শিকার হন ওই পাঁচ সাহসী নারী। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর তারা বীরঙ্গনার স্বীকৃতি পেয়েছেন।

বীরঙ্গনার স্বীকৃতি পাওয়া নারীরা হলেন, জেলার ইসলামপুর উপজেলার চরপুটিমারী ইউনিয়নের চিনারচর গ্রামের মো. ভোলা শেখের স্ত্রী মোছা. রংমালা খাতুন, একই গ্রামের মাহফুজুল হকের স্ত্রী সামছুন্নাহার বেগম এবং কুলকান্দি ইউনিয়নের কুলকান্দি গ্রামের জসিজলের স্ত্রী রাবেয়া বেগম, মৃত আ. সামাদ খানের স্ত্রী ছকিনা বেগম ও আ. রহিমের মেয়ে শেফালী বেগম।

ইসলামপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম আহসানুল মামুন জানান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৫ জুন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইনে ৪৪তম সভার সিদ্ধান্তক্রমে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে এই পাঁচ নারীকে বীরঙ্গনার স্বীকৃতি দিয়েছে। এখনো সরকারি প্রজ্ঞাপন আমাদের কাছে এসে পৌঁছেনি। পৌঁছলে এই পাঁচ বীর সেনানী সাহসী নারীকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনা ও বরণ করে নেয়া হবে।

স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর হলেও সাহসী সেই নারীরা বীরঙ্গনা স্বীকৃতি পাওয়ায় তাদের চোখেমুখে তৃপ্তির কান্না লক্ষ্য করা গেছে। যমুনাপাড়ে ইসলামপুর উপজেলার কুলকান্দি ইউনিয়নে তিনজন বীরাঙ্গনার খোঁজে গিয়ে সেখানে পাওয়া যায়নি। নদী ভাঙনের কবলে পড়ে বাড়িঘর নদীগর্ভে হারিয়ে মাথা গুজার ঠাঁই করে নিয়েছেন পার্শ্ববর্তী পার্থশী ইউনিয়নের শাশারিয়া খানপাড়া গ্রামে। সেখানে দেখা হয় রাবেয়া বেগম, ছখিনা বেগম ও শেফালী বেগমের সাথে। বয়সের ভারে তিনজনই নুব্জ হয়ে পড়েছেন। সমাজের তিরস্কার, জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করে আজও বেঁচে আছেন কোনোমতে। দরিদ্রতা তাদের গ্রাস করে খাচ্ছে। দিন কাটছে অর্ধাহারে অনাহারে।

বীরাঙ্গনা শেফালী বেগম ঢাকাটাইমসকে বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বিয়ের কথা চলছিল। এ সময় বদরদের সহযোগিতায় হঠাৎ বাড়িতে পাকবাহিনী এসে আমার বাবা নুরু খানকে বেঁধে নিয়ে যায়। এ সময় অন্যরা আমাকে আমার বাড়িতেই শারীরিক নির্যাতন করে।

একই অবস্থা রাবেয়ার। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, নিজ বাড়িতেই আমাকে আটকিয়ে রেখে দিনের পর দিন আলবদর, রাজাকাররা আমার উপর অমানুষিক নির্যাতন করেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমার বিয়ে হয়। সেই দিনের দুঃসহ্য স্মৃতি নিয়ে আজও বেঁচে আছি।

ছখিনা বেগমের স্বজনরা জানান, ছখিনা এলাকায় নেই। লোকলজ্জার ভয়ে পরিচয় গোপন করে টাঙ্গাইলে বাসাবাড়িতে ঝিঁয়ের কাজ করছে। যুদ্ধ চলাকালে বর্তমান কুলকান্দি শহীদ স্বৃতি স্কুল মাঠে একদিনে এলাকার ১১জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। তার মধ্যে ছখিনার স্বামী সামাদ খানও রয়েছেন। সামাদ খানকে হানাদার বাহিনীরা ধরে নিয়ে যাওয়ার দিন ছখিনা বেগম ৪০ দিন আগে সন্তান প্রসব করেছেন। এ অবস্থাতেও তাকে নির্যাতন থেকে রেহায় দেয়নি রাজাকার আলসামস ও পাকবাহিনীরা। নির্যাতন ও সম্ভ্রমহানীর সময় ছখিনার কানে খবর পৌঁছে তার স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ। তার পরিবারের লোকজন আরও বলেন, সামাদ খানকে আজও শহীদের মর্যাদা দেয়া হয়নি।

ইউপি সদস্য তাহের খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, আমাদের এখানে শহীদ স্মৃতি স্কুলে পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। এসব এলাকার রাজাকার আলবদরদের সহযোগিতায় বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে নারীদের নির্যাতন ও পুরুষদের স্কুলে নিয়ে নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলেছে। অনেকেই আজও কোনো স্বীকৃতি পায়নি। তাদের স্বীকৃতির দাবি জানাই।

চিনারচর গ্রামের বীরঙ্গনা সামছুন্নাহার ঢাকাটাইমসকে বলেন, যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দেয়ার সময় আল বদরেরা আমাকে দেখিয়ে দেয়। এ সময় আমাকে ঝগড়ারচর ক্যাম্পে নিয়ে আটকিয়ে রাখে এবং অমানুষিক নির্যাতন চালায়। যখন আমি মৃত্যুশয্যায় ঠিক সেই সময় আমাকে ছেড়ে দেয়। তার কয়েকদিন পরেই দেশ স্বাধীন হয়।

একই গ্রামের রংমালা খাতুন ঢাকাটাইমসকে বলেন, যুদ্ধের কিছুদিন আগে আমার বিয়ে হয়। নববধূ অবস্থায় পাক বাহিনীরা আমাকে ধরে নিয়ে যায় ঢাকার কেরানীগঞ্জ ক্যাম্পে। সেখানে আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এক সময় কৌশলে আমি পালিয়ে আসি।

চরপুটিমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সামসুজ্জামান সুরুজ মাস্টার ঢাকাটাইমসকে বলেন, সরকার তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। সব ব্যবস্থা যাতে দ্রুত বাস্তবায়ন হয় সে দাবি জানাই। শেষ বয়সে তারা যাতে একটু শান্তিতে থাকতে পারে।

ইসলামপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মানিকুল ইসলাম জানান, বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধের সহায়ক সরকার। পাঁচ বীরাঙ্গনাকে স্বীকৃতি তারই প্রমাণ। তাদের ত্যাগ বৃথা যায়নি। শেষ বয়সে তারা যাতে ভালোভাবে চলতে পারে সে দিকে দৃষ্টি রেখে দ্রুত সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার আহ্বান জানান তিনি।

স্থানীয় সাংসদ ফরিদুল হক খান দুলাল ঢাকাটাইমসকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ১৫ জনকে বীরঙ্গনার স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার মধ্যে ইসলামপুরের পাঁচজন। তারা আমাদের গর্বিত জননী। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ইসলামপুরবাসীর পক্ষ থেকে দ্রুত তাদের প্রাপ্য সম্মান দেয়া হবে।

(ঢাকাটাইমস/০৭আগস্ট/প্রতিনিধি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :