বড্ড দেরি হয়ে গেছে স্যার তবু অভিবাদন

জাহিদ আনোয়ার
 | প্রকাশিত : ০৮ মার্চ ২০১৮, ২০:০২

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ অর্জন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। তাই তো মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। আমাদের হৃদয়ে, আমাদের অস্তিত্বে, আমাদের রক্তে বহমান। আজ থেকে ৪৭ বছর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। মুক্তিসংগ্রামের সেই যুদ্ধে প্রাণ দিতে হয় ৩০ লাখ মানুষকে। সম্ভ্রম হারায় তিন লাখ মা-বোন। স্বাধীনতার জন্য এত স্বল্প সময়ে পৃথিবীতে কোনো জাতি এত ত্যাগ স্বীকার করেছে বলে ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায় লাল সবুজের বাংলাদেশ।

বাঙালির রয়েছে আরেক বীরত্বের ইতিহাস। পাকিস্তানিরা মায়ের মুখের ভাষা বাংলাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল। প্রতিবাদে ১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। উত্তাল ঢাকার রাজপথে পাকিস্তানিদের বুলেটে প্রাণ উৎসর্গ করেন সালাম বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেকে। আদায় হয় বাংলা ভাষার স্বীকৃতি। ভাষার জন্য পৃথিবীতে কোনো জাতি প্রাণ দিয়েছে বলে জানা নেই। পাকিস্তান নামক অভিশপ্ত একটি দেশের শাসকদের শোষণ-বঞ্চনা-অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালির আত্মত্যাগ ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে থাকবে।

কিন্তু স্বাধীনতার ৪৮ বছর হতে চলল, নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে না বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস, বাঙালির বিরত্বের ইতিহাস, আত্মত্যাগের ইতিহাস। মাতৃভাষা বাংলা হলেও ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ সম্পর্কে তারা ভালোভাবে জানতে পারেনি। এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জা আর অপমানের। অথচ ভাষা ও স্বাধীনতার জন্য বাঙালির এত প্রাণ বিসর্জন, এত রক্ত, এত আত্মত্যাগ পৃথিবীতে কোনো জাতি করেনি।

স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৮ বছরে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সব শিক্ষার্থীর জন্য ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ পড়ানো হয়নি। স্কুল-কলেজেও পড়ানো হয়নি। যে কারণে আজকের তরুণ প্রজন্ম জানে না তার জন্মের ইতিহাস, তার পূর্বপুরুষের আত্মত্যাগের ইতিহাস, বীরত্বের ইতিহাস। তবে ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের কল্যাণে স্বাধীনত-মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়ানো শুরু হয়েছে। সারা বিশ্বের ন্যায় অপসংস্কৃতি যেমন আমাদের তরুণ প্রজন্মকে গ্রাস করছে, তেমনি দেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক শক্তি, জঙ্গিবাদ এবং মৌলবাদের উত্থান, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কুচক্রী শকুনদের ষড়যন্ত্র, মানবতাবিরোধী বিচারের বিরোধিতা, নীতি বিবর্জিত কর্মকা-, নৈতিকতার অবক্ষয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর মূল কারণ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব।

স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি কুচক্রীর ষড়যন্ত্রে ঘাতকের হাতে প্রাণ দিতে হয় বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের। এই হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দানবরা প্রায় তিন যুগ ক্ষমতার মসনদে বসে শীর্ষ থেকে নি¤œ পর্যন্ত দাপাদাপি করে বেড়িয়েছে। রাষ্ট্রীয় মদদে প্রশাসন, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজে ঘাঁটি গেড়ে বসে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী। এ সময়ে কার সাহস ছিল প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়া? জন্মের ইতিহাস না জানা জাতি কীভাবে দেশপ্রেমে জাগ্রত হবে? দেশের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? তারা তো জানে না স্বাধীনতার জন্য তার পূর্বপুরুষদের আত্মত্যাগের ইতিহাস, বীরত্বের ইতিহাস।

৭৫-র পরে জন্ম নেয়া শিশুটি জন্ম থেকেই প্রতারিত। নিষ্পাপ শিশুটির কী অপরাধ ছিল? কবির ভাষায় বলি ‘জন্মই যেন আজন্ম পাপ’। বারবার শাসক গোষ্ঠী স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা লাল-সবুজ পতাকা তুলে দিয়ে শহীদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করছে। মুক্তিযুদ্ধের সুমহান গৌরবগাঁথা আদর্শের সাথে প্রতারণা করেছে। জাতি হিসেবে এ লজ্জা আমরা লুকাব কোথায়? লজ্জায় আমাদের মাথা নিচু হয়ে যায়। আমরা তরুণ প্রজন্ম স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রী শকুনদের থাবায় বারবার ক্ষত-বিক্ষত। তারা এখনো সুকৌশলে আমাদের অস্তিত্বে আঘাত হানছে, ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে, যা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তাদের এ অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। তাদের ষড়যন্ত্র রুখতে না পারলে এ লজ্জা সমগ্র জাতির, আমাদের সবার।

আমরা কার কাছে এর জবাব চাইব? কার কাছে বিচার চাইব? এর জবাব অবশ্যই একদিন দিতে হবে তরুণ প্রজন্মের কাছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালনার দায়িত্ব কি শুধু স্বাধীনতায় নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের? না, এ দায়িত্ব দেশের ১৭ কোটি মানুষের। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবার। আমরা সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছি। তাহলে কেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কিছু মানুষের জন্য সমগ্র জাতিকে এত মূল্য দিতে হবে? মানুষ কেন তার জন্মের ইতিহাস জানতে পারবে না? আজ সময় এসেছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ এবং ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ ছড়িয়ে দেয়া। এ দুটি বিষয়ের সাথে জড়িত আমাদের আত্মা, আমাদের রক্ত, আমাদের ভালোবাসা।

চারদিকে যখন স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্র চলছে, ঠিক এমন সময় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একটি সিদ্ধান্ত আমাদের আশান্বিত করেছে। যেন অন্ধকার গুহায় মিটিমিটি করে জ্বলা আলোটি হঠাৎ ধপ করে জ্বলে উঠল। সেই আলোয় আলোকিত হবে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সব বিভাগের শিক্ষার্থীর জন্য ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ এবং ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ নামের দুটি কোর্স বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যুগান্তকারী ও ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ইউজিসিকে অভিবাদন। লাখো-কোটি অভিনন্দন ইউজিসির মাননীয় চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর আব্দুল মান্নান স্যারকে।

কিন্তু স্যার বড্ড দেরি হয়ে গেছে। কুচক্রী শকুনরা ইতিমধ্যে পরিকল্পিতভাবে দেশের অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলেছে। প্রশাসন যন্ত্র, ব্যবসা এবং সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তকারীরা ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। যদি ইউজিসি অনেক আগেই এ সিদ্ধান্ত নিতে পারত তাহলে হয়তো দেশকে এত চড়া মূল্য দিতে হতো না, দেশের এত বড় ক্ষতি হতো না। তবু না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়াও ভালো। এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে। তরুণ প্রজন্মের জন্য এর চেয়ে আনান্দের বিষয় আর কী হতে পারে!

আমাদের তরুণ প্রজন্ম আবার ৭১-এর মতো দেশেপ্রেমে মেতে উঠবে। আগামী দিনের বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে এই তরুণসমাজ। তারুণদের হাতেই গড়বে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। বাংলাদেশ হবে অসাম্প্রদায়িক, উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। তাহলেই হয়তো স্বাধীনতার জন্য যারা আত্মত্যাগ করেছেন, প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, তাদের আত্মা শান্তি পাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :