আজীবন সংগ্রামী মওলানা ভাসানী

অজয় দাশগুপ্ত
 | প্রকাশিত : ১৭ নভেম্বর ২০১৮, ১৭:১৪

আজ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যু দিবস। ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর তার মৃত্যুর সময়ে দেশে ছিল সামরিক শাসন। এটা নিষ্ঠুর পরিহাসই বটে। তিনি আজীবন লড়েছেন গণতন্ত্রের জন্য, মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য। পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসকরা তাকে ভয় করতেন। কিন্তু তার মৃত্যুর সময়ে দেশে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ শুধু নয়; গুরুতর অপরাধ ছিল। ষাটের দশকের শেষদিকে যখন পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার জন্য স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফা কর্মসূচি প্রদানের কারণে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে বন্দি করা হয়, তখন অনেকের সংশয় ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রহসনের বিচারে তাকে মৃত্যুদ- দেওয়া হবে না তো? জেলে নির্জন প্রকোষ্ঠে বন্দি বঙ্গবন্ধুরও এ উদ্বেগ ছিল। তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে স্থাপিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সংবাদ সংগ্রহের জন্য নিয়মিত সেখানে যাওয়া সাংবাদিকদের মাধ্যমে খবর পাঠালেন- ভাসানী সাহেবকে অনুরোধ করবেন আমার মুক্তির জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে। তখন দুজনে ভিন্ন দুটি দলের প্রধান নেতা। এক সময়ে তারা এক দলে ছিলেন- প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরে আওয়ামী লীগ। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ গঠন করেন। দুই দলের সম্পর্ক কখনও কখনও বৈরী ছিল, কখনও-বা এসেছে কাছাকাছি। কিন্তু দুই নেতার সম্পর্কে সেটা চিড় ধরাতে পারেনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থ লিখেছেন ষাটের দশকে জেলে বন্দি থাকার সময়ে। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। সে সময়েই তিনি পঞ্চাশের দশকের মওলানা ভাসানীর একটি কাজে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। সে সময়ে তারা এক দল অর্থাৎ আওয়ামী মুসলিম লীগ করতেন। কিন্তু এ ঘটনার এক যুগ অতিক্রমের পর যখন তিনি এ বিষয়ে লিখছেন তখন তারা দুটি দলে রয়েছেন। কিন্তু জনগণের নেতার প্রতি শ্রদ্ধায় এতটুকুও ঘাটতি নেই। অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে আমরা এভাবে জানতে পাই-

‘... আমি বুঝতে পারলাম মওলানা ভাসানীর উদারতার অভাব, তবুও তাকে আমি শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। কারণ তিনি জনগণের জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত। যে কোনো মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোনো ভালো কাজ করতে পারে না- এ বিশ্বাস আমার ছিল।’

কিছু দিন আগে টাঙ্গাইলের সন্তোষ এলাকায় মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ওই এলাকাতেই ছিল মওলানা ভাসানীর যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকা-ের কেন্দ্র। পঞ্চাশের দশকে যে ঐতিহাসিক ‘কাগমারী সম্মেলন’-এর কথা আমরা শুনি, সেটা ওই এলাকাতেই হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠান পর সেখানকার সচ্ছল হিন্দু পরিবারগুলো জমি-বাড়ি-ব্যবসাসহ সবকিছু ফেলে ভারত চলে যায়। আমরা যে সম্পত্তিকে অর্পিত বা শত্রু সম্পত্তি বলে জানি, এ সম্পত্তি ছিল সে ধরনের। টাঙ্গাইলের অনেক রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তি যে যেভাবে পেরেছেন ‘শত্রু সম্পত্তি’ নিজের নামে করে নিয়েছেন। মওলানা ভাসানী চাইলে শত শত একর জমি নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তো সে পথে চলেননি। চলতে চাননি। সন্তোষের জমিদারবাড়ির একটি অংশে তিনি স্থাপন করলেন বিশ্ববিদ্যালয়, যা এখন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে আরও রয়েছে স্কুল-কলেজসহ অনেক প্রতিষ্ঠান। এমনকি ফুল ও ফলের গাছের নার্সারিও রয়েছে। আরও আছে পশু চিকিৎসা কেন্দ্র। সবই আমজনতার জন্য। সেখানে হুজুর হিসেবে সবার কাছে পরিচিত মওলানা ভাসানীর নিজের দখলে কেবল ছোট্ট এক খ- জমি, যেখানে তিনি ও তার স্ত্রী আলেমা ভাসানী চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন।

মওলানা ভাসানী পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এ দলটি গড়ে তোলেন এবং দ্রুতই দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃত হয়। একই সঙ্গে তিনি কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য উদ্যোগী হন। এ কাজে তিনি কমিউনিস্টদের সহযোগিতা পেয়েছেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মনোনীত হন ভাসানী। সে সময়ে চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করছিল। তিনি চীনের নেতা মাও সে তুংয়ের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন তাদের অবস্থান পরিবর্তনের জন্য। ১৯৭৬ সালে মৃত্যুর মাত্র ছয় মাস আগে ১৬ মে তিনি ফারাক্কা বাঁধ চালুর প্রতিবাদে মিছিল করেছিলেন ভারতের কাছ থেকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য।

লেখক: সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :