মুর্তজা বশীরশূন্য বিষন্ন বাংলাদেশ

হা মীম কেফায়েত, চিত্রশিল্পী
  প্রকাশিত : ১৫ আগস্ট ২০২০, ১৪:৫০| আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০২০, ১৪:৩০
অ- অ+

আজিজ মার্কেটের সামনে একদিন আপেল কিনতেছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন হুমায়ুন আজাদ, কার সঙ্গে যেনো কথা বলছিলেন। কেনা শেষ হলে গিয়ে আপেল হাতে নিয়ে সালাম দিলাম। বললাম, স্যার আপেল খান? উনি জবাব দিলেন ‘না, খাইনা’। আমি বললাম, তাইলে আমার লগে কথা কন।

এরপর নামধাম জিগেস করে উনি আমার সঙ্গে কথা বলা শুরু করলেন। ছবি আঁকি জেনে তিনি বললেন, ‘শিল্পীরা তো আগে ভালো ছিলো, এখন খারাপ হয়ে গেছে- মুর্তজা বশীর নাকি হজে যাবে’।

পরে একদিন তার ফার্মগেটের বাসায় গিয়ে গল্পগুজবের ফাঁকে মুর্তজা বশীরকে হুমায়ুন আজাদের কথাটা বললাম। মুর্তজা বশীর অট্টহাসি দিয়ে বললেন, ‘আর বইলো না। ও খুব দুষ্টুমি করে। একদিন আমি বাংলা একাডেমি থেকে বের হচ্ছি আর ও ঢুকছিলো। দূর থেকেই বললো, বশীর ভাই আপনার টুপি কোথায়’?

মুর্তজা বশীর শিল্পকলা একাডেমীতে একটা একক ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী করেছিলেন, সম্ভবত ২০০২ সালে। সেই প্রদর্শনী নিয়ে লিখেছিলাম, সেটাই ছিলো আমার জীবনের প্রথম প্রকাশিত লেখা। সেই পরিচয়ের পর থেকেই তার সঙ্গে আমার ভালো যোগাযোগ তৈরি হয়। সেই সময়টা ছিলো চট্টগ্রামে মুর্তজা বশীরের শেষ সময়।

তারপর তিনি ঢাকায় এলেন, পেনশনের টাকাসহ মিলঝিল করে ফার্মগেটের পাশে কনকর্ডের ফ্ল্যাট কিনলেন। ওসমানীতে এক বিয়েন্নালের উদ্বোধনীতে তার সঙ্গে দেখা হলো, সঙ্গে ছিলেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম। আমাকে বাসার ঠিকানা দিয়ে যেতে বললেন।

প্রথম যেদিন বাসায় গেলাম, সেদিন বললেন- ‘ঢাকার ঠিকানায় আমার ভিজিটিং কার্ড নেই, তুমি কি করে দিবে’? আমি বললাম আচ্ছা। তারপর উনি বললেন, ‘পয়সা নিতে হবে’। আমি রাজি হলাম। পরের বার ভিজিটিং কার্ড নিয়ে গেলাম, উনি কার্ড হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে কচকচে কয়েকটা নোট ধরিয়ে দিলেন।

তারপর থেকে তার বাসায় আমার যাতায়াতটা নিয়মিত হয়ে গেলো। লম্বা একটা টাইম তার বাসায় যাতায়াত করতাম, খুব খুশী হতেন। অনেক্ষণ আমাকে গল্পের মধ্যে ধরে রাখতেন।

উনি সবসময় ফুরফুরে মেজাযে থাকতেন। মাঝেমধ্যে অতিমাত্রায় ফুরফুরে দেখলে কারণ জিগেস করতাম। বলতেন, ওমুকে এসে একটা ছবি নিয়ে গেল ১ লাখ টাকা দিয়ে গেলো।

মীর নাছির একবার বিএনপির মনোনয়ন পাচ্ছিলেন না। তখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে মুর্তজা বশীরকে অনুরোধ করেছিলেন খালেদা জিয়াকে সুপারিশ করার জন্য। মুর্তজা বশীরের সুপারিশে সেবার মীর নাছির মনোনয়ন পেয়েছিলেন।

স্যারকে একদিন জিগেস করেছিলাম, ঢাকা ছেড়ে তিনি কেনো চট্টগ্রামে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। উনি খুব কষ্ট নিয়ে বলেছিলেন, শিল্পাচার‌্য ইচ্ছে করেই তাকে ঢাকায় নেননি। এই নিয়ে তার প্রচণ্ড মনোকষ্ট ছিলো।

আমার দেশ-এ থাকতে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে একটা ম্যাগাজিনের কাজ করতেছিলম। মুর্তজা বশীরকে ধরলাম লেখার জন্য। উনি গোল্ডলিফে আগুন দিতে দিতে বললেন ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত কোনো গান হলো? আমি তো শুনি জ্যাজ’...

বাংলাদেশ আর্ট নামে একটা বই করেছিলো এসপিবিএ, ১৫/১৬ বছর আগে। খুবই এলিগ্যান্ট একটা বই, সম্পূর্ণ ইংরেজিতে করা। দেশের চারুশিল্পকে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষে কাজটি করেছিলেন উদ্যোক্তারা। বইটির বাংলাদেশমূল্য ছিলো পাঁচ হাজার টাকা। পাঁচ তারকায় জমকালো এক উদ্বোধনও হয়েছিলো। শিল্প করেন, খোঁজ রাখেন, ভালবাসেন এমন সবাই একত্রিত হয়েছিলো সেই উদ্বোধনে, কেবল ছিলেন না শিল্পী মুর্তজা বশীর। দেশের শিল্পকে আন্তর্জাতিক মহলে জানান দেওয়ার আয়োজন, অথচ মুর্তজা বশীর নেই, হাস্যকর ঠেকলো ব্যাপারটা। পরে দেখলাম পুরো বইয়ের কোথাও মুর্তজা বশীরের নাম নেই, সুবাস-গন্ধও নেই।

জয়নুল আবেদিন, সুলতান, শাহাবুদ্দিন তো ছিলেনই, সাথে যারা ন্যাশনাল আর্ট এক্সিবিশনে দুদিন ধরে পুরস্কার জিতছেন, তাদেরও বিশাল আয়োজন দেখলাম বইটিতে। পরিচিত-অপরিচিত সব শিল্পীদের চেহারায় একটা পুলকিত ভাব দেখা গিয়েছিলো সেদিন। বইটিতে শিল্পী বাছাই কমিটির প্রধান ছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, যিনি মুর্তজা বশীরের চেয়ে বয়সে ছোট এবং পরস্পরের সম্পর্কও আন্তরিক বন্ধুত্বপূর্ণ বলে জানি। চৌধুরী সাহেব উদ্বোধনী বক্তৃতায় ও বইয়ের ভূমিকায়ও মুর্তজা বশীর প্রসঙ্গটি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন।

পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম আয়োজকরা মুর্তজা বশীরের কাছে গিয়েছিলো তথ্য-উপাত্তের জন্য। শিল্পী তাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন :

-'বইটি কেন করবে?

-দেশের চারুশিল্পকে বিশ্বদরবারে জানান দেওয়ার জন্য!

-লোকজনকে কি বিনামূল্যে বিতরণ করবে?

-না, মূল্য বিনিময় থাকবে?

-নরওয়েজিয়ানরা তো টাকা দিয়েছে, তারপরও কেনা পয়সা নেবে?

-বাণিজ্য করবো!

-আমার ছবি ছাপবে, বাণিজ্য করবে, আমাকে পয়সা দিবা?

-না!

-তাহলে আমিও তোমাদেরকে ছবি দেবো না, তথ্য-উপাত্তও না।'

নরওয়ের মোটা টাকা, এলিট ক্লাসের কিছু স্পন্সর নেবার পরও সেই এনজিও শিল্পীদেরকে কোনো টাকাই দিলো না। বুঝে নিলাম, টাকা অন্যেরা চায়নি। শিল্পী হলেই যে আত্মমর্যাদাবোধ থাকবে, এমন তো সব সময় হয় না। তবে মুর্তজা বশীর যেহেতু টাকা চেয়েছিলেন, তাকে কিছু টাকা দিয়ে ম্যানেজ করলে ক্ষতি কী ছিলো? আসলে ধান্ধাবাজরা অলওয়েজ ধান্ধাবাজ, শিল্পের সাথে চাল-ডালের পার্থক্য করাটা তাদের ধাতে নেই, এর বাইরে সহজে তারা যেতেও পারে না। কিন্তু কাইয়ুম চৌধুরীর মতো একজন মানুষ কীভাবে পারলেন মুর্তজা বশীরকে এড়িয়ে যেতে, বুঝেই আসে না।

মুর্তজা বশীরের মতো শিল্পীর আন্তর্জাতিক মহলে পৌঁছতে বই-এনজিওর অনুকম্পা লাগে না, জানি। এখনকার বিখ্যাত বাংলাদেশের শিল্পীরা যখন বিদেশটাকে ভাবতে শিখেনি, তার আগেই বিদেশটাকে জয় করেছিলেন তিনি, প্যারিস-ফ্লোরেন্স এখনও মুর্তজা বশীরকে বুকে ধারণ করে আছে। আসলে 'মুর্তজা বশীরশূন্য বিষন্ন একটি বই' বিশ্ববাজারে পৌঁছে দিয়ে দেশের শিল্প ও শিল্পীদেরকে ছোটই করেছি আমরা, বড়ো তো করি-ই-নি...।

মুর্তজা বশীরের বাবা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একদা বলেছিলেন- যে দেশে গুণীর সমাদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না।

আবুল কালাম শামসুদ্দীন একবার ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি শিক্ষিত মানুষ হয়ে কেন এতগুলো সন্তান নিলেন? কিছুক্ষণ চুপ থেকে শহীদুল্লাহ সাহেব বলেছিলেন ‘আমি এতগুলো সন্তান না নিলে মুর্তজা বশীর হতো না, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি এতগুলো সন্তান না নিতেন তাহলে রবীন্দ্রনাথকে পেতাম কোথায়’?

শিল্পী মুর্তজা বশীর একটা কথা বলতেন— `আমরা যে বেঁচে আছি, এটাই মিরাকল'...

সেই মুর্তজা বশীর আজ চলেই গেলেন।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে মহাকালিক অর্জন, তার বড় অংশজুড়েই থেকে যাবেন মুর্তজা বশীর। একাই তিনি একটা সংস্কৃতি, একটা কৃষ্টি এবং একটা দর্শন। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিলো বাংলাদেশের একেকটি উড্ডয়ন। তিনি বাংলাদেশকে যেভাবে আদরে-আপ্যায়নে রেখেছেলেন, সেই অর্থে অমরা তার জন্য কিছুই করতে পারিনি। শেষ বছরগুলোতে তিনি মাঝেমধ্যেই অর্থকষ্টে পড়ে যেতেন। ইসলামী বাংকের সঙ্গে ঘনিষ্ট আমার এক বন্ধুকে তিনি একবার বলেছিলেন কিছু পয়সা অনুদান হিসেবে এনে দেয়ার জন্য। পরে আমার বন্ধু তার সেই উপকারটি করেছিলেন। (পয়সাটা ইসলামী ব্যাংক এমনি দিয়েছিলো নাকি ছবির বিনিময়ে দিয়েছিলো, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত জানি না।)

মুর্তজা বশীর যখন আরমানিটোলা স্কুলে পড়তেন, তখন সর্বত্র জুতো পরার সংস্কৃতি ও সামর্থ মানুষের ছিলো না। অধিকাংশ বাচ্চারাই খালি পায়ে স্কুলে যেতেন, মুর্তজা বশীর তখন স্কুলে যেতেন মুজাসমেত জুতা পরে, গাড়ীতে চড়ে।

সেই মুর্তজা বশীরকে ইসলামী বাংকের টাকার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছিলো, এটাকে আমি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্লজ্জ অপারগতাই মনে করি।

আজ থেকে আমাদের দেশটা 'মুর্তজা বশীরশূন্য বিষন্ন বাংলাদেশ'।

(সুলতানের সঙ্গে মুর্তজা বশীরের ছবিটাই ব্যবহার করলাম। কারণ, বাংলাদেশের একজন শিল্পীর নাম বলতে বললে আমি সুলতানের নাম বলি, দুইজনের নাম বলতে বললে আমি বলি এসএম সুলতান ও মুর্তজা বশীর।)

লেখক: চিত্রশিল্পী

ঢাকাটাইমস/১৫আগস্ট/এসকেএস

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
হাতিরপুলে গণসংহতি আন্দোলনের কার্যালয়ের সামনে দুই ককটেল বিস্ফোরণ
৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ১৬৯০ জন
এনসিপির ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি শুরু
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও যোদ্ধাদের স্মরণে ‘বিআরপি’র মশাল মিছিল
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা