বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জয়যাত্রা

ইলিয়াস সানি
| আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২১, ১৩:৫০ | প্রকাশিত : ১৬ মার্চ ২০২১, ০৮:১৪

বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ প্রাপ্তির মহানায়ক, বাঙালির আশীর্বাদিক পুরুষ, শত সহস্র বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিব। ১৯২০ সালের স্পেনিশ ফ্লু তে সারাবিশ্ব যখন টালমাটাল, ঠিক তখনই ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার জনক, বিশ্ব শান্তির জন্য অন্যতম পথিকৃৎ মহাত্মা গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেন এই বছরেই। ঠিক সেই বর্ষেই, বাঙালির প্রাণের দাবি স্বাধীনতার বীজও রোপিত হয় টুঙ্গিপাড়ার পবিত্র ভূমিতে।

বাঙালির রাখাল রাজা, শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি ও বাংলাদেশের মুক্তির মশাল হাতে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ (৩ চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দ) রাত ৮টায় তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের বাইগার নদী তীরবর্তী টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

নতুন ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে খুব অল্প বয়সেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান জানান দিতে শুরু করেন শেখ মুজিব। ১৯২৭ সালে শিক্ষাজীবন শুরুর মাধ্যমে নেতৃত্বে প্রস্ফুটিত আত্মা নিজেকে শাণিত করতে থাকেন প্রতিটি প্লাটফর্মে স্বীয় যোগ্যতায়।

১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। একই বছরে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে এই কলেজ থেকেই তিনি স্নাতক সম্পন্ন করেন।

১৯৪৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের (অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের শাখা) কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক লাইম লাইনে আসেন। ১৯৪৬ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওই বছরের ১৬ আগস্ট কুখ্যাত ক্যালকাটা কিলিং (সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা) শুরু হলে শেখ মুজিবুর রহমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং শান্তি বজায় রাখার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নিজের জীবন বাজি রেখে হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষদের জীবন রক্ষা করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগে, তার দায়িত্ব প্রশংসার সাথে পালন করেন।

১৯৪৭ সালেই ভারত এবং পাকিস্তানের পাশাপাশি তৃতীয় রাষ্ট্র হিসেবে স্বতন্ত্র, স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে আন্দোলনে যোগ দেন। যদিও এই উদ্যোগ বাতিল হয় কিন্তু পরবর্তীতে এটিই একজন জাতির পিতার স্বপ্নের রাষ্ট্র গড়ার ভিত্তি হয়ে ওঠে। অন্যান্যদের মতো ভারত ভাগের পরপরই শেখ মুজিবুর রহমান তড়িঘড়ি করে পূর্ববঙ্গে (পাকিস্তানে) আসেননি, বরং কয়েক সপ্তাহ তিনি কলকাতায় অবস্থান করেন, রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে মহাত্মা গান্ধীর শান্তি মিশনে যোগ দেন।

তারপরের ইতিহাস কার না জানা! ঢাকায় ফিরে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ৪ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদলীয় ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন।

নতুন উদ্যোমে শুরু করেন বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ বিনির্মাণের যাত্রা। ভাষা আন্দোলের নেতৃত্ব, কারাভোগের মাধ্যমে ইতিমধ্যে তিনি বাঙালির স্বপ্ন ছুঁয়ে যাওয়া গল্পের সারথি হয়ে উঠতে থাকেন। ঠিক এই অবস্থায়, ১৯৫৩ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। হয়ে উঠেন বাংলাদেশের জয়যাত্রার অগ্রনায়ক। তারপর ১৯৫৪ র যুক্তফ্রন্টের জয় লাভের মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, পরপর বেশ কয়েকবার পুনঃপুন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬'র ছয় দফা, ৬৮'র আগরতলা মামলা, ৬৯'র গণ-অভ্যুত্থান, ৭০'র নির্বাচন, একাত্তরের ৭ মার্চ এবং সমসাময়িক সময়ে ৪৬৮২ দিনের কারাভোগ শেখ মুজিব কে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে বাঙালি জাতির পিতা করে তুলেন।

পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের কূটকৌশল ছিন্ন করে তার দূরদর্শী রাজনীতি ও প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের বলেই ১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে অঙ্কিত হয় আমাদের এই প্রাণের বাংলাদেশ।

একাত্তরের ১০ মাসের কারাভোগ, ফাঁসির কাষ্ঠে দাঁড়িয়ে বাঙালির মুক্তির জয়গান গেয়ে উঠেছিল যে হৃদয় সে প্রাণের প্রত্যাশা রুখে, কার সে সাহস!

ত্রিশ লাখ শহীদের তাজা রক্ত, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের ত্যাগের সাথে ৭ মার্চের সেই তেজোদ্দীপ্ত হুঁশিয়ারি অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। সদ্য স্বাধীন ধ্বংসস্তুপের একটা দেশ থেকে মাত্র ৭৭ দিনের মাথায় রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় শ্রী মতি ইন্দিরা গান্ধির মিত্র বাহিনী বাংলা ছাড়ে। শুরু হয় সোনার বাংলা বিনির্মাণের যাত্রা। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় জাতিসংঘ, ওআইসিসহ প্রায় ১৪০টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই তিনি ঘোষণা করেন- 'আমরা একটি ছোট রাষ্ট্র, আমাদের সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে এবং কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়।' তাঁর এই ঘোষণাতেই বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী কূটনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় মেলে। শাসনতন্ত্র, কূটনৈতিক বিচক্ষণতার পাশাপাশি জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলার মনোবৃত্তি নিয়ে সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বিনির্মাণে কার্যকরী শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন তিনি।

সদ্য স্বাধীন একটা ধ্বংসস্তুপকে তিনি প্রাণ দিতে শুরু করেছিলেন মাত্র। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। হায়নাদের ভয়াল আঁচড়! ভূলুণ্ঠিত হলো বাংলার স্বাধীনতা। পলাশীর প্রান্তরে প্রায় দু'শ বছরের জন্য যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল এই উপমহাদেশে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাপরবর্তী ২১ বছরের জন্য মুখ থুবড়ে পড়েছিল সেদিন। দেশ আবারও পেছন দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল। ঘরে ঘরে অনটন, পথেঘাটে নৈরাজ্য-হানাহানি। দেশি-বিদেশি অপশক্তি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ করে গেছে সর্বক্ষেত্রে।

অবশেষে কাঙ্ক্ষিত ১৯৯৬, স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির জয়ধ্বনি। পিতা মুজিবের রক্তের যোগ্য উত্তরসূরি জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাত ধরে পুনরায় পথচলা। মুখ থুবড়ে পড়া স্বাধীনতা আবারও জয়োৎসব করতে থাকে প্রতিটি বাঙালির ঘরে ঘরে। সবেমাত্র বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ পৌঁছে যাচ্ছিল বাংলার পথে প্রান্তরে শেখ হাসিনার হাত ধরে।

২০০১-০৮, আবারও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী বিষে বাংলাদেশ লুন্ঠিত। জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদিতায় দেশ নড়বড়ে।

অতঃপর আবারও সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা।

জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিতকরণ, স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদেরকে ফাঁসিতে ঝুলানোসহ সাহসী পদক্ষেপ নেন বঙ্গবন্ধু তনয়া।

ভঙ্গুর অবকাঠামোকে পুনর্জীবিতকরণ, বিদ্যুৎ খাতের টেকসই অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা খাতের সুদূরপ্রসারী উন্নয়ন, স্বাস্থ্য খাতকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো সহ পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল প্রকল্প, গভীর সমুদ্র বন্দর, মহাকাশে স্যাটেলাইট, বিভিন্ন মহাসড়ক নির্মাণ সহ জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক কাঠামো গঠন করার মাধ্যমে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে থেকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে।

জননেত্রী শেখ হাসিনার রূপকল্প ২০২১ এবং ২০৪১ এ সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জয়যাত্রার ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। যা সারা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। নারী ও শিশু উন্নয়নের পথিকৃৎ হিসেবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল কতৃক ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছেন একবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি দেশরত্ন শেখ হাসিনা। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আজ বাংলাদেশকে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করেছে সারাবিশ্বে।

২০২০, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পিতা মুজিবের জন্ম শতবার্ষিকী। পৃথিবীর ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুই একমাত্র দৃষ্টান্ত যিনি কি না একটা ভূখণ্ডকে দু'বার স্বাধীনতা এনে দিতে কারাবরণ করেছেন। আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক বিচক্ষণতায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যে বা যারা ইতিহাসের সোনালী অধ্যায় থেকে পিতা মুজিবের আদর্শ ভূলুণ্ঠিত করতে চেয়েছিল, তাদের জন্য বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন একটা চপেটাঘাত।

তাঁর দেখানো মতবাদের ওপর ভিত্তি করেই উন্নয়নের পথে এদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁরই সুযোগ্য আত্মজা, বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বলকারী এদেশের সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই তাঁর জয়যাত্রা ও সফলতা।

লেখক: সাবেক ছাত্রলীগ নেতা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :