অগ্নিঝরা মার্চ

সুব্রত বিশ্বাস (শুভ্র)
| আপডেট : ২১ মার্চ ২০২১, ১৩:৫০ | প্রকাশিত : ২০ মার্চ ২০২১, ১৫:০০

মার্চ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাস। কারণ এই মাসের ১৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশের জন্ম হতো না, যার জন্ম না হলে বাঙালি জাতি কোনোদিন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত না। যার জন্ম না হলে বাঙালি জাতিকে সারা জীবন অন্যের গোলামি করে চলতে হতো।

স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের গুরুত্বপূর্ণ তারিখগুলো আলোচনা করা হলো: ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রতিশ্রুতি ভঙের প্রথম পদক্ষেপ নেন, তিনি নবনির্বাচিত সদস্য সংবলিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন, যা ১৩ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত ৩ মার্চের জাতীয় অধিবেশন ছিল। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে এক বিশাল ছাত্র সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন তৎকালীন ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব। ৩ মার্চ একই স্থানে অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে তৎকালীন ছাত্রনেতা শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। সেই ইশতেহারে উল্লেখ ছিল বাঙালির স্লোগান হবে ‘জয় বাংলা’ আর বঙ্গবন্ধু হবেন মুক্তিসংগ্রামের সর্বাধিনায়ক। সে সময় মুহুর্মুহু স্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত হচ্ছিল ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’

৭ মার্চ ছিল অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক দিন। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাখ লাখ মানুষের সামনে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই ভাষণে তিনি পাকিস্তানি শাসকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব-ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ এই ভাষণটি এখন ইউনেস্কোর বিশ্ব মেমোরি ও ঐতিহ্যের অংশ। ৭ মার্চের ভাষণ ছিল ওই মুহূর্তের প্রেক্ষাপটে বাঙালি জাতির জন্য দিক-নির্দেশনা। সেই দিক-নির্দেশনার ভিত্তিতেই পরবর্তী দিনগুলো অতিবাহিত হয়েছিল বাংলাদেশের মাটিতে। ৭ মার্চ তারিখের ভাষণে প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ না থাকলেও, পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার সব উপাত্ত উপস্থিত ছিল। মূলত এটিই ছিল স্বাধীনতার অনানুষ্ঠানিক ঘোষণা। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের পর থেকেই স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে বীর বাঙালি। ঢাকাসহ গোটা দেশে পত পত করে উড়তে শুরু করে সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্য আর সোনালি মানচিত্রের পতাকা।

৮ মার্চে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নামকরণ শুধু ‘ছাত্রলীগ’ ঘোষণা করা হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের আহ্বান জানানো হয়।

১৯ মার্চ ১৯৭১ সালের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন, যা জনসমক্ষে বহুল প্রচারিত নয়। ওই দিন জয়দেবপুরের (বর্তমান গাজীপুর) জনগণ এবং জয়দেবপুরে অবস্থানরত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পারস্পরিক সম্মোহনী যুক্তিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং সেনাবাহিনীর একটি দলকে প্রতিরোধ করেছিল; এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ দিবস।

এরপর এলো সেই ভয়ংকর বিভীষিকাময় ২৫ মার্চ। এই ২৫ মার্চের রাত ছিল বাংলার ইতিহাসের কালরাত্রি, পাকিস্তানি সেনাদের নিরীহ বাঙালির ওপর আক্রমণের রাত। চারদিকে রক্ত আর রক্ত, শহীদের সারি সারি লাশ। মধ্যরাতে পরিচালিত হয় পাকবাহিনীর অভিযান ‘অপারেশন সার্চ-লাইট’। গ্রেপ্তার করা হয় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। জাতির পিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার সর্বস্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাই ২৬ মার্চ হলো মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিন অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিন এবং মহান স্বাধীনতা দিবস।

এভাবে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা। ফলে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা লাভ করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

লেখক: কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :