যুদ্ধের প্রকার, রক্তের প্রবাহ

ফকির ইলিয়াস
 | প্রকাশিত : ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:৫৪

জগতে দখলদারিত্বের মানসিকতা আদিম। জঙ্গলে বড়ো পশু, ছোটো পশুদের থাকতে দেয় না! নদীতে বড়ো মাছ, ছোটো মাছদের খেয়ে ফেলে, এসব শুনতে শুনতেই বেড়ে উঠে প্রজন্ম পৃথিবীর নানা প্রান্তে। মানুষ ধর্মকর্ম করে শান্তির জন্য। উৎসব পালন করে শান্তির জন্য। মানুষ নববর্ষে প্রতিবারই আলোকময় বিশ্ব কামনা করে! কিন্তু তারপর? সারাটি বছর কি মানুষের ভালোয় ভালোয় যায়? না, যায় না। যদি যেত, তবে তো পৃথিবীই স্বর্গে পরিণত হতো! হতো না? হাজার বছর আগে ধর্মযুদ্ধের যে কাঁপন, মাটির বুকে ভয় জাগাতো- আমি এই নিবন্ধে তা স্মরণ করতে চাই না! কেন চাই না- এর ব্যাখ্যা দিয়ে লেখার গতি অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার বাসনাও আমার নেই। কিন্তু কেন এই অন্যায় যুদ্ধ! কেন এই দখলদারিত্বের আগ্রাসন! সেই প্রশ্নটি আজকের বিশ্বের সকল শান্তিকামী মানুষের।

আপাতত আমরা যুদ্ধকে দুইভাগে বিভক্ত করতে পারি। একটি অস্ত্রযুদ্ধ আর অন্যটি স্নায়ুযুদ্ধ। অবাক করা কথা হচ্ছে, অস্ত্রযুদ্ধের প্রকার যে হারে বদলেছে, স্নায়ুযুদ্ধের প্রকার বদলেছে এর প্রায় তিনগুণ বেশি! স্নায়ুযুদ্ধের পাঁজরে প্রধান ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বমিডিয়া। যা কোনো-কোনো ক্ষেত্রে পরমাণু বোমার চেয়েও বড়ো বিষ ছড়িয়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে নিরীহ গণমানুষের চোখে-মুখে-বুকে!

বিশ্বে রাজা বাদশাহদের যে যুদ্ধ ছিল, তাতে সম্ভোগের একটি বিষয় জড়িয়ে থাকতো। এমনকি ধর্মযুদ্ধেও আমরা ভোগবাদী চরিত্রের দেখা পাই। আজকের বিশ্বে বদলে গেছে এর প্রকারভেদও! খুব কাছের যে যুদ্ধ দিয়ে আমরা আলাপ শুরু করতে পারি, তা হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যা ১৯১৪ সালের ২৮শে জুলাই ইউরোপে শুরু হয় এবং ১১ই নভেম্বর ১৯১৮ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ৬ কোটি ইউরোপীয়সহ আরো ৭ কোটি সামরিক বাহিনীর সদস্য ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম এই যুদ্ধে একত্রিত হয়। এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাতের একটি এবং এর ফলে পরবর্তী সময়ে এর সাথে যুক্ত দেশগুলোর রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন হয়। অনেক দেশে এটি বিপ্লবেরও সূচনা করে।

১৯১৪ সালের ১৮ই জুন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো শহরে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ এক সার্বের গুলিতে নিহত হন। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং ওই বছরের ২৮শে জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ যুদ্ধে দু'দেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে। এতে যোগ দিয়েছিল সে সময়ের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী সকল দেশ। এভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) সূচনা হয়। তবে অস্ট্রিয়ার যুবরাজের হত্যাকাণ্ডই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একমাত্র কারণ ছিল না। উনিশ শতকে শিল্পবিপ্লবের কারণে সহজে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং তৈরি পণ্য বিক্রির জন্য উপনিবেশ স্থাপনে প্রতিযোগিতা এবং আগের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একপক্ষে ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মানি ও বুলগেরিয়া। যাদের বলা হতো কেন্দ্রীয় শক্তি। আর অপরপক্ষে ছিল সার্বিয়া, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, রুমানিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যাদের বলা হতো মিত্রশক্তি। ইতিহাস আমাদের জানাচ্ছে, এই মহাযুদ্ধে প্রায় ১৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রত্যক্ষ ও ১৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরোক্ষভাবে খরচ হয়। যা ইতঃপূর্বে ঘটিত যেকোনো যুদ্ধব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।

যুদ্ধের মর্মান্তিক দিক হচ্ছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৯০ লক্ষ যোদ্ধা ও ১ কোটি ২০ লক্ষ নিরীহ মানুষ নিহত হয়। প্রায় এককোটি সৈন্য এবং ২ কোটি ১০ লক্ষ সাধারণ মানুষ আহত হয়, এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ছিল এক লক্ষ ষোলো হাজার পাঁচশত ষোলো জন। চারটি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। রোমান সাম্রাজ্য বা রুশ সাম্রাজ্য ১৯১৭ সালে, জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য ১৯১৮ সালে এবং উসমানীয় সাম্রাজ্য ১৯২২ সালে। অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং তুরস্ক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা অধিকাংশ আরব এলাকা ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। ১৯১৭ সালে বলশেভিকরা রাশিয়ার এবং ১৯২২ সালে ফ্যাসিবাদীরা ইতালির ক্ষমতায় আরোহণ করে। এ যুদ্ধের অন্য কুফল হলো- ইনফ্লুয়েঞ্জায় বিশ্বব্যাপী ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়।

বিশ্বে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালো ছায়া নেমে আসে, ১৯৩৯ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ যাবৎকাল পর্যন্ত সংঘটিত সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ বলা হয়ে থাকে। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল- এই ছয় বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়সীমা ধরা হলেও ১৯৩৯ সালের আগে এশিয়ায় সংগঠিত কয়েকটি সংঘর্ষকেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়।

তৎকালীন বিশ্বে সকল পরাশক্তি এবং বেশিরভাগ রাষ্ট্রই এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং দুইটি বিপরীত সামরিক জোটের সৃষ্টি হয়; মিত্রশক্তি আর অক্ষশক্তি। এই মহাসমরকে ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্তৃত যুদ্ধ বলে ধরা হয়, যাতে ৩০টি দেশের সব মিলিয়ে ১০ কোটিরও বেশি সামরিক সদস্য অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ খুব দ্রুত একটি সামগ্রিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সামরিক ও বেসামরিক সম্পদের মধ্যে কোনোরকম পার্থক্য না করে তাদের পূর্ণ অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রয়োগ করা শুরু করে।

এছাড়া বেসামরিক জনগণের উপর চালানো নির্বিচার গণহত্যা, হলোকাস্ট (হিটলার কর্তৃক ইহুদিদের উপর চালানো গণহত্যা), পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োগ প্রভৃতি ঘটনায় কুখ্যাত এই যুদ্ধে প্রায় ৫ কোটি থেকে সাড়ে ৮ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এসব পরিসংখ্যান এটাই প্রমাণ করে যে এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংসতম যুদ্ধ।

পাঠকের জানার সুবিধার জন্য এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ এখানে তুলে ধরা সংগত মনে করছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। তবে এ নিয়ে একটি সাধারণ ধারণাও রয়েছে যা অনেকাংশে গ্রহণযোগ্য। এই কারণটি যুদ্ধোত্তর সময়ে মিত্রশক্তির দেশসমূহের মধ্যে তোষণনীতির মাধ্যমে সমঝোতার ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়- যা নির্দেশক শক্তির ভূমিকা পালন করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্স। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি এবং জাপানের আধিপত্য ও সাম্রাজ্যবাদকে দায়ী করে এই কারণটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি তার সম্পদ, সম্মান এবং ক্ষমতার প্রায় সবটুকুই হারিয়ে বসে। এর সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারার মূল কারণ ছিল জার্মানির হৃত অর্থনৈতিক, সামরিক এবং ভূমিকেন্দ্রিক সম্পদ পুনরুদ্ধার করা এবং পুনরায় একটি বিশ্বশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। এর পাশাপাশি পোল্যান্ড এবং ইউক্রেনের সম্পদসমৃদ্ধ ভূমি নিয়ন্ত্রণে আনাও একটি উদ্দেশ্য হিসেবে কাজ করেছে। জার্মানির একটি জাতীয় আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপর সম্পাদিত ভার্সাই চুক্তি হতে বেরিয়ে আসার। এরই প্রেক্ষাপটে হিটলার এবং তার নাৎসি বাহিনীর ধারণা ছিল যে, একটি জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে দেশকে সংগঠিত করা সম্ভব হবে। যুদ্ধের মূল কারণ ছিল মিত্র শক্তির এক পক্ষ চুক্তি। মিত্র শক্তির এই এক পক্ষ চুক্তি জার্মানিরা মেনে নিতে পারেনি। তারা ভাবে যে তাদের সাথে বৈরী আচরণ করা হয়েছে। তাই তাদের মনে একটা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।

বিশ্বের আরেকটি দীর্ঘ যুদ্ধের নাম 'ভিয়েতনাম যুদ্ধ'। এটি স্থায়ী হয় ১৯৫৫ সালের ১-লা নভেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছিল স্নায়ুযুদ্ধের একটি দীর্ঘ, ব্যয়বহুল এবং রক্তক্ষয়ী সংঘাত- যা উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট সরকার এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম এবং তার প্রধান মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সংগঠিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলমান স্নায়ুযুদ্ধের কারণে এই সংঘাত তীব্রতর হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রায় ৩ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ (৫৮,০০০ আমেরিকানসহ) নিহত হয়েছিল এবং মৃতদের অর্ধেকেরও বেশি ভিয়েতনামী বেসামরিক ব্যক্তি ছিল। রহস্যজনক কথা হচ্ছে- ভিয়েতনামে আসলে কতজন মার্কিন সেনা নিহত হয়েছিলেন তার আজ পর্যন্ত সঠিক কোনো পরিসংখ্যান মার্কিনীরা দেয়নি। কারণ তারা মনে করে- যেকোনো যুদ্ধে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা বেরিয়ে পড়লে বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়তে পারে!

একজন সমর বিশেষজ্ঞ কার্ল ভন ক্লজবীৎস, যুদ্ধ বিষয়ে বলেছেন- ‘যুদ্ধ আর কিছুই নয়, তা হলো অন্য উপায়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা’। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধ এবং আগ্রাসন দুটোই রাজনীতির একটা হাতিয়ার মাত্র। আমরা বিশ্বে কোল্ডওয়ার বারবারই দেখেছি। রাশিয়া ভেঙে খান খান হয়ে গিয়েছে আমাদের চোখের সামনেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেদিনের 'ভাঙন-নায়ক'রা আজও তা নিয়ে গর্ববোধ করেন। এরপরে, উপসাগরীয় যুদ্ধের কথা আমাদের মনে আছে। জর্জ বুশ মনে করছিলেন, এই যুদ্ধ পরিসমাপ্তির পর নতুন এক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। সাদ্দাম হুসেনের কাছে এটি ছিল সব যুদ্ধের জননী! তিনি মনে করেছিলেন, যার পরিণতিতে আরব দুনিয়া পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠবে এবং মুক্ত হবে প্যালেস্টাইন! আদতে তা কি হয়েছিল? না, হয়নি। তবে এই যুদ্ধের অভিপ্রায় যে নিছক কুয়েতের মুক্তি নয় তা হলফ করেই বলা গিয়েছিল সেই সময়। এই যুদ্ধ ছিল বর্তমান দুনিয়ায় জোটগুলির দ্বন্দ্বের প্রতিফলন এবং আবার একই সঙ্গে সম্পর্কগুলির পুনর্বিন্যাসেরও মাধ্যম। যুদ্ধ হচ্ছে মৃত্যু ও ধ্বংসের উন্মত্ত লীলা। কিন্তু কখনও সখনও ইতিহাসে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে এবং ইতিহাসকেই গতি প্রদান করে। উপসাগরীয় যুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই ইতিহাসের ক্ষেত্রে অবশ্যই এক নতুন সূচনা সৃষ্টি করেছিল।

১৯৯০ সালটি ছিল সমাজতন্ত্রের পরাজয় এবং সাম্রাজ্যবাদের বিজয়ের বছর। সর্বগ্রাসী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে পূর্ব ইউরোপে ‘উদারনৈতিক বুর্জোয়া মূল্যবোধ’ বিজয়ী আত্মপ্রকাশ ঘটায়। সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র তখন মৃত্যুপথযাত্রী। আর, তিয়েন-আন-মেন স্কয়ারের ঝাঁকানির পর, পশ্চিমা দুনিয়ার আক্রমণাত্মক অবস্থানের মুখে চীন পড়ে যায় রক্ষণাত্মক অবস্থায়। নির্জোট আন্দোলন তার সমস্ত প্রাসঙ্গিকতা খুইয়ে ফেলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্ব পুঁজিবাদ তার বিজয় কেতন ওড়ায় এবং বহু দশক পর বিশ্বকে আবার এককেন্দ্রিক হয়ে উঠতে দেখা যায়।

সিনিয়র জর্জ বুশের তুলে ধরা নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার সহজ অর্থই ছিল তৃতীয় বিশ্ব এবং তার সম্পদসমূহের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তার করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৯১ সালের প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা বাজেট বিতর্কিত ‘নক্ষত্র যুদ্ধ’ খাতে ব্যয় বরাদ্দ বিগত বছরের ২.৯ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৪.৮ বিলিয়ন ডলার। বাজেট ঘোষণায় সোভিয়েত রাশিয়া থেকে পারমাণবিক বিপদের সম্ভাবনা কমে যাওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি থেকে সম্ভাব্য ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের অজুহাত খাড়া করে এই বরাদ্দ বৃদ্ধিকে যুক্তিসংগত হিসেবে দেখানো হয়। নয়া বিশ্বব্যবস্থার এই মার্কিনি পরিপ্রেক্ষিত থেকে, এটি খুবই স্বাভাবিক ছিল যে, ইরাকের দিক থেকে কুয়েত আগ্রাসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছুতেই বরদাস্ত করবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের মতো দেশগুলি পশ্চিম এশিয়ার তেলের খনির উপর তাদের অধিকারকে জন্মগত অধিকার হিসেবেই মনে করে!

মার্কিনী এজেন্ট কুয়েতের শেখ-এর পতন এবং তারই পাশাপাশি আবার শক্তিশালী এক দেশ হিসেবে ইরাকের উত্থান এবং ২০ শতাংশ তেল সম্পদের ওপর তার কর্তৃত্ব নয়া বিশ্বব্যবস্থার প্রতি বাস্তবিকই এক সরাসরি আঘাত হিসেবেই ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেবলমাত্র এক যুদ্ধের জন্যই উন্মুখ হয়েছিল। আর এককেন্দ্রিক বিশ্বের এক চমৎকার নিদর্শন স্বরূপ রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোলাম হিসেবেই কাজ করেছিল। যা তারা প্রায় সবসময়ই করে থাকে। ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জোটভুক্ত দেশগুলি বহুজাতিক সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় এবং তার সঙ্গে সিরিয়া, মরোক্কো এবং মিশরের মতো আরব দেশগুলিও অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছিল। পাকিস্তান পাঠিয়েছিল পদাতিক বাহিনী আর ভারত জোগান দিয়েছিল মার্কিন সামরিক যুদ্ধ বিমানের জন্য জ্বালানি। জার্মানি ও জাপান দিয়েছিল আর্থিক সহায়তা। সোভিয়েত রাশিয়া নৈতিক সমর্থন নিয়ে এগিয়ে এলেও, চীন অবলম্বন করেছিল রহস্যজনক নীরবতা।

এভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে পুরো রাজনৈতিক উদ্যোগ চলে আসে, আর ইরাক হয়ে পড়েছিল একা, সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। ইয়েমেন ও কিউবার মতো কয়েকটি ছোটো দেশ বাদে আমেরিকার বিরুদ্ধে আর কাউকেই প্রতিবাদী কণ্ঠে সোচ্চার হতে দেখা যায়নি সেই সময়ে। এতকিছুর পরও ইরাক লড়াই চালিয়ে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেয়। কুয়েতের ইস্যুটির সঙ্গে প্যালেস্টাইনের প্রশ্ন যুক্ত করে এবং ইরানের সঙ্গে পুরোনো বৈরিতা মিটিয়ে নিয়ে ইরাক তার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করেই রেখেছিল।

সমস্ত নৃশংসতা নিয়েই যুদ্ধ অব্যাহত ছিল। ইরাক তখন ছিল ইতিহাসের জঘন্যতম বোমাবর্ষণের মুখে দাঁড়িয়ে। আর এটিই পাশ্চাত্য সভ্যতার কুৎসিত মুখকে উন্মোচিত করেছিল। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদের মাঝখানে শতাব্দী পুরাতন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার সমস্ত অবশেষ, বাগদাদ ও বসরার মতো ঐতিহাসিক শহরগুলি এবং কয়েক শতাব্দী ব্যাপী ইসলামি সভ্যতার ধর্মীয় স্থানগুলি ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। খুন করা হচ্ছিল শয়ে শয়ে শিশু, মহিলা ও সাধারণ নাগরিকদের। উন্নত প্রযুক্তির প্রতি পাশ্চাত্য দুনিয়ায় আকর্ষণ এই বীভৎসতাকে দূরদর্শনের পর্দায় এক রোমাঞ্চকর খেলায় রূপান্তরিত করেছিল! মানবসভ্যতা কি সেই সময়ে মুখ থুবড়ে পড়েনি? মার্কিনি নেতাদের অশালীন কথাবার্তা এবং পাশ্চাত্য সংবাদমাধ্যমগুলির ভাষা স্পষ্টতই তাদের জাতিবিদ্বেষের মনোভাবকে প্রতিফলিত করেছিল। এই মনোভাব আর কিছুই নয়, তা ছিল তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলির আকাঙ্ক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি প্রবল ঘৃণারই অভিব্যক্তি। মূল কথা হলো, এটাই ছিল এবং আছে- আমেরিকার এককেন্দ্রিক বিশ্বের ছবি, যার স্বপ্ন মার্কিনিরা এতদিন দেখে আসছে। বিশ্বে যুদ্ধের ইতিহাস আমাদের জানাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো যুদ্ধেই জয়ী হতে পারেনি! তারা এক প্রকারের রণেভঙ্গ দিয়েই পালিয়ে এসেছে! প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা কত- সেটাও গোপন রেখেছে বিভিন্নভাবে। যাতে তাদের যোদ্ধাদের মনোবল ভেঙে না পড়ে!

(কলামটির দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি প্রকাশিত হবে আগামী সপ্তাহে)

ফকির ইলিয়াস: কলাম লেখক, কবি ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :