সর্বরোগের ঔষধ ভেষজ উদ্ভিদ জিনসেং

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ২০ জুলাই ২০২২, ০৮:৫৭

জিনসেং সারা বিশ্বে আলোচিত একটি ঔষধি উদ্ভিদ। প্রাচীনকাল থেকে চীন, জাপান ও কোরিয়ায় বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক ও শক্তিবর্ধক টনিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে জিনসেং।

সর্বরোগের ঔষধ জিনসেং মাংসল মূলবিশিষ্ট এক ধরনের বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। যার বৈজ্ঞানিক নাম প্যানাক্স জিনসেং। পাঁচ হাজার বছর আগে মাঞ্চুরিয়ার পাহাড়ি ঢালে ছিল এদের বিপুল আস্তানা। চীনে তখন এর শিকড় ছিল মানুষের খাদ্য। ক্রমে ক্রমে অসাধারণ গুণাবলী প্রকাশিত হলে এর আধুনিক উত্তরণ ঘটে ওষুধ হিসাবে। এর শিকড়ের আকৃতি প্রায়শ দেখা যায় মানব দেহের মতো, নিচের দিকে দুভাগ হয়ে যাওয়া পায়ের মত, আবার কখনো দেখা যায় হাত-পা উভয়ই। জিনসেং নামটিও এসেছে চীনা শব্দ ‘রেনশেন’ থেকে যার অর্থ মানুষের পা।

মূলত দুই ধরনের জিনসেং ঔষধি গুণসম্পন্ন হিসেবে পরিচিত- আমেরিকান ও এশিয়ান। এর মধ্যে এশিয়ান জিনসেং অপেক্ষাকৃত বেশি কার্যকরী। জিনসেং উত্তর গোলার্ধে পূর্ব এশিয়াতে, বিশেষ করে চীন, কোরিয়া ও পূর্ব সাইবেরিয়াতে, ঠাণ্ডা পরিবেশে জন্মে।

জিনসেংকে কোরিয়ানরা বিভিন্নভাবে খেয়ে থাকে। এর পুরো মূল সুপে দিয়ে দেয়, সিদ্ধ মূল খেতে হয়। চিবিয়ে চিবিয়ে এর নির্যাস নিতে হয়। এছাড়াও জিনসেং-এর রয়েছে নানাবিধ খাদ্য উপকরণ।

জিনসেং সাদা (খোসা ছাড়ানো) ও লাল (খোসা সমেত) এই দুই রকম রূপে পাওয়া যায়। খোসা সমেত অবস্থায় এটি অধিক কার্যকরী। এদের মধ্যে থাকা জিনসেনোনোসাইড নামক একটি উপাদান এর কার্যক্ষমতার জন্য দায়ী।

বাজারে যে সব জিনসেং ওষুধ বা টনিক হিসাবে পাওয়া যায় তাতে অনেক কিছুর মিশাল থাকে। বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য অন্তত ৫টি গাছকে এখন জিনসেং বলে অভিহিত করা হয় এবং নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা হয়। সেগুলো হলো এশিয়ান জিনসেং, আমেরিকান জিনসেং, সাইবেরিয়ান জিনসেং, ইন্ডিয়ান জিনসেং এবং ব্রাজিলিয়ান জিনসেং।

ঔষধি গুণের জন্য জিনসেং ভেষজ উপাদানটি স্ট্রেস কমানো থেকে শুরু করে এনার্জি বাড়াতে, অতিরিক্ত ওজন কমানো, যৌনক্ষমতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। জেনে নিন জিনসেংয়ের উপকারিতা

ক্যানসার প্রতিরোধ করে

কোলোন ক্যানসারের সম্ভাবনা কম করতে জিনসেংয়ের ভূমিকা অনেক গবেষণার দ্বারা প্রমাণিত। জিনসেংয়ের নিয়মিত সেবন কোলোন ক্যানসারের ছড়িয়ে পড়তে আটকাতে পারে। টিউমার বৃদ্ধি রোধ করার ক্ষমতা একে ক্যানসারের অন্যতম শক্তিশালী প্রতিরোধক হিসেবে গড়ে তুলেছে। জিনসেং টি সেল এবং এনকে সেলগুলোর (প্রাকৃতিক ঘাতক কোষ) কার্যকারিতা বাড়িয়ে কোষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করে। এটি অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের বিরুদ্ধেও লড়াই করে এবং ক্যানসার কোষের মৃত্যু ঘটায়। পরীক্ষায় আরও দেখা গেছে, জিনসেংয়ের মধ্যে উপস্থিত জিনসেনোসাইডগুলো ফুসফুসের ক্যানসার প্রতিরোধ করে এবং কিডনি, ডিম্বাশয়, পেট, ত্বক এবং জরায়ুর ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে

সুগার থেকে বাঁচতে বা কম করতে জিনসেংকে সব থেকে ভালো আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসেবে বিচার করা হয়। এর জন্য জিনসেং খালি পেটে অথবা খাবারের পরে খেতে করতে পারেন। যার ফলে রক্ত শর্করা স্তরকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যেতে পারে। জিনসেং টাইপ-২ ডায়বেটিস ম্যানেজমেন্টে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।

ফুসফুসের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে

পরীক্ষায় দেখা গেছে, জিনসেং ফুসফুসে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধ করে এবং ফুসফুসের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে । করোনিক অবসট্রাকটিভ পামনারি ডিজিজ (সিওপিডি) হচ্ছে ফুসফুসের অন্যতম সাধারণ একটি সমস্যা। এক্ষেত্রে রোগীদের শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, বুকে কফ জমে, কারও ক্ষেত্রে ফুসফুসের ক্ষয় হয়। জিনসেং গ্রহণে সার্বিকভাবে সিওপিডি-এর অবস্থার উন্নতি হয় বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে ।

মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তি

জিনসেং বিপাকে উত্তেজিত করে এবং উর্জার স্তর বাড়িয়ে স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। এর ফলে মানসিক অবসাদ যেমন চিন্তা এবং চাপ কম হয়। এছাড়াও জিনসেংয়ের মধ্যে এডাস্টোজেন নামে এক উপাদান থাকে যা হরমোনাল স্তর বদলানোর ক্ষমতা রাখে। ফলে চাপও কম হয় এবং মুড ভালো হয়।

বয়স বাড়া থামিয়ে দেয়

জিনসেংয়ে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যার ফলে পুরো শরীরে ফ্রি রেডিক্যালসের ঋণাত্মক প্রভাব কম হয়। সাধারণত ফ্রি রেডিক্যালস সেলুলার বিপাকের ফলে তৈরি একটি ক্ষতিকর উপপণ্য। ফ্রি রেডিক্যালস সতেজ কোষগুলোর ক্ষতি করে।

ওজন কমায়

জিনসেংয়ে অনেক রকম রাসায়নিক উপাদান থাকে যা খাবার খাওয়ার ইচ্ছাকে আটকে রাখে। বিশেষ করে শুকনো জিনসেং পাউডার কোনরকম খাবারের লোভকে ট্রিগার করে খিদে পাওয়ার হরমোনকে আটকে রাখে। যার ফলে আপনার ওজন কম করতে সাহায্য করে।

কগনিটিভ ক্ষমতা বাড়ায়

কগনিটিভ ক্ষমতা যেমন একাগ্রতা, স্মৃতি ইত্যাদি বাড়াতে জিনসেংয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও এটি নিয়মিত সেবন করলে আপনার স্নায়ুবিক গতিবিধি বাড়তে পারে। জিনসেংয়ে থাকা থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মস্তিষ্কের পট্টিকা এবং ফ্রি রেডিকলসের উৎপন্ন হওয়া কম করে। এর দ্বারা অনেক রকম কগনিটিভ এর ক্ষতি দূর হয়।

ত্বকের কোষগুলোকে পুনর্জীবিত করে

শরীরে রক্ত সঞ্চারকে জিনসেং উত্তেজিত করে। বিশেষ করে ত্বকের কোষগুলোতে এর বেশি প্রভাব দেখা যায়। এতে বিপাকে উত্তেজিত এবং সক্রিয় করার ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট পাওয়া যায়। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। জিনসেং এর চা আপনার ত্বককে টোন্ড এবং হাইড্রেট করে। জিনসেং অক্সিজেনের ঘাটতিকে পূর্ণ করে ত্বকের কোষগুলোকে পুনর্জীবিত করে।

চুলের জন্য উপকারী

চুলের বিভিন্ন সমস্যা যেমনচুল পড়ে যাওয়া এবং টাক ইত্যাদিতে জিনসেং অনেক উপকারী। কারণ জিনসেং এ অনেক প্রাকৃতিক কার্বোহাইড্রেট পাওয়া যায়। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে জিনসেং চুলের দেখাশোনার জন্য অনেক প্রভাবশালী।

নারীদের জন্যও জিনসেং

নারীদের জন্যও জিনসেং নানা কাজ করে থাকে। বেদনাদায়ক পিএমএস, ব্রেস্ট ক্যানসার রোধে এবং মেনোপজে এর ব্যবহার সঙ্গত। মেনোপজের পর হাড়ের ঘণত্ব কমে যায় বলে হাড় পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে সহজে ফ্রাকচার হতে পারে। এমতাবস্থায় জিনসেং সেবনে এই অবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়। অ্যান্টি-এজিং গুণাবলী থাকার কারণে জিনসেংকে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন প্রসাধনীতেও।

প্রভাবশালী কামোদ্দীপক

জিনসেংকে অনেকে ভেষজ ভায়াগ্রা বলে থাকে, এর পিছনে অবশ্য কারণও রয়েছে। গবেষণায় প্রমাণিত এটি ইরেকটাইল (বা যৌন) কর্মহীনতার চিকিৎসার ক্ষেত্রে এটি কার্যকারিতা গুরুত্বপূর্ণ।

চৈনিক আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাতে এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে জিনসেং ব্যবহার করা হয়। এর কারণ হলো একটি প্রভাবশালী কামোদ্দীপক। কোরিয়ার লাল জিনসেং এই কাজগুলো জন্য ব্যবহার করা হয়। জিনসেং এর গুণাবলীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী যা প্রমাণিত তা হলো, পুরুষের লিংগোত্থানে অক্ষমতা রোধে এর ভূমিকা। গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে, জিনসেং কিভাবে লিংগোত্থানে সহায়তা করে। পুরুষের যৌনাঙ্গে করপাস কেভারনোসাম নামে বিশেষ এক ধরনের টিস্যু থাকে। নাইট্রিক অক্সাইডের উপস্থিতিতে এই টিস্যু রক্তে পরিপূর্ণ হয়ে লিংগোত্থান ঘটায়। জিনসেং সরাসরি দেহে নাইট্রিক অক্সাইডের পরিমাণ বাড়িয়ে লিংগোত্থানে সহায়তা করে। জিনসেং প্রাপ্ত ফাইটো টেস্টোস্টেরনের উৎস। জিনসেং শুক্রাণু গণনাকে উন্নত করে এবং এড্রেনাল এবং প্রোস্টেট গ্রন্থিগুলোর কার্যকারিতা বাড়ায় ।

জিনসেং শিকড় কীভাবে ব্যবহার করবেন

জিনসেং চা হিসেবে গ্রহণ করা সবচেয়ে সেরা। এই উপায়ে আপনি সবচেয়ে বেশি উপকার পাবেন। কাছাকাছি কোনও দোকান থেকে এর টি ব্যাগ কিনে ব্যবহার করতে পারেন। এই উপায়ে ব্যবহার করতে পারেন –

শিকড়ের খোসা ছাড়িয়ে নিন। তারপর গুঁড়া বা শুকনো করে শিকড় ব্যবহার করতে পারেন। এক চামচ শিকড়ের গুঁড়ো নিন এবং একটি ধাতব পাত্রে রাখুন। ভালো করে ফুটিয়ে নিন এবং ২ থেকে ৩ মিনিটের জন্য ঠান্ডা হতে দিন। একটি চায়ের কাপে ঢেলে নিন এবং চুমুক দিয়ে খান। জিনসেং চা ছাড়াও আপনি জিনসেং পাউডার খেতে পারেন।

জিনসেং কতটা পরিমাণে খাবেন

যাদের টাইপ ২ ডায়াবেটিস রয়েছে, প্রতিদিন ২০০ মিলিগ্রাম ব্যবহার করুন। যাদের যৌন সমস্যা রয়েছে তারা সারাদিনে তিনবার ৯০০ মিলিগ্রাম জিনসেং নিতে পারেন। ক্লান্তি বা স্ট্রেস যাদের ভোগান্তির কারণ তারা প্রতিদিন ১ গ্রাম জিনসেং নিন। প্রয়োজনে ডাক্তারের সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ নিন।

জিনসেং কোথায় থেকে কিনবেন

জিনসেংয়ের জনপ্রিয়তা যেভাবে দিন দিন বেড়ে চলছে, বাজারে যে কোনও বড় হেল্থ ফুড স্টোরে সহজেই এটি পেয়ে যাবেন। অনলাইনেও কিনতে পারেন।

(ঢাকাটাইমস/২০ জুলাই/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :