ভোক্তা অধিকারের অভিযানে ‘নাখোশ’ পেট্রল পাম্প মালিকরা

আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ০৭ আগস্ট ২০২২, ২১:৫৪
অ- অ+

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আগে থেকেই সারাদেশের পেট্রল পাম্পে অভিযান শুরু করেছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তেলের পরিমাণ কম দেওয়ার অভিযোগে এসব অভিযান চালানো হচ্ছে। শনিবারও সারাদেশে ৪১টি পেট্রোল পাম্পে অভিযান চালিয়ে ৪১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

তবে বাংলাদেশ পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, এই অভিযানকে তারা স্বাগত জানান। কিন্তু অভিযানের নামে ব্যবসায়ীদের প্রতি কোনো ধরনের অনৈতিক আবদার মেনে নেবে না। তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।

গত ২৬ জুলাই প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আজাদের বড় মেয়ে মৌলি আজাদ পেট্রোল পাম্পে প্রতারিত হন। তিনি এক হাজার টাকা তেল কিনলে তাকে ৫০০ টাকার তেল দেওয়া হয়। পরে হাতে-নাতে পাম্পের জালিয়াতি ধরে ফেললেন। পরে তিনি জাতীয় পরিসেবা-৯৯৯-এর সহায়তা নেন।

ফিলিং স্টেশন বা পেট্রোল পাম্পে যেকোনো ধরনের তেল (অকটেন-পেট্রোল-ডিজেল) কম দেওয়ার অভিযোগ বেশ পুরনো। ক্ষেত্রবিশেষে লিটারে প্রায় ১০০ মিলিলিটার পর্যন্ত কম দেওয়ার অভিযোগ আছে। এসব বন্ধে বিভিন্ন সংস্থা- যেমন বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও র‌্যাব পাম্পগুলোতে অভিযান চালায়। অভিযান জরিমানা বা সর্তকতায় সীমাবদ্ধ থাকে বলে আবার ঘটে তেল কম ও ভেজাল দেওয়ার ঘটনা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পেট্রোল পাম্পগুলোর বড় চুরি ওজনে কম দেওয়া। ডিজিটাল মেশিনে গ্রাহক এটা ধরতেও পারেন না। তেলে ভেজাল ও ওজনে কম দেওয়ায় যদি তেল সরবরাহ বন্ধ ও লাইসেন্স বাতিল করা হতো তাহলে এই ধরনের অপরাধ কমে আসত।

বিএসটিআইয়ের তথ্য বলছে, গেল তিন মাসে (এপ্রিল, মে, জুন) ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো হয়েছে শতাধিক। এতে ১৬ লাখ টাকার বেশি জরিমানা করা হয়। আর এ সময়ে সার্ভিল্যান্স বা নজরদারি করা হয় ১২৭টি পাম্প।

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে দুই হাজারের বেশি ফিলিং স্টেশন রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত পদ্মা অয়েল কোম্পানি (পিওসিএল), যমুনা অয়েল কোম্পানির (জেওসিএল) এবং মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের (এমপিএল) মাধ্যমে এসব পাম্পে তেল সরবরাহ করা হয়। এসব পেট্রোলপাম্পে কোথাও ডিজিটাল আবার কোথাও এনালগ মেশিনের মাধ্যমে গ্রাহক তেল পেয়ে থাকেন। অনেক সময় এসব মেশিন টেম্পারিং করে গ্রাহককে ওজনে ঠকানো হয়। আবার প্যাম্পগুলোতে তেলে ভেজাল মেশানোরও অভিযোগ আছে।

সম্প্রতি একটি তেল পাম্পে অভিযানের ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা গেছে, পাম্পের তেল দেওয়ার মেশিন টেম্পারিং করে তেল কম দেওয়া হচ্ছিল। চোখের পলকে মেশিনের চাবি ঘুরিয়ে কারসাজি করে তেল কম দেওয়া হচ্ছিল। পাঁচ লিটার অকটেনে ৪০০ মিলিলিটার এবং পেট্রোলে এর বেশি পরিমাণ তেল কম পাচ্ছিল গ্রাহকরা। এ কারসাজিতে পাম্পটির ম্যানেজার সরাসরি জড়িত ছিলেন।

জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাম্পগুলোতে ভেজাল এবং পরিমাপে কম দেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। মোবাইল কোর্ট মাঝে মধ্যে পরিচালনা করলেও নিয়মিত তদারকির অভাব রয়েছে। পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) যে নজরদারি করার কথা তারা তা করে না। এতে গ্রাহক প্রতারিত হন। অভিযানে দেখা যাচ্ছে, কেউ মাপে কম দিচ্ছেন, কেউ মেশাচ্ছেন ভেজাল। মোবাইল কোর্ট জরিমানা করলেও তাতে গ্রাহকের উপকার হচ্ছে না।

সূত্র বলছে, অনেক পাম্প মালিক গ্যাসক্ষেত্র থেকে কম দামে কনডেনসেট কিনে তেলের মধ্যে মিশিয়ে বিক্রি করছে। এতে দুই ধরনের ক্ষতি হচ্ছে গ্রাহকের। প্রথমত, তিনি তেল পাচ্ছেন কম। দ্বিতীয়ত, ভেজালের কারণে ইঞ্জিনের ক্ষতি হচ্ছে। তেলের পরিমাপ ঠিক রাখার জন্য ক্যালিব্রেশন করা হয়। এটি এমন এক পদ্ধতি যার মাধ্যমে শুরুতে আদর্শমান যাচাই করে নেওয়া হয়। কিন্তু অনেক পাম্পে ক্যালিব্রেশনেও সমস্যা রয়েছে।

অপর একটি সূত্র বলছে, ওজন কম দেওয়া ও ভেজাল দেখভালের দায়িত্ব পালনের কথা বিএসটিআইয়ের। একসময় প্রতিষ্ঠানটিকে অনেক পাম্প ম্যানেজ করে রাখত। এজন্য তারা সেখানে অভিযান চালাত না।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ.এইচ.এম সফিকুজ্জামান ঢাকাটাইমসকে বলেন, আমরা আগে থেকেই অভিযান শুরু করেছি। তেলের দাম বেড়েছে গত ৫ আগস্ট। আর আমরা অভিযান শুরু করেছি ৩ আগস্ট থেকে। গতকাল শনিবারও আমারা সারাদেশের ৪১ টি পেট্রল পাম্পে অভিযান চালিয়ে ১৭ লাখ টাকা জরিমাণা করেছি। এরআগের দিনেও প্রায় আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, আমরা পেট্রাল পাম্পগুলোকে তাদের কাগজপত্র আপডেট করার জন্য এক সপ্তাহ সময় দিয়েছি। যাতে তারা তাদের কাগজপত্র ঠিক করতে পারেন। আর তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য আমরা বিএসটিআই ও জ্বালানি পরিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছি।

অভিযানের নামে কোনো ব্যবসায়ী হয়রানির শিকার হবেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, মতিঝিলের একটি পেট্রল পাম্পে পাঁচ লিটার তেলে ৫০০ এম এল তেল কম দিয়েছে। আমরা এসব করতে দেবো না। আমাদের অভিযান চুরি কিংবা অতিরিক্ত মুনাফার বিরুদ্ধে। আর কেউ যদি আমাদের ভোক্তা অধিদপ্তরের কোনো সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেন তাহলে আমরা এর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবো। তবে আমরা কাউকে চুরি অথবা অতিরিক্ত মুনাফা করতে দেবো না।

সারাদেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, আজকের মিটিংয়ে আমি উপস্থিত ছিলাম। আমি এই অভিযানকে স্বাগত জানাই। ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পেট্রল পাম্পের মালিকদের কাগজপত্র আপডেট করার জন্য এক সপ্তাহ সময় দিয়েছেন। এটা ভালো দিক। তবে অভিযানের নামে কোনো ব্যবসায়ীকে অহেতুক হয়রানি করলে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবো।

ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর কী ধরনের হয়রানি করতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে নাজমুল হক বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সরকারি সংস্থার সদস্যরা অভিযানের নামে বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা দাবি করে থাকেন। এতে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হয়। সরকারের প্রত্যেকটা বিভাগের আলাদা দায়িত্ব থাকে। প্রত্যেকে স্বচ্ছভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবে। আর যারা ব্যবসা বাণিজ্য করে তাদের মধ্যে একটি স্বচ্ছতা থাকতে হবে। আমরা ওনাদেরকে সহযোগিতা করবো এবং ওনারাও আমাদের সহযোগিতা করবেন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘প্রায় দেখছি পেট্রোল পাম্পগুলো ওজনে তেল কম দিচ্ছে। সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর উচিত মাঝে মধ্যে তদারকি করা। এতে ভয়ে হলেও পাম্পগুলো তেল ওজনে কম দেওয়া ও ভেজাল দেওয়া বন্ধ রাখবে।’

ভোক্তা অধিদপ্তর পাম্পগুলোতে প্রায় সময় অভিযান চালায়। অভিযানে বেশির ভাগ সময় তেলে ওজন কম দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। সেই অনুযায়ী আমরা সংশ্লিষ্ট পাম্পকে জরিমানা করা হয়। আর তেলে ভেজালের অভিযোগ পেলে ল্যাবটেস্টের প্রয়োজন হয়। টেস্ট রিপোর্টে ভেজালের প্রমাণ মিললে জরিমানা করা হয়।

পাম্পগুলোতে এই ধরনের প্রতারণা নিয়ে নিজেরাই চিন্তিত বলে জানান বাংলাদেশ পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হক। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘আসলে আমরা যেভাবে চাই, সরকার আমাদের সেভাবে সহযোগিতা করে না। আমাদের কাছে তো পাওয়ার নেই। আমরা বলব অমুক পাম্পে তেল নিয়ে কারসাজি করছে, কিন্তু সেখানে যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তখন আমাদের মালিকদের মধ্যে ভূল বোঝাবোঝির আশঙ্কা থাকে। জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে একটা মনিটরিং সেল করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা আলোর মুখ দেখেনি।’

তেলে ভেজাল ও ওজন কম দেওয়া প্রতিরোধে পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সরকারের কাছে তিনটি দাবি জানিয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে কেউ প্রথমবার কারসাজি করলে তাকে সতর্ক করা; দ্বিতীয়বার একই কাজ করলে তার তেলের সরবরাহ কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখা এবং তৃতীয়বার ধরা পড়লে তার লাইসেন্স বাতিল করে দিতে হবে। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি।

(ঢাকাটাইমস/০৭ আগস্ট/এএ/কেএম)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
পাকিস্তানি অভিনেত্রী হুমাইরা আসগরের রহস্যজনক মৃত্যু
জুরাইনে অস্ত্রসহ তিন মাদক কারবারি গ্রেপ্তার
শেখ হাসিনাকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে: প্রেস সচিব
বিবিসি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীর ভয়াবহ ৩০ মিনিট
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা