মাছের পোনা উৎপাদনে সাফল্য ছুঁলেন দিনাজপুরের সাদেকা বানু

শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর
| আপডেট : ২৪ মে ২০২৩, ১১:০৩ | প্রকাশিত : ২৪ মে ২০২৩, ১০:৩৫

মাছের পোনা চাষ করে সফলতা পেয়েছেন দিনাজপুরের নারী উদ্যোক্তা সাদেকা বানু। ছোট পরিসরে শুরু করলেও বর্তমানে তিনি ৩১ একর জমিতে ২২টি পুকুরে জি-থ্রি রুইসহ বিভিন্ন জাতের মাছের পোনা উৎপাদন করছেন। তার এ উদ্যোগে এলাকার অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। এছাড়া তার এ সফলতায় অনুপ্রাণিত হয়ে জেলার অনেকেই মাছ চাষে ঝুঁকছেন।

জানা গেছে, নারী উদ্যোক্তা সাদেকা বানুর বাৎসরিক আয় এখন প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা।

ঢাকা টাইমসকে তিনি জানান, ২০১৫ সালে দিনাজপুর দক্ষিণ কোতয়ালীর মালিগ্রামে দুটি পুকুর লিজ নিয়ে তিনি রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভারকার্প, সাদাপুটি, তেলাপিয়া পোনা উৎপাদন শুরু করেন। প্রথম বছরেই সাফল্যের মুখ দেখেন তিনি। পরের বছর গ্রামের আরও তিনটি পুকুর লিজ নিয়ে মাছের পোনা উৎপাদন বাড়ান। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি নারী উদ্যোক্তা সাদেকা বানুকে। বর্তমানে নিজ গ্রামসহ পার্শবতী এলাকা বড়গ্রাম ও কমলপুরে ৩১ একর জমিতে ২২টি পুকুরে জি-থ্রি রুইসহ বিভিন্ন জাতের মাছের পোনা উৎপাদন করছেন তিনি।

সাদেকা বানুর বয়স এখন চল্লিশের কাছাকাছি। চোখে-মুখে এখনো তার এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। তার সফলতার গল্প জানতে চাইলে ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। এখন আমার সুখের সংসার। মাছের পোনা চাষ ও বিক্রি করে দুটি মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। ছেলেকে পড়ালেখা করাচ্ছি। তাকে মানুষের মতো মানুষ করার স্বপ্ন আমার। এজন্য এখনো হাল ধরে আছি। দুটি পুকুর থেকে আমার এখন ২২টি পুকুর।

তিনি বলেন, ৩১ একর জমিতে ২২টি পুকুরের মধ্যে তিনটি পুকুরে গত বছর থেকে জি-থ্রি রুই মাছের পোনা উৎপাদন করছি। এতে অনেক সাফল্য এসেছে। এ পোনা মাছের চাহিদাও অনেক। আমি হিসাব করে দেখেছি, সব বাদ সাত দিয়ে আমার এখন বাৎসরিক আয় থাকে প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা। ভাবছি, আরও কিছু পুকুরে এই জাতের মাছের পোনা উৎপাদন করবো।’

সাদেকা বানুর স্বামী আগে ধান-চালের ব্যবসা করতেন। এখন স্ত্রীর সংগ্রামী জীবনের সাফল্য দেখে স্বামী বেলাল হোসেনও অন্যপেশা ছেড়ে স্ত্রীকে সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন। পুকুরগুলোর তত্ত্বাবধানে কাজ করছেন।

বেলাল হোসেন ঢাকা টাইমসকে জানান, ‘অন্য পেশার চেয়ে এই পেশা লাভ এখন সন্মানজনক। স্বাধীন পেশা। কেউ মুখের ভাষা খারাপ করে আর গালি দিতে পাবেনা। স্ত্রীর এই পেশার প্রতি সন্মান জানিয়ে অন্য ব্যবসা ছেড়ে আমিও তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। তার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রায় ৫ বছর হলো। আমি ও আমার স্ত্রী উভয়ে পোনা মাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। দরদাম ঠিক থাকলে পোনা দেই। মাছের খাবার নিয়ে আসি। পুকুরে দেই। এখন আর অন্য কাজ করার সময় পাই না।’

এদিকে গত বছর থেকে পরীক্ষামূলক ৩টি পুকুরে ওয়ার্ল্ডফিশ উদ্ভাবিত ‘তৃতীয় প্রজন্ম’ বা জি-৩ রুই এর পোনা উৎপাদন শুরু করেন সাদেকা বানু। এতেও ব্যাপব সাফল্য পেয়েছেন তিনি। চলিত রুই মাছের চেয়ে শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ বেশি বৃদ্ধি পায় জি-৩ রুই। তাই, জি-৩ রুই পোনার ব্যাপক চাহিদা থাকায় পোনা মাছ বিক্রেতারা তার পুকুরে ঝুকতে থাকেন। ইতোমধ্যে তার পুকুরের পাছের পোনা জেলা ছাড়িয়ে সারাদেশে সরবরাহ শুরু হয়েছে।

সরজমিনে পুকুর পাড়ে কথা হয় পোনা মাছ নিতে আসা মকবুল হোসেন, মোজাম্মেল, সফিকুল, রমজান, নেহাল, পরেশ মহন্তসহ অনেকের সঙ্গে। বাই-সাইকেলের পেছনে বড় সিলভারের হাড়ি বেখে তার ভেতরে পোনা মাছ নিয়ে হাড়ির মুখে লাল-সাদা কাপড় পেচিয়ে তারা ছুটে চলেন গ্রাম থেকে গঞ্জে পোনা মাছ সরবরাহে। তাদের একজন পোনা মাছ ব্যবসায়ী মকবুল হোসেন।

ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘অন্য পোনার চাইতে এখন জি-৩ রুই এর পোনার অনেক চাহিদা। বিত্রি করে লাভও ভালো। তাই এই পোনা নিয়াই যাচি (যাচ্ছি)। অর্ডার আছে। কাহারোল উপজেলায় যাবো পোনা দিতে। সপ্তাহে ৩-৪দিন ব্যবসা করি। এতে যা লাভ পাই, তাতেই সংসার চলে।’

নারী উদ্যোক্তা সাদেকা বানুকে এ বিষয়ে প্রথম থেকেই সহায়তা করে আসছে মহিলা বহুমূখী শিক্ষা কেন্দ্র (এমবিএসকে) ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন। মাছের পোনা উদ্যোক্তা তৈরিতে মহিলাদের দিয়ে সমিতির মাধ্যমে কাজ করছে প্রতিষ্ঠান দুটি। শ্যামলী মহিলা সমিতি নামে এমন একটি সংগঠনের সদস্য সাদেকা বানু। যার সদস্য সংখ্যা ১৯৪০ জন।

মহিলা বহুমূখী শিক্ষা কেন্দ্র-এমবিএসকের মৎস্য কর্মকর্তা মো. রায়হান আলী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সাদেকা বানু তাদের একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। দীর্ঘ ৭-৮ বছর ধরে তাকে সহায়তা করছি আমরা। তিনি বিভিন্ন জাতের মাছের পোনা উৎপাদন করলেও গত বছরেই প্রথম আমরা তাকে পরীক্ষামূলকভাবে এককেজি ‘তৃতীয় প্রজন্ম’ বা জি-৩ রুই এর রেনু দেই পোনা উৎপাদনের জন্য। তারপর তিনি আরও দুইকেজি আরো ‘তৃতীয় প্রজন্ম’ বা জি-৩ রুই এর রেনু ক্রয় করে পুকুরে পোনা উৎপাদনে নামেন। এতে তিনি ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছেন। তার পোনা এখন জেলা ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চওেল যাচ্ছে, মাছ চাষের জন্য। আমরা খুব গর্বিত। আমাদের উদ্যোক্তার সাফল্যে।’

এদিকে ‘তৃতীয় প্রজন্ম’ বা জি-৩ রুই এর পোনা উৎপাদনে সাদেকা বানুকে সবরকম প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দিচ্ছে দিনাজপুর জেলা মৎস্য বিভাগ। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আশরাফুজ্জামান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ওয়ার্ল্ডফিশ উদ্ভাবিত ‘তৃতীয় প্রজন্ম’ বা জি-৩ রুই এর পোনা উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন নারী উদ্যোক্তা সাদেকা বানু। তার সাফল্যে এখন অনেকে অনুপ্রাণিত। আমরা সবরকম প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে তাকে সহযোগিতা করছি। অন্যরাও চাইলে এ সহায়তা পাবে। আমরা চাই নারীরা আরো এগিয়ে আসুক এ ধরনের কার্যক্রমে। এসব কাজে তাদের সাফল্য পাবার বেশি সুযোগ থাকে।’

আরও পড়ুন: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৃথক বজ্রপাতে কৃষক-শ্রমিকের মৃত্যু

নারী উদ্যোক্তা সাদেকা বানুর সাফল্য এখন অনেকের অনুপ্রেরণা। তার সাফল্য দেখে অনেকে এখন মৎস্য চাষে ঝুকছেন। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে ছুঁটে আসছেন, তার মাছের খামার দেখার জন্য।

(ঢাকাটাইমস/২৪মে/এসএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :