বঙ্গবন্ধু আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আলোকিত এক নতুন অধ্যায়

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
  প্রকাশিত : ০৪ আগস্ট ২০২৩, ১৭:১৯| আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২৩, ১৮:২৯
অ- অ+

বিস্মিত মহাকাল!

চিরজাগ্রত উন্নত শির, মুক্তির কবিয়াল

ইতিহাস তুমি, একাত্তরের অমর বিজয়গাঁথা,

মহাসংগ্রামী, স্রষ্টার দূত, বাঙালি জাতির পিতা।

বঙ্গবন্ধু বিশ্ববন্ধু, শোষিতের বরাভয়-

বর্জ্রকণ্ঠী, মহাজাগতিক, দুর্বার-দুর্জয়।

রুদ্ধ দুয়ার, লৌহ কারাগার কম্পিত সেই নামে,

শেখ মুজিবুর, কাণ্ডারি তুমি-

চেতনার সংগ্রামে।

প্রথাগতভাবে সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্মে সমাজের বিশেষ বিশেষ সময়ের উল্ল্যেখযোগ্য প্রেক্ষাপট প্রতিবিম্বিত হয়। সাধারণত, সাহিত্যের প্রচলিত চর্চায় সমসাময়িক ঘটনাবলীর প্রভাব এবং তার নান্দনিক ভাববিশ্লেষণ সেই সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্ররূপ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করে। তাই সাহিত্যকে সমাজের দর্পন বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। আবহমান বাংলার সাহিত্যকর্মও এর ভিন্ন নয়। ইংরেজবিরোধী স্বদেশী আন্দোলন থেকে শুরু করে ৫২'র মাতৃভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৭১ এর স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় বিপুল পরিমাণে দেশাত্ববোধকেন্দ্রীক সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই সময়ের প্রভাব এবং দাবিতে কবি, গল্পকার, নাট্যকার, গীতিকার ও অন্যান্য অঙ্গের সাহিত্যিকগণ তাদের সাহিত্যকর্মে চলমান ঘটনাপ্রবাহের নিদর্শন রেখে যান। বলা বাহুল্য যে, ইতিহাসের প্রায় প্রতিটি গণআন্দোলনেই সমসাময়িক শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। একটি মানবিক সমাজের রূপরেখায় তার নিজস্ব সংস্কৃতির প্রভাব অপরিসীম। জাতিগতভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নিজেদের কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সমাজ বিন্যাসের প্রকৃতি, শিক্ষার স্বরুপ প্রভৃতি চিত্রিত হয়ে থাকে সমসাময়িক সাহিত্যকর্মে। আর্থসামাজিক ব্যবস্থাপনার যে কোনো সময়ের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন সাহিত্যিকগণ সে সময়ের সামাজিক ইতিহাসের চিত্রকল্পটি স্বযত্নে এঁকে রেখে যান পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। যা অভিযোজনের প্রয়োজনে পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থার পরিকল্পনায় যথার্থ নির্দেশিকার ভূমিকা পালন করে। তাই বলা যায়- একজন প্রকৃত সাহিত্যিক, একজন আদর্শ সমাজবিজ্ঞানীর প্রতিরূপ।

আবহমান কাল ধরেই গঙ্গা-পদ্মা নদীবিধৌত বঙ্গভূমি তার অনন্য লোকজসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য সুপ্রসিদ্ধ। বাংলার বৈচিত্রময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই লোকজ নন্দনতত্ত্বে বিরাট প্রভাব রেখেছে। যুগে যুগে অসংখ্য সুপ্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিকের পাশাপাশি অগুনিত বাউল, কবিয়ালের সৃষ্টি হয়েছে বাংলার এই পূণ্যভূমিতে। এমন কি, দেহতত্ত্ব ও আধ্যাত্মসংগীত বাংলার সুফি সাধনতত্ত্বের অন্যতম আধার হিসেবে আজও বিশেষভাবে প্রচলিত এবং লোকপ্রিয়। সহজাতভাবেই বাংলার লোকজ সাহিত্যিকগণ যে কোনো বিশেষ ঘটনাকেই তাদের একান্ত নিজস্ব উৎকর্ষতায় জারি, সারি, বাউল, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শীদি ইত্যাদি ধারায় সম্পৃক্ত করে নিতেন। তাই, মুক্তিযুদ্ধের মত অন্যতম একটি ঘটনার প্রভাব বাংলার প্রচলিত শিল্প-সংস্কৃতিচর্চায় অবশ্যই এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে, এ কথা অনায়াসেই বলা যেত।

স্বাধীনতাযুদ্ধকালীন সময় থেকেই 'বাংলাদেশ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বঙ্গবন্ধু'- এই ত্রিসন্ধির প্রভাব বাংলার সাহিত্যকর্মে এক নতুন যুগের সূচনা করে। জাতির পিতার অনন্য নেতৃত্বগুনে সে সময় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল স্তরের সাধারন মানুষেরা যে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের ভাবাদর্শে একাত্ব হয়েছিল, তার মূল ভিত্তি ছিল বাংলার লোকজ সংস্কৃতি। অলৌকিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রজ্ঞাশীলতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে বাংলার সমস্ত মানুষের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিয়তাবাদের যে বীজ বপন করে গেছেন, তার প্রধান ভিত্তিই ছিল হাজার বছরের বহমান বাংলা শিল্প-সাহিত্য ও লোকজসংস্কৃতির অভেদ্য বন্ধন। বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহবানে সাড়া দিয়ে বাংলার কবি সাহিত্যিকরা ওই সময় অজস্র গণসংগীত, উদ্দীপনামূলক গান রচনা করে সমরশক্তি আহরণের প্রেরণা যুগিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পীরা সে সময় বিশ্বনেতৃত্বের চেতনায় বাংলার সাধারণ মানুষের পক্ষে যে গণজাগরণের জোয়ার তুলেছিলেন, তা ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উদাহরণ হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। এই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি অগ্রদূত হয়ে একাধারে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, বাংলার শিল্প ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং বিশ্ব মানবাধিকার সংরক্ষণ ও শান্তি স্থাপনের আন্দোলনে। বিশ্বরাজনীতির অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ইতিহাসে আর কোনো নেতাই নিজেকে বঙ্গবন্ধুর মতো এতটা প্রসারিত করতে পারেননি।

স্বাধীন বাংলার শিল্প ও লোকজসংস্কৃতির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রভাব এতটাই প্রবল যে, একক ব্যক্তি হিসেবে শুধুমাত্র তাকে নিয়েই বাংলাদেশে শত সহস্র গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছড়া, নাটক, যাত্রাপালা, চলচ্চিত্র নির্মাণ, গবেষণা গ্রন্থ ইত্যাদি রচিত হয়েছে। এমন কী, স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরেও এই ধারাবাহিকতার স্রোতে কিছুমাত্র প্রতিপ্রবাহ দৃষ্টিগোচর হয়নি। তার এই বিশালত্বের কাছে জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা এবং সাধারণ মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অর্জনের নীরিখে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রনায়কদের তুলনার প্রেক্ষাপটে জাগতিক সমস্ত সংখ্যাতত্ব ও তথ্য-উপাত্তের হিসেব তুচ্ছ হয়ে যায়। নক্ষত্রের মহাকায়তা ও ঔজ্জ্বল্যের কাছে গ্রহ, উপগ্রহের অস্তিত্ব যেমন ম্লান ও নিস্প্রভ, তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে অদ্বিতীয় উদাহরণ হয়ে সর্বকালের সমস্ত রাষ্ট্রনায়কদের চেয়ে সামগ্রিক প্রভাব বিস্তারে বহু আলোকবর্ষ অগ্রবর্তী হয়ে আছেন। এমন কী, বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বহু সাহিত্যিকগণ তাকে নিয়ে রচনা করেছেন বিভিন্ন গ্রন্থ, যা ওই সব দেশের নতুন প্রজন্মকে তাদের নিজস্ব জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে, সমৃদ্ধ করেছে তাদের সাহিত্যকে।

একটি নবগঠিত সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তার জীবদ্দশাতেই বঙ্গবন্ধুর বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা সমসাময়িক প্রায় সকল রাষ্ট্রপ্রধানকে ছাড়িয়ে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল। যুদ্ধবিদ্ধস্ত ধ্বংসস্তুপের মাঝেও এক রকম শূন্য হাতে রাষ্ট্রপরিচালনা শুরু করে ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে তিনি গঠনতন্ত্র থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত বিষয়েই বিদ্ধস্ত বাংলাদেশকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে সফল হয়েছিলেন। তার এই অলৌকিক দক্ষতা, অভূতপূর্ব রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, একনিষ্ঠ সংস্কৃতিপ্রবণ ব্যক্তিত্ব ও মুক্তমনা অসাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি প্রবল ভাবে আকৃষ্ট করেছিল সমসাময়িক প্রায় সমস্ত পর্যায়ের সাহিত্যকর্মীদের। এমন কী, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি দ্বারা পরিচালিত ৭৫ পরবর্তী প্রায় দুই দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসের কালযুগের কুপ্রভাবকে অগ্রাহ্য করে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের মহেন্দ্রক্ষণে এসে, স্বাধীনতাযুদ্ধের অর্ধশত বছর পরেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সাহিত্যকর্মীদের আবেগ বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি, বরং বহুগুনে বর্ধিত হয়েছে। তাই বলা যায়, 'বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ' বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক চিরকালীন সচল অধ্যায়। এক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করলেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই সুস্পষ্ট হয়ে যায়। কারণ, ভবিষ্যৎ বাংলার সার্বিক রূপরেখাও তিনি কোনো এক অতিমানবীয় দক্ষতায় নিখুঁতভাবে চিত্রায়ন করে গিয়েছিলেন, যে আদর্শে তারই সুযোগ্য কন্যা তার নির্দিষ্ট পথ ধরে সফলভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার মাধ্যমে দেশকে সুনিশ্চিত সমৃদ্ধির পথে অবলীলাক্রমে পরিচালনা করে চলেছেন। তাই আজও বাংলার শত শত সাহিত্যকর্মী তাকে নিয়ে অমর সাহিত্য রচনার স্বপ্ন দেখে। ইতিহাসের আর কোনও রাষ্ট্রনায়ক নিজেকে এমন আধ্যাত্মিক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেননি, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভবিষ্যতবিশ্বের নতুন প্রজন্ম তাকে নিয়ে গবেষণা করে, তার সমগ্র কর্মকান্ড এবং গৃহিত সিদ্ধান্তসমূহের রাজনৈতিক ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে বিশ্বনেতৃত্বের প্রয়োজনে নিজেদের সমৃদ্ধ করবে, এ শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই স্বর্ণযুগে তথ্য উপাত্তের সহজলভ্যতার কারণে অচিরেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সমাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনুকরনীয় আদর্শ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সার্বিক কার্যক্রমের গঠনমূলক পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার প্রবল যৌক্তিকতা রাখে। কালজয়ী এই পরম পুরুষ আমাদের পিতা- বাঙালি হিসেবে এই গর্ব একান্তই আমাদের, জন্মসূত্রে প্রতিটি বাংলাদেশি নাগরিকের। জয় বাংলা।

লেখক: পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
গাইবান্ধায় ঝড়ের রাতে ফেরার পথে প্রাণ গেল র‍্যাব সদস্যের 
চিকিৎসা সেবায় আত্মনিয়োগ করুন: প্রধান উপদেষ্টা
ঘাটাইলে অটোরিকশার ধাক্কায় শিশু শিক্ষার্থী নিহত
গেজেট পাওয়ার পর আওয়ামী লীগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত: সিইসি
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা