আগুনে পুড়েছে ঘর, খোলা আকাশের নিচে ৩০০ পরিবার

- ঢাকার তেজগাঁও বস্তিতে আগুন, নিহত ২, ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি গঠন
- মুহূর্তেই নিঃস্ব তারা, সবাই তাকিয়ে সরকারের দিকে
খোলা আকাশের নিচে আগুনে পোড়া তেজগাঁওয়ের মোল্লাবাড়ি বস্তির ৩ শতাধিক পরিবার এক মুহূর্তেই নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। সহায় সম্বলহীন এসকল হত দরিদ্র মানুষের ঠাঁই হয়েছে তেজগাঁও রেল লাইনের পাশে। খেয়ে না খেয়ে খালি হাতে পরিবার নিয়ে কনকনে শীতে স্রষ্টার দিকে তাকিয়ে আছেন তারা। কেউ একজন হয়তো আসবে তাদের পাশে দাঁড়াতে।
সরেজমিনে আগুনে পোড়া তেজগাঁওয়ে বিএফডিসির পাশে মোল্লাবাড়ি বস্তিবাসীর খোঁজখবর নিতে যায় ঢাকা টাইমস। সন্ধ্যার পর সেখানে গিয়ে চোখে পরে প্রায় ৩ শতাধিক পরিবারের মানবেতর দৃশ্য। কথা হয় অনেক অসহায় পরিবারের সাথে।
বস্তিতে পরিবার নিয়ে থাকতেন ভ্যান চালক বাবু। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘রাইতে আড়াইটার সময় আমি কাওরান বাজারে আছিলাম। মানসে কইলো বস্তিতে আগুন লাগছে। গিয়া দেহি আমার ঘরদা পুইড়া যাইতাছে। আগুন নেভাইতে যাইতে চাইছিলাম কেউ যাইতে দেয় নাই। আমার বউ ৩ বছরের পোলাডা লইয়া খালি হাতে বারাইয়া গেছে। এহন আমরা রাস্তায় আছি, কই যামু। এই শীতের মধ্যে একটা চান্দর পেচাইয়া পোলাডারে লইয়া আছি। এমনে কয়দিন থাহুম আল্লাহ জানে।’
বাবু আরও বলেন, তারা পরিবার নিয়ে ৫ হাজার টাকা দিয়ে বস্তিতে ভাড়া থাকতেন। এই বস্তিতে প্রায় ৩শ’র মতো ঘর ছিল। সব ঘরই পুরে ছাই হয়ে গেছে।
কাওরান বাজারে মাছ কাটার কাজ করতেন শাহ আলম। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘রাইত আড়াইটার দিকে আগুন লাগার খবর হুইনা ফৌরাইয়া (দৌঁড়াইয়া) আহি। আইয়া দেহি পুরা বস্তি আগুনে দাউ দাউ করে জলতাছে। তহন ফায়ার সার্ভিসের কেউ আহে নাই। আমি ২৫শ টাহা ভাড়া দিয়া এই বস্তির একটা ম্যাসে থাকতাম।’
বস্তি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অনেকেই পোরা বস্তির ধ্বংসাবশেষ সরানোর কাজ করছেন। বস্তি এরিয়াতে পড়ে আছে ঘরের বিভিন্ন আসবাববপত্রের পোড়া অংশ। বস্তির আশপাশের সড়কে বসে বস্তিবাসী অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সকলেই শূন্য হাতে তীব্র শীতে কাঁপছেন। অনেকে তাদের ছোট ছেলে মেয়েদের কোনোরকম চাদর মুড়িয়ে রেখেছেন।
ষাটোর্ধ বয়সী নারী জামালপুরের বাসিন্দা নাইলি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমি এ জায়গায় ২০ বছর ধইরা থাহি। কাওরান বাজারে কাঁচামাল বেচি। রাইতে বাজারে পাইকারি মাল কিনতে গেছিলাম। আগুনের কথা হুইনা আইছি এইহানে। আইয়া দেহি পুরা বস্তি পুড়তাছে। আমি এই জায়গায় একলাই থাহি।’
পঞ্চাশর্ধ জহুরা বেগম টলমলে চোখে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমি হারাদিন ভিা করি বাবা। হারাদিন ভিক্কা কইরা এই বস্তিতে দুই হাজার টাহা ভাড়া দিয়া থাহি। আমি যা রোগী। আমার ঔষদের কাগজপত্র সব পুইড়া গেছে। ঘরের মধ্যে আমি আমার এক নাতীর লইগা টাহা জমাইছি। ওরে ইশকুলে ভর্তি করামু। আমার ঘরের সব পুইড়া গেছে। কেডা আগুন লাগাইয়া আমাগো সর্বনাশটা করলো।’
শুধু জহুরাই নয়, অগ্নিকাণ্ডে তিগ্রস্থদের সবার কথা প্রায় একই রকম। কেউ হারিয়েছেন স্বজন। কেউ হারিয়েছেন সম্পদ। আবার কেউ হারিয়েছেন মাথা গোজার ঠাঁই।
এদিকে বিকালে বস্তিবাসীকে এক বস্তা চাল ও একটি করে কম্বল দেওয়া হয়েছে সরকারের প থেকে।
জাকিয়া নামের এক নারী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাগো এক বস্তা চাউল আর একটা কইরা পাতলা কম্বল দিছে। আর আমাগো কেউই কোনো খবর নেয় নাই। আমরা সারা রাইত এই খোলা আকাশের নিচে কেমনে থাকুম। চাউল না হয় সরকার দিছে, আমরা কি খালি চাউল খাইয়া থাকুম। আর চাউল রানমু (রান্না) কী দিয়া।’
শুক্রবার রাত ২টার পর তেজগাঁওয়ে বিএফডিসির পাশে মোল্লাবাড়ি বস্তিতে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট সোয়া এক ঘণ্টার চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে ঘটনাস্থল থেকে দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।
বস্তিটিতে প্রায় তিনশ ঘর ছিল, কাঠ, বাঁশ আর টিনের তৈরি হওয়ায় সর্বনাশা আগুনে প্রায় সব ঘরই পুড়ে যায়।
আগুন কীভাবে লেগেছে সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত করেনি ফায়ার সার্ভিস কিংবা আইন প্রয়োগকারী কোনো সংস্থা। যে দুজন আগুনে পুড়ে মারা গেছেন, তাদের পরিচয় ইতোমধ্যে ঢাকা টাইমসের কাছে এসেছে। মৃত দুইজনের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে রাখা হয়েছে। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাদের ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়েছে।
বস্তিতে থাকা আছিয়া বেগম নামের এক নারী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমার বোন লিপির বাড়িতে আইছে শারমিন আর তার ছেলে আফি (৩)। ওদের লাশ এহন ঢাকা মেডিকেলে আছে। আমার বোন হেয়ানে গেছে লাশ আনতে। শারমিনের শশুর বাড়ি জামালপুরে। জামালপুর থেইকা শারমিন মায়ের বাড়িতে দেড় মাস আগে বেড়াইতে আইছিল। মাইইয়াডা পোলারে কোলে লইয়া রাইতে ঘুমাইয়া আছিল। আগুন লাগার পর আর বাইরাইতে পারে নাই। পোলা লইয়াই পুড়া মরলো। শারমিনের জামাই কাওরান বাজারের এক দোকানে কাম করে। আগুন লাগার সময় সে দোহানে আছিল।’
এদিকে বস্তিতে আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে সভাপতি করে ফায়ার সার্ভিস পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত কমিটির মেয়াদ ১৫ দিন। কমিটির বাকি চার সদস্য হলেন ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিন (সদস্য সচিব), ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ারুল হক, ফায়ার সার্ভিসের জোন-১ এর উপসহকারী পরিচালক মো. তানহারুল ইসলাম ও তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের স্টেশন অফিসার মো. নাজিম উদ্দিন।
(ঢাকাটাইমস/এইচএম/এসআইএস)

মন্তব্য করুন